বিনোদন

ধুঁকে ধুঁকে চলছে নওগাঁর ৩ সিনেমা হল

একসময় বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল চলচ্চিত্র। নতুন বাংলা সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর পরই মানুষ ছুটে যেত হলে। তখন পরিবার-পরিজন নিয়ে দল বেধে হলে যাওয়া হতো।

Advertisement

ঈদ-পূজা, পালা-পার্বণে গ্রাম ও শহরের মানুষ হলের সামনে লাইন ধরে থাকতো পছন্দের সিনেমার টিকিট কাটার জন্য। সেসময় বিনোদনের জায়গা হিসাবে সিনেমা হলগুলোর ব্যাপক কদর ছিল। তবে বর্তমানে টিভি আর ডিভিডির সময়ে বাড়ির বৈঠকখানা ও চা স্টলই সিনেমা হল।

বাংলা সিনেমার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে কমেছে সিনেমা হলের সংখ্যা। এর ধারাবাহিকতা নওগাঁর সিনেমা হলগুলোতেও দেখা যায়। হলগুলোর মধ্যে টিকে আছে মাত্র তিনটি। তবে করোনা মহামারিতে গত এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে সেগুলো।

জানা গেছে, জেলার ১১টি উপজেলায় ২২টি সিনেমা হল ছিল। হলগুলো হলো- নওগাঁ সদরে তাজ, মুক্তি ও রুবি সিনেমা হল, রানীনগরে শাহী সিনেমা হল, আত্রাইয়ে শাপলা সিনেমা হল, বদলগাছীতে শাহিন ও স্মৃতি সিনেমা হল, মহাদেবপুরে বুলবুল টকিজ ও আত্রাই টকিজ, মান্দায় আশা, ফাইভ স্টার ও চলন্তিকা সিনেমা হল, পত্নীতলায় রংধনু, রাসমনি ও বিনোদন সিনেমা হল, ধামইরহাটে পারভীন ও মল্লিকা সিনেমা হল, নিয়ামতপুরে পালকি সিনেমা হল, পোরশায় রজনীগন্ধ ও মিতালী সিনেমা হল এবং সাপাহারে উল্লাস ও নসীব সিনেমা হল।

Advertisement

এরমধ্যে সদরে তাজ, মান্দারে ফাইভ স্টার ও পত্নীতলায় রংধনু সিনেমা হল টিকে রয়েছে।

নতুন বাংলা ছবি মুক্তি পেলে মানুষ টিকিটের জন্য লাইন ধরতো হলে। হলগুলোতে রূপবান, বেদের মেয়ে জোসনা, রাঙা ভাবি, খায়রুন সুন্দরী, কমলার বনবাস, কাসেম মালার প্রেম, ঝিনুক মালা, রাখাল বন্ধু, গরীবের সংসার, ভাত দে, অবুঝ মন, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা প্রভৃতি সিনেমা দেখানো হতো। এসব সিনেমা গ্রাম বাঙলার মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে দেখতো। এমন প্রথাও চালু হয়েছিল যে, নতুন জামাই শ্বশুরবাড়ি গেলে বউ ও শ্যালক-শ্যালিকাদের নিয়ে সিনেমা দেখতে যেতেন। কিন্তু সেদিন আর নেই।

২০১০ সালের পর থেকে জেলার সিনেমা হলগুলোতে মন্দার ভাব শুরু হয়। একে একে বন্ধ হতে থাকে সেগুলো। একসময়ের রমরমা সিনেমা হলের অনেকগুলোই এখন ব্যবহৃত হচ্ছে স্কুল ভবন, কমিউনিটি হাসপাতাল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গোডাউন হিসেবে।

২০২০ সালে শহরের মুক্তি সিনেমা হল ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে তৈরি করা হবে ভবন। এছাড়া ঐতিহ্যবাহী রুবী সিনেমা হলটি ভেঙে তৈরি করা হয়েছে কয়েকটি কমিউনিটি সেন্টার।

Advertisement

দর্শকের অভাবে লোকসান গুনতে গুনতে বন্ধ হয়ে গেছে সিনেমা হল। আর শত শত কর্মচারী হয়ে পড়েছে বেকার। পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন তারা।

সরকার থেকে ২০১৮ সালে সিনেমা হলগুলোকে আধুনিক করতে উদ্যোগে নেয়া হলেও পরবর্তীতে সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি।

নওগাঁ তাজ সিনেমা হলের মালিক পরিতোষ সাহা বলেন, ২০১০ সাল পর্যন্ত তাজ সিনেমা হল ভালোই চলছিল। এরপর ধীরে ধীরে এটি লোকসানের মুখে পড়ে। পরিচালকরা চাহিদা অনুযায়ী চলচ্চিত্র তৈরি করতে পারছেন না। ভালো সিনেমার অভাবে দর্শকের উপস্থিতি একেবারে নেই বললেই চলে। এরপর করোনা ভাইরাসের কারণে একবছর থেকে শো চালানো বন্ধ রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং পরিচালক সমিতি থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকার সহায়তার জন্য আশ্বাস দেয়া হয়েছে। যে কয়টি হল আধুনিকায়ন করা হবে তারমধ্যে তাজ হলের নামও আছে। আমরা সরকার ও প্রযোজক সমিতির দিকে তাকিয়ে থেকে দিনের পর দিন লোকসান দিয়ে হল চালু রেখেছি।

তাজ সিনেমা হলের কর্মচারী রিপন বলেন, প্রায় ১৭ বছর ধরে চাকরি করছি এখানে। একসময় সিনেমা হল খুবই জাকজমকপূর্ণ ছিল। ভালো ছবি দেখার জন্য দর্শকরা ভিড় করতো। তবে আগের মতো আর হল চলে না। আয়ও গেছে কমে।

মহাদেবপুরের বুলবুল টকিজের মালিক ইকবাল বিশ্বাস বলেন, ভালো ছবির অভাবে ২০১৪ সালে হলটি বন্ধ করা হয়। যন্ত্রাংশগুলো বাড়িতে রাখা হয়েছে। ক্যাবল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোনে সহজেই সিনেমা দেখা যাওয়ায় দর্শক নেই হলে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে চলচিত্র এক নায়ক কেন্দ্রিক (শাকিব খান) হয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে মানসম্মত সিনেমাও তৈরি হয়নি। ভালো ছবি না থাকায় দর্শকরা হলে আসতে চায় না। অনেক লোকসানে পড়তে হয়েছে। হলটি এখন গুদাম ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

মান্দার দেলুয়াবাড়ী বাজারে চলন্তিকা সিনেমা হলের সহকারী ম্যানেজার তানভীর আহমেদ লিটন বলেন, আশির দশকে হলটি নির্মাণ করা হয়েছিল। আমি ২০০৮-১৪ সাল পর্যন্ত হলের সহকারী ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলাম। সেসময় দিনে চারটি শো হতো। টিকিট বিক্রি হতো ১৫-৩০ টাকায়। হলে সুস্থ ধারার সামাজিক ছবি চলতো। প্রচুর দর্শক আসতো।

২০১৪ সালের পর সিনেমা হলটি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। হলটি এখন পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে বলে জানান তিনি।

কমিউনিস্ট পার্টি নওগাঁ জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট মহসিন রেজা বলেন, সুস্থ বিনোদন সুস্থ সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সরকারি নানা উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা আবারও হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারি। সরকারি অনুদান দিয়ে পরিচালকদের কাছ থেকে ভালো সিনেমা বের করে আনতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বার্ণিজ্যিকভাবে সফল হওয়ার জন্য সিনেমা হলের ওপর ট্যাক্স কমাতে হবে। হল ব্যবসায়ীদের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ট্যাক্সবিহীন ব্যবসা করার সুযোগ দিতে হবে। এছাড়া তৈরি করতে হবে ভালো সিনেমা। এতে করে সাধারণ মানুষ আবারও হলমুখী হবে।

নওগাঁ জেলা তথ্য অফিসার আবু সালেহ মো. মাসুদুল ইসলাম বলেন, একসময় সিনেমা হলে দর্শকদের উপচে পড়া ছিল। বর্তমানে অল্প সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। এছাড়া গল্পগুলো মানসম্মত ও আর্কষণীয় না। এখন হলগুলোতে সিনেমা দেখার তেমন পরিবেশও নেই।

তিনি আরও বলেন, ভালো মানের ছবি না হওয়ায় দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে হল থেকে। আগে যখন ক্যাবল নেটওয়ার্ক ছিল তখনও ফাইট করে সিনেমা হলগুলো চলেছে। কিন্তু বর্তমানে ইন্টারনেট যুগে সিনেমা অনেক সহজলভ্য হয়ে গেছে। ভারতে সিনেমা হলগুলো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। কিন্তু আমাদের দেশের হলগুলো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না।

আব্বাস আলী/এসএমএম/এমএস