দেশজুড়ে

নামমাত্র ক্ষতিপূরণেই থেমে যায় খনির পঙ্গু শ্রমিকদের জীবন

প্রতিবছরই ৪ এপ্রিল পালিত হয় আন্তর্জাতিক খনি নিরাপত্তা দিবস। তবুও পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি খনি শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা। এখনও প্রতিবছর মাটির নিচে খনি আহরণ করতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন কিংবা পঙ্গু হচ্ছেন শ্রমিকরা।

Advertisement

দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ও মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনিতে খনি সম্পদ আহরণে মাটির নিচে কাজ করেন শ্রমিকরা। এই দুই খনিতে কাজ করতে গিয়ে দেশি বিদেশি অনেক শ্রমিক নিহত, আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেন।

এমনি তিনজন পঙ্গু শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা হলেন- দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার ১০নং হরিরামপুর ইউনিয়নের খাগড়াবন্দ গ্রামের মো. রাসেল সরকার (৩৬), দক্ষিণ মধ্যপাড়া গ্রামের মো. লিটন (৩৫) এবং রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার খাগড়াবন্দ গ্রামের মো. মোকাররম হোসেন (৪০)। এরা তিনজনই মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনির শ্রমিক।

মো. রাসেল সরকার মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনিতে ড্রিলিং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। তিনি ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে দুর্ঘটনার শিকার হন। খনির ভূগর্ভে কাজ করার সময় ভেতরে বিস্ফোরণ শেষে বিদ্যুতের তার গুছানোর সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ছিটকে পড়েন। এ সময় তিনি মুখমণ্ডল, হাত ও মাথায় আঘাত পান। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে ভর্তি করা হলে তার বাম হাত কেটে ফেলতে হয়। এ সময় খনির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসি তার চিকিৎসা ব্যয় বহন করেন। ৪ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ পেয়েছেন।

Advertisement

বর্তমানে চাকরি হারিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে অর্থ সম্পদ সব শেষ করে ফেলেছেন। এখন আর কেউ তার খবর নেয় না। এরওআগে তার বড় ভাই বিপ্লব হোসেন বজ্রপাতে ২০১০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। নিজের দুই সন্তান এবং বড় ভাইয়ের স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ পরিবার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।

এদিকে রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার খাগড়াবন্দ গ্রামের মো. মোকাররম হোসেনের সঙ্গে কথা হয় তার বাড়িতে। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনিতে ভূগর্ভে দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। ট্রলি অপারেটরের কাজ করতেন তিনি। ভূগর্ভে উপর থেকে পাথর পড়ে তিনি বাম পায়ে আঘাত পান। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার পা কেটে ফেলতে হয়। এরপর চাকরি হারান।

তিনিও ৪ লাখ টাকা এককালীন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। অনেক চেষ্টা করেও তিনি আর ক্ষণির ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। সেসময় কোনো কর্মকর্তাকে তিনি বলতে পারেননি অসহায়ত্বের কথা। তিনি বর্তমানে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

আরেক শ্রমিক দক্ষিণ মধ্যপাড়া গ্রামের মো. লিটন। তিন ২০০৪ সালের ৬ জানুয়ারি খনির উপরিভাগে বিদ্যুতের শ্রমিকের কাজ করতেন। বিদ্যুতের কাজ করার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে জ্ঞান ফিরে দেখেন তার ডান হাত কাটা। তিনি কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। ‘নাম নাম’ কোম্পানি চিকিৎসা করলেও তাকে এককালীন কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি। তিনি অনেক ঘোরাঘুরি করে ক্ষতিপূরণ না পেয়ে হতাশা নিয়ে জীবনযাপন করছেন। বর্তমানে তার স্ত্রী দর্জির কাজ করে সংসার চালান।

Advertisement

এ ব্যাপরে জানতে চাইলে মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া বলেন, আহত, নিহত ও পঙ্গু হয়ে যাওয়া খনি শ্রমিকদের কোনো তালিকা তার কাছে নেই। এর বাইরে কিছু বলতে চাননি তিনি।

এ ব্যাপারে জানতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রোকৌশলী এডিএম ফরিদুজ্জামনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকায় আছেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

সমাজ সেবক খন্দকার এইচ আর হাবিব বলেন, খনিতে ঘটা দুর্ঘটনাগুলো হঠাৎ হলেও দুর্ঘটনা অপেক্ষা বেশি লোক মারা যায় শ্রমিকদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করার অভাবে। বর্তমানে বাংলাদেশে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি ও মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনিতে শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছেন। কেননা সেখানেও খনিতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা মোকাবিলায় নেই কোনো সহায়ক ব্যবস্থা।

তিনি বলেন, খনির মতোই মূল্যবান খনি শ্রমিকদের জীবন। খনন পদ্ধতিকে আধুনিকীকরণের মাধ্যমে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। খনি প্রকৌশলে উন্নত বিস্ফোরক, বাষ্পচালিত পাম্প ইত্যাদির প্রয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। যারা জীবনের বিনিময়ে দেশের জন্য সাফল্য বয়ে নিয়ে আসেন, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিতে সবাগ্রে সেই দেশকেই এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি আরো বলেন, খনিতে যারা দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারগুলোকে আরও বেশি করে সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। যে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় তা বর্তমান সময়ের জন্য যথেষ্ট নয়।

এমদাদুল হক মিলন/এফএ/জিকেএস