জাতীয়

করোনা রোধে কাজ করছে ব্র্যাকের সামাজিক সহায়তা দল

দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। রোগীর ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল। এমন পরিস্থিতিতে সাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানে প্রস্তুত থাকার পাশাপাশি করোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন সচেতনতামূলক বার্তা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো জরুরি হয়ে পড়েছে।

Advertisement

এ বাস্তবতাকে মাথায় রেখে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করতে কমিউনিটিকে যুক্ত করে ঘরে ঘরে সচেতনতার বার্তা পৌঁছাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে ব্র্যাক।

ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক মোর্শেদা চৌধুরী জানিয়েছেন, সংক্রমণ রোধ, ঘরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতি এবং করোনাভাইরাস পরীক্ষা কার্যক্রমের সুবিধার্থে হটস্পটগুলোতে ব্র্যাক অন্য অংশীজনদের নিয়ে কমিউনিটিতে সহিষ্ণুতা তৈরিতে কাজ করবে।

করোনাভাইরাসের কারণে বিশেষত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে যে আর্থিক দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, নগদ অথবা অন্য ধরনের সহায়তা দিলে তা মানুষের আচরণগত উন্নতিতে সহায়তা করে।

Advertisement

মঙ্গলবার (৬ এপ্রিল) ব্র্যাকের সিনিয়র মিডিয়া ম্যানেজার মাহবুবুল আলম কবীর স্বাক্ষরিত ও প্রেরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরা হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বর্তমানে ৬টি জেলায় কমিউনিটির অংশগ্রহণকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করছে ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির অধীনে গঠিত সামাজিক সহায়তা দল। যুক্তরাজ্য সরকারের ফরেন,কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) অর্থায়নে ‘কমিউনিটি মোবিলাইজেশন এবং কমিউনিটি ক্লিনিক শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে কোভিড-১৯ রেসপন্স’ নামক এই প্রকল্প বর্তমানে কাজ করছে বাগেরহাট, ভোলা, শেরপুর, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও বগুড়ার ৫১টি উপজেলায়।

অন্য একটি প্রকল্পের আওতায় গাজীপুরের দুটি উপজেলায় স্বাস্থ্যবার্তার মাধ্যমে মানুষের আচরণগত পরিবর্তনে কাজ করছেন ব্র্যাকের কমিউনিটি কর্মীরা। ‌‘কমিউনিটি-বেজড কোভিড-১৯ রেসপন্স প্রজেক্ট’ শীর্ষক এই প্রকল্পে গত বছর সেপ্টেম্বর থেকেই গাজীপুরের কালিগঞ্জ এবং কাপাসিয়া উপজেলায় নিজস্ব অর্থায়নে কাজ করছে ব্র্যাক।

ছয় জেলায় প্রতি দুজন কমিউনিটি সাস্থ্যসেবা কর্মীর মাধ্যমে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। এই প্রকল্পে সরকারি কমিউনিটি সাস্থ্যসেবা কর্মীদের সাথে নিয়ে ব্র্যাক কাজ করছে। এই টিমগুলো বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলছেন এবং নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। ওইসব পরিবারে করোনাভাইরাস লক্ষণযুক্ত ব্যক্তি আছে কি না জানার চেষ্টা করছেন তারা এবং থাকলে তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সেবা নিতে সুপারিশ করছেন।

Advertisement

এছাড়া গঠন করা হচ্ছে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ কমিটি, যেখানে থাকছেন সংশ্লিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধি। সাধারণ মানুষকে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা এবং হাত ধোয়ার চর্চাসহ বিভিন্ন সতর্কবার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন তারা। আক্রান্ত বা লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় সুবিধাদি প্রদান করা হচ্ছে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৫১টি উপজেলায় এখন পর্যন্ত ২৭ হাজার লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেককেই টেলিমেডিসিন সেবা প্রদান করা হয়েছে এবং তাদের বাসায় বিভিন্ন সুবিধা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ১২ লাখ পরিবারে হাত ধোয়ার চর্চা, কাশি দেয়ার শিষ্টাচার, মাস্কের ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ করোনাভাইরাস রোধে স্বাস্থ্যবিধির বার্তাগুলো পৌঁছে দিয়েছেন ব্র্যাকের সামাজিক সহায়তা দল। এছাড়া প্রায় ১২ লাখ মাস্ক বিতরণ এবং ৫০ হাজার হ্যান্ড ওয়াশিং স্টেশন তৈরি করে দিয়েছে।

অন্যদিকে গাজীপুরের দুটি উপজেলায় মানুষকে সচেতন করার মাধ্যমে সংক্রমণহার কমানো এবং লক্ষণযুক্ত রোগীকে দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পাঠানোর লক্ষ্যে কাজ করছে এই প্রকল্প। বাজার, বাসস্ট্যান্ড, মসজিদ এবং সেলুন মূলত এই ৪টি স্থানে মানুষের আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন কর্মীরা।

বাজারগুলোতে দেখা হয় সেখানে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে কি না, আলাদা প্রবেশ এবং বাহির পথ আছে কি না, পর্যাপ্ত হাত ধোয়ার ব্যবস্থা আছে কি না, বিক্রেতারা মাস্ক পরছেন কি না ইত্যাদি।

দুই উপজেলার বাসস্ট্যান্ডগুলোতে যাত্রীদের সামাজিক দূরত্ব মানার প্রবণতা, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা এবং মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি বাসে ডিসইনফেক্ট ব্যবহার হচ্ছে কি না তাও লক্ষ্য করা হয়। মসজিদগুলোতে মানুষ মাস্ক পরছে কি না, নিজের জায়নামাজ নিয়ে আসছে কি না এবং দূরত্ব মানছে কি না তা খেয়াল করেন ব্র্যাকের কর্মীরা।

সেলুনে নাপিতরা মাস্ক পরছেন কি না, বসার ব্যবস্থায় তিন ফুট দূরত্ব আছে কি না এবং প্রবেশপথে সচেতনতামূলক স্টিকার আছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা হয়।

এ দুই উপজেলায় একহাজার ১৫৯ জন স্থানীয় অধিবাসী নিয়ে গঠিত হয়েছে ১৬০টি ‘কমিউনিটি করোনা প্রটেকশন কমিটি’। সমাজের নেতৃস্থানীয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ এবং স্থানীয় সাধারণ অধিবাসী নিয়ে গঠিত এসব কমিটি মানুষকে সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনার লক্ষণযুক্ত ব্যক্তি আছেন কি না তা দেখা এবং থাকলে তাদেরকে করণীয় বলে দেন কমিটির সদস্যরা।

লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পাঠানোর সুপারিশের পাশাপাশি প্রশিক্ষিত মেডিক্যাল অফিসারদের দ্বারা টেলিকাউন্সেলিংয়েরও ব্যবস্থা করছে এসব কমিটি।

গাজীপুরেই ব্র্যাকের কমিউনিটি দল গত মাস পর্যন্ত (মার্চ, ২০২১) মোট তিন হাজার ৮১২ জন ব্যক্তিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যার মাধ্যমে পরে এক হাজার ৭৫৬ জন করোনা রোগী হিসেবে শনাক্ত হন। তাদের প্রত্যেককেই টেলিমেডিসিন সেবা প্রদান করা হয়েছে এবং তাদের বাসায় বিভিন্ন সুবিধা পৌছে দেয়া হয়েছে।

জনসচেতনতার অংশ হিসেবে এখন পর্যন্ত দুই ধাপে এই টিমগুলো ৭৮ হাজার মাস্ক বিতরণ করেছে, যা ওইসব এলাকার ৬০ শতাংশ পরিবারের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। এছাড়া এলাকাগুলোতে মাইকিং এবং বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক উপকরণ বিতরণ করছে ব্র্যাক।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস হানা দেয়ার পর মার্চ ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২১ সময়কালে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে ৩ কোটি ৭৫ লাখ পরিবারে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে এবং ব্র্যাকের প্রসূতি কেন্দ্রের অধীনে ১৩ হাজার ৯৮৫ নিরাপদ শিশু জন্মদান কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে।

এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৬৫৯ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭৭৩ কমিউনিটি সাপোর্ট সদস্য প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন এবং করোনার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করেছেন। একই সঙ্গে ব্র্যাকের কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা সরকারকে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ এবং লক্ষণযুক্ত ব্যাক্তিদের চিকিৎসার নিমিত্তে সরকারি স্থাপনায় সুপারিশ করেছেন।

এমইউ/এমএসএইচ/এএসএম