শিল্প সংস্কৃতির সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত হাওরের রাজধানী সুনামগঞ্জ। স্বাধীনতার অনেক আগেই এ জেলায় গড়ে ওঠে সিনেমা হল। এরপর একে একে চারটি সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয়। হলকে কেন্দ্র করে আশপাশে গড়ে ওঠে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও।
Advertisement
এক সময় এসব সিনেমা হলে প্রচুর দর্শক টানতে সক্ষম হলেও কালের বিবর্তন ও আকাশ সংস্কৃতির দাপটে দর্শক হারিয়ে বন্ধ হয়েছে সব হলই। এখন দোকানপাট ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এসব সিনেমা হল।
সুনামগঞ্জে আদী ব্যবসাকে কেন্দ্র করে পশ্চিম বাজারে ১৬৬১ সালে দ্বিতীয় তলা বিশিষ্ট প্রথম সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয়। যৌথভাবে সিনেমা হলটি চালু করেন শহরের ষোলঘরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নবাব মিয়া ও শহরতলীর পূর্ব ইব্রাহিমপুরের বাসিন্দা নছর মিয়া। নবাব মিয়ার মেয়ে দিলরুবার নামে হলের নামকরণ করা হয়েছিল ‘দিলরুবা’ সিনেমা হল। প্রথম ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল ‘চন্দ্রলেখা’। এতে বিশেষ, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি মিলে মোট আসন ছিল প্রায় ৪০০টি।
একপর্যায়ে নবাব মিয়া ও নছর মিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে বেশ কিছুদিন হলটি বন্ধ থাকে। পরে শহরের গণ্যমান্যদের মধ্যস্থতায় নছর মিয়া এর শতভাগ মালিকানা কিনে নেন। নতুন করে নিজের মেয়ের নামে নামকরণ করেন ‘নূর জাহান’ সিনেমা হল। নছর মিয়া দীর্ঘদিন সিনেমা হলটি চালান।
Advertisement
পরে তার উত্তরাধিকারীরা ১৯৯২ সালে সুনামগঞ্জ শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সেলিম গনীর কাছে বিক্রি করে দেন হলটি। তিনি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ‘মিতারা’ নামটি সংগ্রহ করেন। এরপর ‘মিতারা’ সিনেমা হল নামকরণ করে নুতনভাবে চালু হয়।
সেলিম গনী মারা যাওয়ার পর ঢাকার এক ব্যবসায়ী কিছু দিন হলটি ভাড়ায় চালান। কিন্তু দিন দিন দর্শক কমে যাওয়ায় ২০১১ সালে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায় মিতারা। মিতারা হলের সামনের একটি অংশে এখন হোটেল ও ভেতরের অংশে জনতা ট্রেডার্স নামে একটি রড, সিমেন্ট, টিনের দোকান রয়েছে।
শুধু নবাব মিয়া ও নছর মিয়াই নয়, ব্রিটিশ আমলে শিল্পনগরী ছাতকের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উত্তরপাশে স্থানীয় তিন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ছাতক স্টকিজ’। এ হলটি খুব লাভজনক ছিল। কিন্তু ভ্যাট ট্যাক্স নিয়ে ঝামেলার কারণে এক সময় সরকারের মালিকানায় চলে যায়।
পরবর্তীতে সরকারের কাছ থেকে হলটি কিনে নেন ছাতকের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পিযুষ কান্তি দাস ওরফে পিকে দাস। তিনি দীর্ঘদিন হলটি চালু রাখেন। পরে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে হলটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেন তার ছেলে শংকর কুমার দাস। হল ভেঙে মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘মনিকা প্লাজা’। সিলেটের লালকুটি ও রংমহল সিনেমা হলে দীর্ঘদিন ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বপালনকারী দিরাই উপজেলার পেরুয়া গ্রামের সাধু রায় ১৯ দশকে দিরাই শহরের হারনপুর রোডে ‘জনপ্রিয় সিনেমা হল’ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর পৌর এলাকা দউজের বাসিন্দা ব্যবসায়ী অনন্ত রায় ২০০০ সালে কলেজ রোডে স্ত্রীর নামে ‘মণি সিনেমা হল’ প্রতিষ্ঠা করেন। জনপ্রিয় এ সিনেমা হলটি দীর্ঘদিন চলার পর বন্ধ হয়ে যায়।
Advertisement
তবে সাধু রায় নিজের সিনেমা হল বন্ধ করে দেয়ার পর কলেজ রোডের অনন্ত রায়ের মণি সিনেমা হলটি কিছুদিন ভাড়ায় চালিয়েছেন। ২০১৩ সালে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায় হলটিও। দিরায়ের দু’টি সিনেমা হলের জায়গায় এখন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে।
সুনামগেঞ্জের প্রবীণরা জানান, এক সময় প্রতিটি সিনেমা হলে নতুন ছবি দেখতে দর্শকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। শহরে ছায়াছবির পোস্টারিং করা হত, নানা শব্দে, নানা ঢংয়ে ও বিচিত্র সূরে সিনেমার কাহিনী মাইকিং করা হত। দর্শকদের জানানো ও আকর্ষণ বাড়াতে নানা ব্যবস্থা করতেন হল মালিকরা। নতুন ছবি মুক্তির পর সিনেমা প্রেমীরা অপেক্ষায় থাকতেন দেখার জন্য।
তারা আরও জানান, শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পোস্টার দিয়ে দর্শকদের জানানো হতো অমুক সিনেমা হলে চলিতেছে রাজ্জাক-কবরি অভিনীত অমুক ছবি। সিনেমা হলগুলোর আশপাশের দেয়ালে সাঁটানো হতো নতুন ছবির পোস্টার। সিনেমা হলগুলোর আশপাশ এলাকা দুপুরের পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত জমজমাট থাকত। শো শেষ হওয়ার পর দল বেধে মানুষ যখন রাস্তা দিয়ে যেত তখন মিছিলের মত দেখা যেত। এসব স্মৃতি এখন শুধু অতীত।
সুনামগঞ্জের মিতারা হলের কেয়ারটেকার সতেন্দ্র তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘দর্শক কমে যাওয়ায় মিতারা হলটি বন্ধ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন এটি তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল। জনতা ট্রেডাস নামের এক প্রতিষ্ঠানকে হলটি ভাড়া দেয়া হয়েছে।
দিরাই কলেজ রোডের মণি সিনেমা হলের অনন্ত রায়ের ছেলে শংকর দাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘বড় পর্দায় সিনেমা দেখার মজাই আলাদা ছিল। বন্ধু-বান্ধবরা মিলে দল বেধে ছবি দেখতে হলে আসতো। আগের ছবিগুলো সমাজ উন্নয়নের হাতিয়ার ছিল। প্রতিটা সিনেমায় একটা বিষয় তুলে আনা হত। পরে ধীরে ধীরে বাংলা ছবিতে অশ্লীলতা ঢুকে পড়েছে ও দর্শকও কমে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিমেনা হলের ব্যবসাটা একটা ঝামেলার। লাভের হিসাবের চেয়ে সরকার ভ্যাট-ট্যাক্স বেশি দাবি করে। দর্শক দিনে দিনে কমেছে। সিনেমা চালিয়ে যে টাকা পাওয়া যায় ঘরভাড়া দিয়েও প্রায় সেই টাকা পাওয়া যায়। নানাকারণে দেশের জেলা উপজেলা পর্যায়ে সব সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে।’
এক সময় হলে ছবি দেখতেন পাপড়ি বেগম। হল না থাকায় এখন আর যাওয়া হয় ন। কিন্তু এখনো ভোলেননি ছবি দেখতে যাওয়ার সেই দিনগুলো।
পাপড়ি বেগম বলেন, ‘আগে সবার ঘরে টিভি ছিল না, আমরা হলে ‘রসের বাইদানী’, ‘শিমুল পারুল’সহ অনেক ছবি দেখেছি। কিন্তু এখন ঘরে টিভি, হাতে হাতে মোবাইল তাই সিনেমা হলের কথা সবাই ভুলে গেছে। তবে আমি সিনেমা হলে বসে ছবি দেখার সেই দিনগুলোকে খুব মিস করি।’
পূর্ব ইব্রাহিমপুরের বাসিন্দা এশা বিবি জাগো নিউজকে বলেন, ‘পরিবার না জানিয়ে লুকিয়ে দুইবার হলে ‘কমলা সুন্দরী’, ‘সুজন সখী’ ছবি দেখেছি। একবার আব্বা জানতে পেরে খুব রেগে যান। পরে আম্মা আব্বার কাছ থেকে আমাকে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু বদলে গেছে।’
সুনামগঞ্জ রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি বিন্দু তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘সুনামগঞ্জ হচ্ছে হাওরের জেলা। এখানে কোনো বিনোদন কেন্দ্র নেই। যাও চারটি সিনেমা হল ছিল সেগুলোও বন্ধ। যদি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সিনেমা হল চালু হতো তাহলে সুনামগঞ্জের অনেক ধরনের অপরাধ কমে যেত।’
লিপসন আহমেদ/এসজে/এএসএম