ডা. সেলিনা সুলতানা
Advertisement
‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি দিবস। যা প্রতিবছর ২ এপ্রিল পালিত হয়। জাতিসংঘ ও তার সদস্য দেশগুলো অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (এএসডি) আক্রান্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এ দিনটি পালিত হয়। ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ প্রস্তাবটি ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাস হয়েছিল। সেটি গৃহীত হয়েছিল একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর।
২ এপ্রিল, ১৪তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। অটিজম বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হয়। প্রতিবছর এ উপলক্ষে বিভিন্ন কনফারেন্স, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। একটা সময় ছিল যখন অটিজম একটি অবহেলিত জনস্বাস্থ্য ইস্যু। এ সম্পর্কে সমাজে নেতিবাচক ধারণা ছিল অনেক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সাইকোলজিস্ট সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নিরলস প্রচেষ্টায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অটিজম বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুলাংশে। তিনি ২০০৭ সাল থেকে এ বিষয়ে দেশে কাজ শুরু করেন সফলভাবে। সায়মা ওয়াজেদ এ অবহেলিত জনস্বাস্থ্য ইস্যুতে বিরাট অবদানের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতিও পেয়েছেন।
Advertisement
অটিজম শিশুদের বিকাশজনিত একটি সমস্যা যা সাধারণত শিশুর জন্মের প্রথম তিন বছরের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা সাধারণত অপরের সঙ্গে ঠিকমতো যোগাযোগ করতে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই একটি শিশু জন্মের পর সে অন্যের সঙ্গে বা তার চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। সে জায়গায় অটিজম আক্রান্ত শিশুটির সমস্যা থাকে। সামাজিক যোগাযোগে ও তাদের সমস্যা হয়, নিজেকে বিচ্ছিন্ন ও গুটিয়ে রাখার মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে থাকে।
অটিজমের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে গবেষকরা মনে করেন, জেনেটিক, নন-জেনেটিক ও পরিবেশগত প্রভাব সমন্বিতভাবে অটিজমের জন্য দায়ী হতে পারে। তবে এগুলো এখনো গবেষণার পর্যায়েই রয়েছে। শিশুর বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে এ ধরনের সমস্যা গুলো আসে। এ পর্যন্ত পরিচর্যাই এর একমাত্র বিকল্প বলে মনে করা হয়, সেটা পারিবারিক, সামাজিক- সবভাবেই হতে পারে।
বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক শিশু অটিজমে আক্রান্ত। এরই মধ্যে এ সম্পর্কে পিতা-মাতা, পরিবার-পরিজন ও সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের চিকিৎসা ও যথার্থ পরিচর্যার জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক বাণী দিয়ে থাকেন প্রতিবছর। তারা সবসময়ই সরকারের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার আক্রান্তরা অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে জীবন-যাপন করেন।
Advertisement
বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে তাদের কল্যাণে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য প্রতিবন্ধী ভাতা ও প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে অনেক আগে থেকেই। অটিস্টিক শিশু-কিশোরদের সম্ভাবনাগুলোকে চিহ্নিত করে সঠিক পরিচর্যা, শিক্ষা ও স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তোলা উচিত। তারাও পারে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা না হয়ে অপার সম্ভাবনা বয়ে আনতে।
কোভিড-১৯ মহামারিতে শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থানসহ সবখানে এক ধরনের সংকট। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভোগান্তি ও চ্যালেঞ্জটা অন্যদের চেয়ে আরও বেশি। কোভিড-১৯ মহামারি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উপর বৈষম্যমূলক অবস্থার আরো অবনতি ঘটিয়েছে। একইসঙ্গে সমাজে বিদ্যমান অসমতার চিত্রটি আরো প্রকটভাবে তুলে ধরেছে। করোনা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনমানের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে; তা বিগত কয়েক দশকেও দেখা যায়নি।
তাই তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া এবং বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বরাদ্দ রাখার তাগিদ আসছে সবার আগে। প্রয়োজনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রণোদনার আওতায় আনতে হবে। করোনাভাইরাসের টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অগ্রাধিকার দিতে হবে- প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষায় এসব অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। করোনা একটি জরুরি পরিস্থিতি।
তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আলাদা উদ্যোগ, বরাদ্দ ও প্রণোদনা থাকতে হবে। প্রতিবন্ধকতার ধরন অনুযায়ী কতজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কোন ধরনের সহায়তা প্রয়োজন, তা চিহ্নিত করতে হবে সর্বপ্রথমে। করোনাকালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এসব উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে, কমিউনিটি পর্যায় থেকে শহর পর্যন্ত।
দেশে করোনার টিকা এসে গেছে, তা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের তালিকায় বয়স্ক ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরও রাখতে হবে। গুরুতর প্রতিবন্ধকতার শিকার ব্যক্তিরা ফিজিওথেরাপিসহ বিভিন্ন সেবা যাতে বাড়িতে বসেই পেতে পারেন, সে ব্যবস্থাও নিতে হবে। এসব বাস্তবায়নের জন্য সরকারের পাশাপাশি আধা-সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে কতজন এ পর্যন্ত করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন, তার সঠিক তথ্য জানার চেষ্টা করতে হবে, সারা দেশে যে সংগঠনগুলো কাজ করছে, তাদের কাছ থেকে সংক্রমিত ব্যক্তিদের তথ্য নিয়ে একটি পরিসংখ্যান তৈরি করা উচিত। এমন একটা পরিসংখ্যান থাকাটা খুবই জরুরি। এক বছর ধরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুনর্বাসনসহ সব ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন।
অন্য সময়ের তুলনায় ঝুঁকিটাও এবার বেড়েছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের পড়ালেখা প্রায় বন্ধ গ্রামপর্যায়ে। শহর কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা করোনা পরিস্থিতি সামলে উঠে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। যা এখনো গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। এদের বড় অংশই ঝরে যেতে পারে। তাদেরকে হয়তো আর স্কুলে ফেরানো সম্ভব নাও হতে পারে। করোনাকালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরেও নজর দেয়া জরুরি হয়ে গেছে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কেউ করোনায় সংক্রমিত হলে তাকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনার জন্য হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে আলাদা বুথ বা বিশেষ ব্যবস্থা করলে ফলাফল আশাব্যঞ্জক হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বাস্তবায়নের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা করোনা পরিস্থিতিতে আবার বিশ্লেষণ করে তা বাস্তবায়নে বিশেষ বরাদ্দ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। অনলাইনে শিক্ষা, ডিজিটাল জ্ঞান এসবের মাধ্যমে কীভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবা দেওয়া যায় বা কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে।
জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদা, প্রয়োজন ও অধিকার- এ তিন বিষয় মাথায় রেখে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে অগ্রসর হতে হবে। পরিকল্পনায় প্রতিবন্ধীদের মধ্যে নারী, শিশু বা সমাজে অগ্রহণযোগ্য যারা আছেন, তারা যাতে কোনোভাবেই পরিকল্পনা থেকে বাদ না পড়ে, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর পাশাপাশি বেসরকারি ও উন্নয়ন সংগঠনগুলোর কাজের মধ্যেও সমন্বয় বাড়াতে হবে। তাদের মধ্যে জবাবদিহিতা ও বাড়াতে হবে।
বিভিন্ন আইন ও নীতিতে জরুরি পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা আছে। তবে এসব আইন ও নীতির বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ। স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারের কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির তথ্য নির্দিষ্টভাবে সংরক্ষিত করা উচিত। এ ছাড়াও ত্রাণ কার্যক্রমের পাশাপাশি করোনা পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রমেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও সংগঠনকে সম্পৃক্ত করা জরুরি।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বিষয়ক উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন কমিটিকে সক্রিয় করা ও তাদের জবাবদিহিতা বাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এরকম অঙ্গীকার গুলোই আশা করছেন ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ এ যাদের প্রতিবন্ধকতা আছে, তারা ও তাদের পরিবার।
‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব অটিজমে আক্রান্ত শিশু কিশোর, অটিস্টিক ব্যক্তি, তাদের পরিবার ও পরিচর্যাকারীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
লেখক: কনসালটেন্ট, চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট এন্ড পেডিয়াট্রিক; স্পেশালিস্ট ইন নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার এন্ড অটিজম, বেটার লাইফ হসপিটাল।
জেএমএস/এমএস