এম এস সেলিম রেজা
Advertisement
প্রতিদিনের যান্ত্রিক জীবন থেকে হাফ ছেড়ে বাঁচতে জবাই বিলের কোনো জুড়ি নেই। জবাই বিলের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করবে। পূনর্ভবা নদীর ধার ঘেঁষে ও নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলার অন্তর্গত বিলটি। মাঝেমধ্যে অবসর কাটাতে যাওয়া হয় জবাই বিলে। যতদূর চোখ যায় চারদিকে দেখা মেলে পানি আর পানি। আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র এই তিন মাস বিলে থৈ থৈ করে পানি। স্বচ্ছ পানিতে বিভিন্ন রকম মাছের আনাগোনা। পানিতে মেঘের আনাগোনার প্রতিচ্ছবি বিলের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেয়।
সরকারি হিসেবে, বিলটি ৯৯০ একর বা ৪ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত। মিষ্টি রোদ আবার কখনো মেঘ কালো করে আসে বৃষ্টি। বৃষ্টির আগমনে প্রকৃতি যেন পরিপূর্ণতা লাভ করে। শীতল বাতাসের সঙ্গে মেঘ ঢেকে আসা বৃষ্টি অন্যরকম ভালো লাগা তৈরি করে। নৌকায় ভিজে ভিজে কৃষকদের চলাফেরায় গতি বাড়ে। বিলের চারপাশে মেঘেদের চলাফেরা যেন শিল্পীর রঙিন তুলি দিয়ে আঁকা। মনে হবে যেন মেঘগুলো স্পর্শ করেছে বিলের পানি। সে সময় বিলের সৌন্দর্য যেন আরও বহুগুণ বেড়ে যায়।
বিলের কিছু কিছু জায়গাজুড়ে রয়েছে কচুরিপানা। সেসব কচুরিপানা সংগ্রহ করে এলাকার মানুষ নিজেদের বাড়ির সামনে নিয়ে স্তূপ করে রাখে। পানি নেমে গেলে এসব কচুরিপানা জমিতে মিশে তৈরি হয় সার, তারপর সেখানে করা হয় সবজির চাষ। স্বচ্ছ পানির ভেতর জলজ উদ্ভিদের বসবাস নিজ চোখে দেখা যায়। বিলের যত গভীরে যাওয়া যায়, সৌন্দর্য যেন ততো বেশি চোখে পড়ে। জবাই বিলের সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্দি করতে চাইলে রোদের বিষয়টি মাথায় রেখে এখানে আসতে হবে। সকাল কিংবা বিকেলের দিকে আড্ডা দেওয়ার উপযুক্ত সময়। তবে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীরা অনেকেই খাবারের আবর্জনা ফেলে এখানকার পরিবেশ নোংরা করে ফেলেন।
Advertisement
বিলের পথ দিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়বে ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকা। বিলে ঘুরতে আসা মানুষ দেখে সেসব নৌকায় থাকা জেলেরা খুবই আনন্দিত হন। দিন শেষে যখন আলো ফুরিয়ে যায়, জবাই বিলের সৌন্দর্য যেন আরও বেড়ে যায়। চাঁদের আলোয় দেখা যায় অপরূপ গ্রামবাংলা। জানা যায়, বাঁশ আর কচুরিপানা দিয়ে ঘিরে রাখা হয় বিলের ছোট ছোট অংশ। যাতে বিলের পানি কমলেও মাছ থেকে যায়।
জবাই বিলে অতিথি পাখির পর্যাপ্ত খাবার থাকায় প্রতিবছর শীতের মৌসুমে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির আগমন ঘটে। রাজহাঁস, শামুকখোল, চাহা, সাদা বক, কক, বালিহাঁস, পাতি সরালীসহ জানা-অজানা বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আসে বিলে। পাখির কিচিরমিচিরে সব সময় মুখরিত থাকে। পার্শ্ববর্তী পূনর্ভবা নদীতে অসংখ্য অতিথি পাখির আগমন ঘটে। বিলের ছোট ছোট মাছ, পোকা-মাকড় এবং শামুকই মূলত তাদের প্রধান খাদ্য।
অতিথি পাখি ছাড়াও সারাবছর দেশি প্রজাতির পাখি বসবাস করে। বুক অথবা মাথা সমান পানিতে নিমজ্জিত বড় বড় গাছ। শিশু-কিশোররা বিলের পানিতে গোসল করে হেসে-খেলে। জবাই বিলকে কেন্দ্র করে এ জনপদের মানুষের জীবনযাত্রা। সব মৌসুমে আছে এ বিলের ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র। জবাই বিলে যার জমি আছে, চোখ বুজে বলে দেওয়া যায় তিনি একজন সুখী কৃষক। মৌসুমজুড়েই তার ঘরে পৌঁছায় বিলের আশীর্বাদ।
পানিতে ভেসে থাকার জন্য কলা গাছ অথবা বাঁশ দিয়ে বিশেষ কায়দায় ভেলা বানিয়ে থাকেন। বৃষ্টি শুরু হলে চারপাশের পরিবেশের এক অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। জবাই বিলের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা সরু খাল। বর্ষা মৌসুমের পর বিলের সেই সব সরু খালের কোথাও স্থায়ীভাবে জমে থাকে পানি। বিল তীরবর্তী পাড়াগুলোয় বিভিন্ন রকমের শাক-সবজি চাষ করা হয়। এসব পাড়ার মানুষজন সহজ-সরল প্রকৃতির।
Advertisement
জবাই বিল বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি বৃহৎ ও প্রাচীন বিল। এ বিলে তিন মাস পানি থাকায় প্রাকৃতিকভাবে মাছের প্রজনন ঘটে। বর্ষা মৌসুমে জেগে ওঠে বিলের অপরূপ সৌন্দর্য। তাই জবাই বিলে ঘুরে বেড়ানোর প্রকৃত সময় বর্ষাকাল।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানে শাহ মখদুম বিমানবন্দর যেতে পারবেন। বিমান বাংলাদেশ এবং ইউএস-বাংলা এ রুটে ফ্লাইট কার্যক্রম পরিচালনা করে। রাজশাহী থেকে এরপর নওগাঁ যেতে পারবেন অথবা সরাসরি রাজশাহী থেকে সাপাহার আসতে পারবেন।
এ ছাড়া ঢাকা থেকে হানিফ, শ্যামলী পরিবহনসহ বিভিন্ন জনপ্রিয় পরিবহন সংস্থার এসি বা নন এসি বাস পাবেন নওগাঁ যাওয়ার জন্য। সহজ ও বিডিটিকিটসে অনলাইনে বাসের টিকিট পাবেন। ট্রেনে ঢাকা থেকে সান্তাহার গিয়ে এরপর নওগাঁ যেতে পারবেন। রেল সেবা অ্যাপের মাধ্যমে ট্রেনের টিকিট কাটতে পারবেন। জেলা সদর থেকে সাপাহার উপজেলার দূরত্ব মাত্র ৫৪ কিলোমিটার। সাপাহার উপজেলা সদরে আছে থাকা-খাওয়ার উন্নত মানের হোটেল।
লেখক: স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটক।
এসইউ/জিকেএস