‘একসময় সিনেমা হল ছিল বিনোদনের একটি মাধ্যম। বিশেষ কোনো উপলক্ষে বা বিশেষ ছবি মুক্তি পেলে মানুষ সিনেমা হলে লাইন ধরত। টিকিট পেতেও অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। বিশেষ কোনো দৃশ্য পর্দায় ভেসে উঠলে করতালিতে ভরে যেত পুরো হল। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র মতো জনপ্রিয় ছবিতো মাসের পর মাস চলেছে। সেই সিনেমা হলে এখন দর্শকখরা। নান্টুরাজ সিনেমা হলের মতো বেশিরভাগ সিনেমা হলই তো বন্ধ হয়ে গেছে। আসলে দেশি সিনেমায়-ই তো এখন দুর্দিন চলছে।’
Advertisement
স্মৃতি রোমন্থন করে কথাগুলো বলছিলেন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার বন্দরভিটা গ্রামের বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম। তবে শুধু শরিফুল ইসলামই নয়, তার মতো বেশিরভাগ দর্শকই সিনেমা হলের বর্তমান অবস্থা নিয়ে হা-হুতাশ প্রকাশ করেছেন।
জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৯০-এর দশকের শুরুতে সারা দেশে সিনেমা হল ছিল ১ হাজার ৪৩৫টি। এখাতে ব্যবসায়ও ছিল রমরমা। তবে এখন বাংলাদেশের সিনেমা হলে দুর্দিন চলছে। বর্তমানে কয়েকটি জেলায় হাতেগোনা কয়েকটি সিনেমা হল টিকে রয়েছে। মুষ্টিমেয় যে কয়টি টিকে রয়েছে, তা-ও ধুক ধুক করছে। বেশিরভাগ সিনেমা হল ভেঙে ফেলে সেখানে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, বাড়ি, ভবন, মসজিদ-মাদরাসা বা গোডাউন করা হয়েছে। আর যে কয়টি এখনও টিকে রয়েছে সেখানে দর্শক যান না।
দর্শক, সিনেমা হল মালিক ও সিনেমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় সব সিনেমার একই কাহিনি, প্রযুক্তির ব্যবহার না থাকা, আকাশ সংস্কৃতির দাপট, ইন্টারনেটে সিনেমার সহজপ্রাপ্ততা, বিদেশি সিরিয়ালের জনপ্রিয়তার কারণে সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন দর্শকরা। তারা বলছেন, এখাতে সহজে প্রণোদনা মিললে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশের সিনেমা হল।
Advertisement
দেশের বর্তমান সিনেমা হলের সঠিক পরিসংখ্যান জানতে সম্প্রতি অনুসন্ধান চালায় জাগোনিউজ২৪.কম। জাগো নিউজের ৩০ জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা-উপজেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য বলছে-
২০১১ সাল পর্যন্ত গাজীপুরে ১৮টি সিনেমা হল ছিল। যার বেশিরভাগই এখন বন্ধ। নতুন করে কোনো সিনেমা হল গড়ে ওঠেনি। চুয়াডাঙ্গার ১৪ সিনেমা হলের সবকটিই বন্ধ। বন্ধের পথে ফেনীর একমাত্র সিনেমা হলটিও। একসময় এ জেলায় ছয়টি সিনেমা হল থাকলেও শুধু দুলাল সিনেমা হলটি কোনো মতে খুঁড়িয়ে চলছে।
দুই দশকের ব্যবধানে ভোলায় বন্ধ হয়েছে অন্তত ২২টি সিনেমা হল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চারটি হল চললেও সেগুলো এখন বন্ধের পথে। বন্ধ হওয়া হলের স্থানে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন, মার্কেট, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও দোকানঘর।
সারাদেশের মতো রংপুরেও মুখ থুবড়ে পড়েছে সিনেমা হলগুলো। গত দেড় যুগে অন্তত ২০টি হল পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ৯টি উপজেলায় ১৫টি সিনেমা হল ছিল। সবকটিই এখন বন্ধ।
Advertisement
শহরে চারটি আর ছয় উপজেলায় আটটিসহ মোট ১২টি সিনেমা হল ছিল কুষ্টিয়ায়। ১১টি হল এখন হাঁড়ি-পাতিলের গোডাউন আর কমিউনিটি সেন্টারে রূপ নিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওগাঁ জেলায় ২২টি সিনেমা হল ছিল। এরমধ্যে মাত্র তিনটি টিকে রয়েছে। বাগেরহাট জেলায় সাতটি প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে জেলা শহরের দুটির অস্তিত্ব দৃশ্যমান। লোকসানে পড়ে অনেক বছর ধরে দুটোই বন্ধ রয়েছে।
হবিগঞ্জ জেলার ৮টি প্রেক্ষাগৃহের সবকটিই এখন বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। কোনোটিতে নির্মাণ করা হয়েছে মার্কেট, কোনোটি আবার পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
যশোরের ২২টি সিনেমা হলের মধ্যে টিকে আছে মাত্র ছয়টি। তাও এটি সরকারের হিসাব অনুযায়ী। বাস্তবে টিকে রয়েছে পাঁচটি হল। ময়মনসিংহ জেলার ১৩টি উপজেলায় মোট ৪০টি সিনেমা হল ছিল। এরমধ্যে নিয়মিত চলছে তিনটি সিনেমা হল। এগুলো হলো-জেলা শহরের পুরবী সিনেমা হল, মুক্তাগাছার রানা সিনেমা হল ও ঈশ্বরগঞ্জে সোনালী সিনেমা হল।
নড়াইল জেলার ৪টি সিনেমা হলই বন্ধ হয়ে গেছে দর্শকশূন্যতায়। এমনকি হলোগুলোর অবকাঠামোও ভেঙে ফেলা হয়েছে। সুনামগঞ্জের চারটি সিনেমা হল এখন অন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
নব্বইয়ের দশকে টাঙ্গাইলে সিনেমা হলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫১টি। তবে মাত্র দশ থেকে পনের বছরের মধ্যে দর্শক সংকট, মানহীন ছবি আর সীমাহীন লোকসানের মতো নানা সমস্যায় ৪৬টি সিনেমা হলই বন্ধ করতে বাধ্য হন এর মালিকরা। এরপরও সীমাহীন লোকসান আর নানা শঙ্কা উপেক্ষা করে এ শিল্পকে আজও ধরে রেখেছেন জেলার পাঁচটি সিনেমা হল মালিক।
দর্শক হারিয়ে গেছে ঠাকুরগাঁওয়ের সিনেমা হলগুলো থেকে। জেলার ১৬টি সিনেমা হলের মধ্যে ১৪টি সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। চালু রয়েছে মাত্র দুটি হল। চাঁদপুরের ৯টি হলের মধ্যে এখন অস্তিত্ব আছে মাত্র দুটির।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝালকাঠি শহরের লঞ্চঘাট এলাকার ‘রূপালী’ সিনেমা হলটি প্রায় ২৪বছর আগে, পালবাড়ি খেয়াঘাট এলাকার ‘পলাশ’ সিনেমা হলটি ২১বছর আগে এবং জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ‘মিতু’ সিনেমা হলটি ২০১১সালের পৌর নির্বাচনের সময় বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে ঝালকাঠি জেলায় কোনো সিনেমা হল নেই।
জেলা তথ্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ঝিনাইদহে ১৪ টি সিনেমা হল ছিলো। তবে এগুলো একে একে বস বন্ধ হয়ে গেছে। তবে বর্তমানে ঝিনাইদহ শহরে প্রিয়া সিনেমা হল কোনো প্রকারে নাম মাত্র টিকে আছে।
জয়পুরহাটে এক সময়ের ১৭টি প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে এখন নিভু নিভু করে চলছে একটি। ইতোমধ্যে খুলনার ২০টি সিনেমা হলের মধ্যে ১৭টিই বন্ধ হয়ে গেছে। চালু থাকা বাকি তিনটি হলের প্রদর্শনী চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ফলে খুলনায় দিন দিন সংকুচিত হয়ে পড়ছে রূপালী পর্দার বিনোদন জগত।
লালমনিরহাট জেলার ৫টি উপজেলায় প্রায় ১৫টি সিনেমা হল এখন বন্ধ। ১৫টি সিনেমা হলের মধ্যে ১৩ হল ভেঙে তৈরি হয়েছে একটি শিশু নিকেতন, মার্কেট, ভুট্টা, তামাক ও পাটের গোডাউন।
মানিকগঞ্জে ১২টি সিনেমা হল বন্ধ। এখন টিকে আছে মাত্র একটি। ‘মেহেরপুর হল’ ছাড়া বাকি পাঁচটি সিনেমা হলের অস্তিত্ব নেই মেহেরপুরে। মৌলভীবাজারে মোট আটটি সিনেমা হল চালু ছিল। ছয়টি বন্ধ হওয়ার পর চায়ের রাজ্যে শ্রীমঙ্গলে দুটি জোড়াতালি দিয়ে চলছে।
নোয়াখালীর পাঁচটি সিনেমা হল বন্ধ। একটি চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। মন্সিগঞ্জে নতুন নির্মিত একটি সিনে-কমপ্লেক্সসহ টিকে আছে মাত্র চারটি হল। বাকি ১৬টি হল এখন মার্কেট, কমিউনিটি সেন্টার, অটোরিকশার গ্যারেজ, বহুতল অট্টালিকা ও স-মিলে রূপান্তর হয়েছে। টিকে থাকা চারটি হলও অস্তিত্ব সংকটে।
একসময় রাজবাড়ীতে সিনেমা হল ব্যবসার জৌলুস থাকলেও এখন তা বিল্লুপ্তের পথে। জেলার পাঁচটি উপজেলায় ২০টি সিনোমা হলের মধ্যে এখন নামমাত্র চালু রয়েছে মাত্র তিনটি।
সাতক্ষীরায় ১২টি সিনেমা হল ছিল। বর্তমানে অস্তিত্ব আছে মাত্র ৯টির। লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে ৯টি সিনেমা হলের মধ্যে চালু আছে মাত্র দুটি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খাগড়াছড়িতে মোট সিনেমা হল ছিল ১০টি। তবে বর্তমানে সব হলই বন্ধ রয়েছে।
রাজশাহী ডিসি অফিসের তথ্যমতে, রাজশাহীতে ২৫টি সিনেমা হল ছিল। তবে জাগো নিউজের রাজশাহী প্রতিবেদক জানিয়েছেন, বর্তমানে সবকটি হলই বন্ধ।
এসআর/এমকেএইচ