লকডাউন বা নানা কড়া পদক্ষেপের মধ্যেও মহামারি করোনা তার সক্ষমতা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে গোটা বিশ্বকে। রূপ আছে বলে তা বদলাচ্ছে। তেজি হচ্ছে। আগে বিভিন্ন শতকে আসা কলেরা, ম্যালেরিয়া, প্লেগ ইত্যাদি মহামারি রূপ পাল্টে দুর্বল হয়েছে। আর করোনা রূপ পাল্টে হচ্ছে আরও শক্তিধর। করোনার শ্রেষ্ঠত্বকে সম্মান দিতে সামনে ১৫ অক্টোবরে বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস পালনে দেশে দেশে প্রস্তুতির খবর মিলছে।
Advertisement
এত বছর বাঁহাতি দিবস, ডিম দিবস, সুখ দিবস, কবুতর দিবস, টমেটো দিবসের মতো হাস্যস্পদ অগুণতি বিশ্ব দিবসের মতো পালন হয়েছে দিনটি। তা-ও সব দেশে নয়। কিছু কিছু দেশে। দিনটির উদ্দেশ্য হাত ধোয়ার উপকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো। বাংলাদেশেও সীমিত আয়োজনে দিনটি পালন হয়ে আসছে গত কয়েক বছর ধরে। এ নিয়ে হাসি-মশকরাও কম হয়নি। এখন আর তা হবে না।
বিশ্ব হাত ধোয়া দিবসের সূচনা তত আগের নয়। সুইডেনের স্টকহোমে সর্বপ্রথম ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর হাত ধোয়া দিবসের গোড়াপত্তন। আয়োজক ছিল কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মোর্চা ‘পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ ফর হ্যান্ডওয়াশিং’। শুরুতে এ ক্যাম্পেইনের মূল টার্গেট করা হয়েছিল স্কুল শিক্ষার্থীদের হাত ধোয়ানো। পরে কিছু দিনের মধ্যে বিশ্বজুড়ে সববয়সী মানুষের মধ্যে প্রতিদিন যথানিয়মে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার তাগিদ তৈরি হয়।
দৈনন্দিন জীবনে মানুষ চেতনে-অবচেতনে হাত দিয়ে কত কাজ করে, হাত কত জায়গায় নেয়- নিজেও জানে না। এসব কাজ করতে গিয়ে হাতে লাগে অসংখ্য জীবাণুর সংস্পর্শ। এতে প্রত্যেকের হাত প্রত্যেকের শত্রু হয়ে ওঠে। যার ফলে ছড়ায় নানা রোগবালাই। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক নিয়মে হাত ধোয়ার অভ্যাস একটি ভালো ভ্যাকসিনের চেয়েও বেশি কাজ করে। সেই বিবেচনায় হাত ধোয়া একটি সাশ্রয়ী স্বাস্থ্য অভ্যাস।
Advertisement
নিয়মিত হাতমুখ ধোয়ার অভ্যাস গড়ে উঠলে পানি ও মলবাহিত রোগগুলো এত দাপট দেখাতে পারত না। করোনা আপাতত আমাদের হাতমুখ ধোয়ার অভ্যাস গড়ে দিতে পেরেছে। আরও কিছু বদবৈশিষ্ট্যেও বাধ সাধতে পেরেছে। কোনো রাষ্ট্র তার নাগরিকদের অবিরাম বেত মেরে তাদের সভ্য বানাতে পারে না। নাগরিকদেরও সভ্য হওয়ার ইচ্ছা থাকতে হয়। সুস্থ থাকা ও রাখার চর্চাও করতে হয়।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলতে হয় হাত-মুখ ধুয়ে পয়-পরিষ্কার থাকতে। কোন তলানিতে জনসচেতনতা? জনগণের বোধবুদ্ধি? করোনাকালে প্রমাণ হয়েছে এতদিন শিক্ষা মানুষকে দায়িত্ব সচেতন করেনি। সভ্য করেনি। আমরা মরতে চাই না, কিন্তু স্বর্গে যেতে চাই। বিষ গিলতে চাই। নিয়ম মানতে চাই না। কিন্তু করোনা থেকে সুরক্ষা চাই। হাঁচিকাশি দিতে দিতে, দাঁত খোঁচাতে-খোঁচাতে সরকারের ভুলত্রুটি ধরে ফেলি।
হতে পারে বড় জনসংখ্যার ছোট দেশটিতে রাস্তাঘাটে শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করা কঠিন। গণপরিবহনে অন্যের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলা মুশকিল। বাসের হাতল, সিঁড়ির রেলিং, লিফটের বোতাম, রেস্টুরেন্টের চেয়ার-টেবিল-গ্লাস-প্লেট-তোয়ালে, দোকানির দেয়া প্যাকেট না ছুঁয়ে থাকা সম্ভব নয়। এরপরও সাবধানতার কিছু বিষয়-আশয় থেকে যায়। যেখানে সরকারের বাইরে মানুষের নিজস্বার্থেই করণীয় অনেক কিছু রয়েছে।
ব্যক্তিপর্যায়ে মানুষকে সাফসতুর রাখার দায়িত্ব সরকারের নয়। সরকারের পক্ষে সেটা সম্ভবও নয়। নিজেরা ভাইরাস ছড়ালে, জন্ম দিলে সরকার কী করবে? যত্রতত্র থুথু ফেলা, পানের পিক ফেলা এবং নাক ঝাড়া বন্ধ করতে সরকারের আদেশ-অনুরোধ লাগছে। নিজেদের চারদিকসহ গোটা পরিবেশকে ভাইরাসের হ্যাচারি করে ফেলছেন কেউ কেউ। চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতলসহ আবর্জনা ফেলে ভাইরাসের ভাগাড় তৈরি করলে সরকার বা রাষ্ট্র এখানে কী করবে? কব্জি ডুবিয়ে খাব আমি, আর খাওয়ার পর সাবান দিয়ে কব্জি ডুবিয়ে হাত ধুয়ে দেবে আরেকজন?
Advertisement
রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় এই করোনার মাঝেও কফ-থুথু, পানের পিক তেমন কমেনি। কোনো কোনো অফিস-আদালতও একেকটি ডাস্টবিন। হাসপাতাল আরও বড় ডাস্টবিন। ফুটপাতে কুকুরের মতো পেসাব-পায়খানা করার স্বাধীনতা এখানে অবারিত। মানুষ হ্যান্ডশেক ছাড়াও আলগা মহব্বত দেখাতে গায়ে হাত দিয়ে কথা বলে। ব্যাংক-নোটও একেকটি ময়লার ভাগাড়। একবার স্পর্শ করলে করোনার আনন্দ র্যালি করে শরীরে ঢোকার গ্যারান্টি রয়েছে। এসবের জন্য কাউকে দায়ী করা হয় না। দায়ী করা যায়ও না। কোথাও জবাব দিতে হয় না! ভাইরাসের এ রকম বাম্পার হ্যাচারিতে নাক ডুবে থাকার পরও এখনতক বেঁচে থাকা পরম সৌভাগ্য অনেকের জন্য। আর ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে আল্লাহর খাস রহমত।
করোনাসহ নানা ভাইরাসের বিস্তার ঘটাতে আমরাই যথেষ্ট। আলামত এবং পারিপার্শ্বিকতায় জানাই ছিল করোনা থেকে বাংলাদেশ রেহাই পাবে না। কার সাথে কথা বলছি, ঘুরছি- একটুও ভ্রুক্ষেপ নেই। সেলফ কোয়ারেন্টাইন বুমেরাং হচ্ছে পদে পদে। স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবিধিও মানতে নারাজ আমরা। করোনা মোকাবিলার নামে মাস্ক পরে ঘুরছি। আবার এক বিড়ি ফুঁকছি চারজনে।
মাস্ক আর স্যানিটাইজার নিয়ে যে কাণ্ড ঘটছে তা আমাদের অভ্যাস বদলানোর বার্তা দেয় না। দেয় করোনার জয়জয়কারের বার্তা। প্রাণে বাঁচতে মানুষের এখন আর এদিক-সেদিক ছোটার সুযোগও নেই। এত প্রাণহানির পর বেঁচে থাকা মানবকুলের কী হবে?- প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে দেশে দেশে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
এইচআর/জেআইএম