দুইবার লেবার বিল দেয়াকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বে ৫ দিন বন্ধ রয়েছে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে ট্রাক থেকে পণ্য লোড-আনলোড। এ ক’দিনে প্রায় ১৫ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। বেকার হয়ে পড়েছে বন্দরের প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক।
Advertisement
ব্যবসায়ীরা জানান, ভারত থেকে একটি ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করলে তা ছাড় করানোর সময় লেবার বিল ও রাজস্ব একইসাথে পরিশোধ করতে হয় সরকারি চালানের মাধ্যমে। অপরদিকে লেবারদের বিল পরিশোধ করেন সরকার নিযুক্ত লেবার ঠিকাদার। ঠিকাদার মাস শেষে সরকারের কাছ থেকে ব্যবসায়ীদের দেওয়া নির্ধারিত বিল তুলে নেন। এরপর পণ্য খালাসের সময় আবারও বিল দিতে হয় লেবারদের। ফলে একই পণ্যে দুইবার লোড-আনলোড বিল গুণতে হয় আমদানিকারকদের।
ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, ভোমরা বন্দরে লেবারদের বিল পরিশোধ নিয়ে এক বিল দুইবার নেয়া হয়। এতে করে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা অন্য বন্দরের সাথে প্রতিযোগিতায় পেরে না উঠে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেকে ভোমরা ছেড়ে অন্য বন্দরে চলে গেছেন।
তাই বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ব্যবসায়ীরা আমদানি-রফতানিকৃত পণ্য খালাসে লেবারদের সরাসরি বখশিসের নামে মজুরির টাকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
Advertisement
ভোমরা স্থলবন্দরের হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, বৃহস্পতিবার (১এপ্রিল) থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত আমদানি ও রফতানিকৃত পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে।
পণ্য খালাস বন্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, এতদিন ট্রাক প্রতি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা বখশিশের নামে মজুরি দিতেন ব্যবসায়ীরা। এই মজুরির টাকা বন্ধ করে দেওয়াতে শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, ভোমরা স্থলবন্দরে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ ট্রাক পণ্য লোড-আনলোড হয়। ফলে আমদানীকারক সরাসরি মজুরি না দিলে সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যে টাকা তিনি পাবেন তা দিয়ে তার সংসার চলবে না।
স্থলবন্দরের শ্রমিক জিয়াউল ইসলাম জানান, সারাদিন খেটে ৫০০-৬০০ টাকা পাওয়া যায়। এখন শোনা যাচ্ছে মালিকরা (ব্যবসায়ীরা) সরাসরি মজুরি দেবেন না। তাহলে সংসার চলবে কীভাবে।
Advertisement
ভোমরা স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম বলেন, প্রতি টন পণ্য খালাসে প্রায় ৭০ টাকা পরিশোধ করতে হয় ব্যবসায়ীদের। এরসাথে লেবারদের ট্রাক প্রতি বকশিশের নামে মজুরি দিতে হয় ৫০০ থেকে দেড় হাজার টাকা। বাড়তি এই বকশিশের নামে মজুরির টাকা গোনা সম্ভব নয় বিধায় তারা নিজস্ব উদ্যোগে লেবার ডাকা বন্ধ করে দিয়েছেন।
ভোমরা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান জাগো নিউজকে জানান, সরকার নির্ধারিত ৬৯ টাকা ২০ পয়সা হারে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কর্তন করা হয়। অন্যদিকে ঠিকাদার কমদরে ইজারা নেয়ায় টেন্ডারকৃত লেবারদের জন্য পরিশোধ করা হয় ২৭ টাকা ৭৪ পয়সা। কিন্তু এই টাকা লেবাররা পান কিনা তা নিশ্চিত করবেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার।
এদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্দরে পণ্য খালাস করার জন্য সরকার একজন ঠিকাদার নিয়োগ করেছে। ট্রাক থেকে পণ্য লোড আনলোড করার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ লেবার সরবরাহ করতে টন প্রতি ৬৯.২০ টাকা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়ে থাকেন। অথচ সেই ঠিকাদার অদ্যাবধি কোনো লেবার নিয়োগ দেয়নি। বরং বন্দরের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মাসের পর মাস ওই টাকা তুলে আত্মসাৎ করছেন।
গত ৩ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে ব্যবসায়ীরা জানান, ঢাকাস্থ ড্রপ কমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠান বন্দরে লেবার নিয়োগের ঠিকাদার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিল। অথচ সেই প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী সোহরাব হোসেন গত ৫-৭ মাস আগে অন্য একজনের কাছে দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এরপর গত ৩ মার্চ বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এক চিঠিতে ব্যবসায়ীদেরকে অবগত করেন যে, ১ এপ্রিল থেকে ডাবল লেবার বিল কার্যকর করা হবে।
এ উপলক্ষে গত ২৩ মার্চ বাংলাদেশ স্থলবন্দর কৃর্তপক্ষের সচিবের উপস্থিতিতে ও বন্দরের চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে একটি কার্যকরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিষয়টি মিমাংসা না হওয়া পর্যন্ত ওই আদেশ চালু না করার জন্য সচিব, জেলা প্রশাসক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া ভোমরা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার জন্য লিখিতভাবে অনুরোধ জানান তারা।
অথচ কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও উপ-পরিচালক তাদের নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থে জোরপূর্বক ডাবল বিল চালু করতে মরিয়া। এটি চালু হলে প্রতি ট্রাকে শুধুমাত্র লেবার সংক্রান্ত ব্যয় হবে ১০ হাজার টাকারও বেশি। এত বিপুল পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের আর কোনো বন্দরে নেওয়া হয়না।
ভোমরা স্থলবন্দর আমদানি ও রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আবু হাসান জাগো নিউজকে জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পণ্য খালাসের জন্য আমাদের লেবার সরবরাহ না করে বন্দরের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে আমরা আমদানীকারকরা বাইরের লেবার সংগ্রহ করে ট্রাক প্রতি দুই হাজার টাকা দিয়ে পণ্য খালাস করাচ্ছি। ফলে পণ্য খালাসে আমারা দুবার লেবার বিল পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছি। বিভিন্ন সময়ে এর প্রতিবাদ করেও কোনো প্রতিকার পাইনি।
এ বিষয়ে জানার জন্য ভোমরা স্থলবন্দরের উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলামের ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিফ করেননি।
ভোমরা শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা ইমরান হোসেন জানান, প্রতিদিন গড়পড়তায় ৩ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়। সেই হিসাবে ৫ দিনে রাজস্ব ক্ষতি দাঁড়াবে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চললে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির মুখে পড়তে হবে।
এফএ/এএসএম