বিনোদন

রাজশাহীতে নেই কোনো সিনেমা হল

আশির দশক থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ভালোই চলছিল রাজশাহীর সিনেমা হল। তবে ইন্টারনেটের যুগে এসে ঝিমিয়ে পড়ে হল ব্যবসা। ফলে একে একে বন্ধ হতে থাকে রাজশাহীর সব সিনেমা হল।

Advertisement

রাজশাহী জেলায় কাগজে-কলমে হল ছিল ৫৫টি। এখন শিক্ষানগরী খ্যাত রাজশাহী শহরে কোনো সিনেমা হল নেই। তবে জেলাi বিভিন্ন উপজেলায় চারটি সিনেমা হল রয়েছে। এছাড়া নগরীর উপকণ্ঠ কাটাখালীতে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে রাজতিলক নামের একটি হল।

রাজশাহী নগরীর ব্যস্ততম এলাকা অলোকার মোড়। এ নামটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রাজশাহীর সবচেয়ে প্রাচীন সিনেমা হলের নাম।

ব্রিটিশ আমলে নাট্য আন্দোলন এগিয়ে নিতে ভিক্টোরিয়া ড্রামাটিক ক্লাব ‘রাজা প্রমথ নাথ টাউন হল’ নির্মাণ করা হয়। এ অঞ্চলে বাংলা সাহিত্য ও নাট্য চর্চার তীর্থভূমি ছিল হলটি।

Advertisement

১৯১৯ সালের ২ এপ্রিল ভিক্টোরিয়া ক্লাবের কাছ থেকে হলটি কিনে নেয় রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন। ১৯৭১ সালের পর হলটি অ্যাসোসিয়েশনের কাছে ভাড়া নিয়ে অলোকা নাম দিয়ে শুরু হয় সিনেমা প্রদর্শন। নব্বইয়ের দশকে এটি স্মৃতি সিনেমা হল নামে পরিচালিত হতো।

২০০৭ সালে সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ করে ভেঙে ফেলা হয় হলটি। হলের জায়গায় ২০১২ সালে উঠে দাঁড়ায় রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের বাণিজ্যিক ভবন। সেখানে আধুনিক হল নির্মাণের কথা থাকলেও সেটি করা হয়নি।

অলোকার মোড়ে আজ সিনেমা হল না থাকলেও নামটি রয়ে গেছে নগরবাসীর মুখে মুখে। একই দশা নগরীর লিলি, উৎসব ও বর্ণালী সিনেমা হলের।

পাকিস্তান আমলে নগরীর কাদিরগঞ্জ ও আমবাগান এলাকায় বাবুল ও রুবেল চৌধুরী নির্মাণ করেন বর্ণালী সিনেমা হল। ১৩৭৩ আসনের এ হলটি ছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রেক্ষাগৃহ।

Advertisement

২০০৯ সালে সিনেমা হলটি কিনে নেয় ডেসটিনি ২০০০ গ্রুপ। ২০১০ সালে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় হলটি। পরে সেখানে ডেসটিনি ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস সেন্টার নির্মাণকাজ শুরু হয়।

আইনি জটিলতায় বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করতে পারেনি ডেসটিনি গ্রুপ। জায়গাটি এখন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) দখলে। সেখানে অস্থায়ী গ্যারেজ বানিয়েছে রাসিক। এখনো নগরবাসী এলাকাটিকে বর্ণালী মোড় নামেই চেনেন।

এদিকে নগরীর কল্পনার মোড় দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে একসময় সিনেমা হল ছিল। হলের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে আকাশচুম্বী স্বচ্ছ টাওয়ার। এই টাওয়ারের নিচেই চাপা পড়েছে কল্পনা।

ব্রিটিশ আমলে নগরীর আলুপট্টি এলাকায় কল্পনা সিনেমা হল চালু হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় কল্পনার অংশীদাররা সবাই ভারতে পাড়ি জমান। ১৯৭১ সালের পর রাজশাহী সিন্ডিকেটের ম্যানেজার দীনবন্ধু দেশে ফিরে হলটি হস্তান্তর করেন ঢাকার মোশাররফ চৌধুরীর কাছে।

তার মৃত্যুর পর হলের নিয়ন্ত্রণ যায় রাজশাহীর রাজপাড়ার বাসিন্দা আব্দুর রহমানের কাছে। তিনি কল্পনা পরিবর্তন করে নাম দেন ‘উৎসব’।

২০১০ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে উৎসবে প্রদর্শনী বন্ধ করা হয়। সেখানে এখন গড়ে উঠেছে ১৭ তলা বিশিষ্ট টাওয়ার।

নগরীর পশ্চিম প্রান্তে একসময় চলতো লিলি সিনেমা হল। ব্যবসায় লোকসান দিতে দিতে ২০১০ সালে বন্ধ হয়ে যায় লিলি। পরে প্লট আকারে বিক্রি হয় হলের জমি।

একে একে সব হল বন্ধ হলেও টিকে ছিল উপহার হলটি। ২০১৮ সালের ১২ অক্টোবর সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। সাড়ে ২৪ কাঠা আয়তনের এ জায়গায় এখন গড়ে উঠবে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন।

নগরীর সাহেব বাজার স্যান্ডেল পট্টির স্যান্ডেল ব্যবসায়ী নূর আলম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই সিনেমা দেখতে ভালোবাসি। শুক্রবার হলেই দৌড়াতাম বড় পর্দায় সিনেমা দেখতে। একটি নতুন সিনেমাও বাদ দিতাম না। পরিবার নিয়ে, মাঝে মাঝে স্যান্ডেল পট্টির বন্ধু ও সহকর্মীদের নিয়ে অনেক সিনেমা দেখেছি। এখনও দেখি মোবাইলে। তবে হলে সিনেমা দেখার মজা এখন আর পাই না।’

সিনেমা হলের বিলুপ্তি ও রাজশাহীবাসীর চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় রাজশাহী সদর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশার কাছে। তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষের মনকে সঠিক ট্র্যাকে রাখতে সরকারের এদিকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে সিনেমা হল বা সিনেপ্লেক্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’

তিনি বলেন, ‘সিনেমা হল না থাকলে মানুষ নিজের সংস্কৃতি ভুলে যাবে। নতুন করে কোনো শিল্পীও জন্মাবেন না। তাই সিনেমা হল ও শিল্পীদের সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা করা জরুরি।’

তিনি আরও বলেন, তিন বছর আগে রাজশাহীর শেষ সিনেমা হল উপহার ছিল। সেটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে। তখন সেটি না ভাঙার জন্য নিজে উপস্থিত থেকে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ করেছি। এমনকি তার পরিবর্তে রাজশাহীতে চিত্তবিনোদনের বিকল্প হিসেবে সিনেপ্লেক্স নির্মাণেরও দাবি জানিয়েছিলাম।

তিনি যোগ করেন, শুধু সিনেমা হল হলেই সমস্যার সমাধান হবে না। সিনেমার মানোন্নয়নে শিল্প ও শিল্পীদেরও অনেক পরিশ্রমী হতে হবে। নাহলে মানুষ হলমুখী হবে না।

রাজশাহীর জেলা প্রশাসক বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির কারণে লোকজ ও স্থানীয় সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। যাত্রা, পালাগান, নাটক ও সিনেমার যে আবেদন ছিল আজ তা নেই। মূলত আকাশ সংস্কৃতির কারণেই এসব লোপ পেয়েছে’।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সিনেমা তৈরি করতে হবে। আবার প্রেক্ষাগৃহও তৈরি করতে হবে। যেমন- ঢাকায় সিনেপ্লেক্সে গেলে টিকিট পাওয়া যায় না। তারা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। রাজশাহীতেও তাই করতে হবে।’

ভবিষ্যতে রাজশাহীতে সিনেমা হল নির্মাণের পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাজশাহীর বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে একটি সিনেপ্লেক্স তৈরির পরিকল্পনা আছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে সেখানে একটি বড় সিনেপ্লেক্স টাইপের হল রেস্তোরাঁসহ নির্মাণ করা হবে।’

এসএমএম/এমকেএইচ