মঙ্গলবার সকালে স্থানীয় হাটে ধান বিক্রি করতে আসা বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার হরিণগাড়ী গ্রামের কৃষক মফিজ উদ্দিন (৬৫) বলেন, উৎপাদন খরচ ও ১২শ টাকা বিঘায় কামলা দিয়ে জমিত থেকে ধান ঘরত তুলনু। কিন্তু হাটত আসা যে দাম শুনিচ্চি তাতে তো হামাকেরে মণত (প্রতি মণ) ২০০ থ্যাকা ২৫০ ট্যাকা লস হবি। তালে আপনিই কন খুশি হমু ক্যাংকা করে। ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় উৎপাদন খরচের চেয়ে প্রায় অর্ধেক দামে বাজারে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষককে। ফলে ধান বিক্রি করে কৃষকের খরচ তো উঠছেই না উল্টো লোকসান হচ্ছে। সরকারি হিসাবে প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ ৮০০ টাকা। আর বাজারে প্রতি মণ ধান গড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। প্রতি মণে কৃষকের লোকসান হচ্ছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। প্রতি বিঘায় গড়ে ১৫ থেকে ১৮ মণ ধান উৎপাদিত হচ্ছে। এ হিসাবে ধান চাষ করে প্রতি বিঘায় কৃষকের লোকসান হচ্ছে ৫ হাজার টাকা থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা।একই হাটে আসা ভাতহান্ডা গ্রামের কৃষক জিল্লুর রহমান (৩৫) বলেন, ইংকা করে চলবার থাকলে হামরা মারা পড়মু। লাভ না হোক অন্তত্য খরচের ট্যাকা তো উটপি। হামরা কার কাছে কমু এগলা কতা।বগুড়ার শেরপুর উপজেলার মীর্জাপুর ইউনিয়নের ভাদড়া গ্রামের কৃষক উজ্জ্বল শেখ বলেন, তার জমির ধান পেকে গেছে। ইচ্ছে করে দেরি করলেও এখন আর জমিতে ধান রাখা যাবে না। এ কারণে দু`একদিনের মধ্যে তিনি ধান কাটা শুরু করবেন। গেল হাটবারে স্থানীয় মীর্জাপুর বাজারে সাড়ে পাঁচশ` থেকে ৫২০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি হয়েছে। এবার এই দামে ধান বিক্রি করলে তার মণে ২০০ টাকা করে ক্ষতি হবে। এজন্য ইচ্ছে করেই ধান কাটতে দেরি করলেন। এখন দেখা যাচ্ছে যত সময় যাচ্ছে ততই দাম কমে যাচ্ছে।তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সরকার চালের দাম নির্ধারণ করে দিলেও কোনো মৌসুমেই তারা ফড়িয়াদের কারণে ধান থেকে চাল তৈরি করে বিক্রি করতে পারেন না। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধান চাষের আগে অনেকেই দাদন বা চড়া সুদে ঋণ নিয়েছেন। দাম কম থাকায় এখন কৃষক ধান বিক্রি করেও আগের ঋণ শোধ করতে পারছেন না। তার উপর সংসারের খরচ তো আছেই। আবার নতুন করে চাষের সময় চলে এসেছে। এ সময়ে আগের ঋণ পরিশোধ না করতে পারলে নতুন ঋণ পাওয়া যাবে না। ফলে আগামীতে অর্থ সঙ্কটের কারণে জমি চাষ করাও কঠিন হয়ে পড়বে। যার কারণে কৃষক এখন হতাশাগ্রস্ত। বগুড়ার শেরপুর, নন্দীগ্রাম, দুপচাঁচিয়া ও আদমদীঘি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে ধানের দাম কম থাকায় মাঠের ধান কেটে মাড়াই করে বাড়িতে নিতেও অনেকের আগ্রহ কম। কেননা ধান কাটতে দিনমজুর প্রতি দিনে খরচ হচ্ছে ৫০০ টাকা। এক বিঘার ধান কাটতে ও মাড়াই করতে খরচ হচ্ছে প্রায় ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। এসব খরচ মিটিয়ে বাজারে যে দামে ধান বিক্রি করা হচ্ছে তার চেয়ে মাঠের ধান মাঠে থাকাই ভালো বলে মনে করছেন তারা।হাট ঘুরে দেখা গেছে, বাম্পার ফলনে কৃষকরা সর্বস্বান্ত হলেও মোটা অঙ্কের মুনাফার পরিকল্পনা করেছেন মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া ও মিলাররা। তারা কম দামে কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে তা চালে রূপান্তর করে চড়া দামে সরকারের কাছে বিক্রি করবে। খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে সরকারের আমন চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হবে ১৫ ডিসেম্বর থেকে। এ কার্যক্রম চলবে ২০১৬ এর ১৫ মার্চ পর্যন্ত। এই কার্যক্রমের আওতায় এবার ৩১ টাকা কেজি দরে ২৪ হাজার ৫৫৬ মে. টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই হিসেবে সরকারি প্রতি মণ চালের ক্রয় মূল্য হচ্ছে ১২৪০ টাকা।দুপচাঁচিয়ার এক কৃষক মাঠে তার বিনা-৭ জাতের ধানের ক্ষেত দেখিয়ে বলেন, এই বারের লাকান ফলন হামি গত ৩০ বছরেও দেকিনি। ঠিক মতোন বৃষ্টি ও সার পাওয়ার কারণে হামাকেরে এতো ভালো ফলন হচে। কিন্তু এখন বাজারত বিনা ধানের দাম ৫৫০ থেকে ৫৬০ ট্যাকা। কি করমু কন। ৬’শ ট্যাকা না বেচলে চলমু ক্যাংকা করে। কৃষকরা জানান, আমন উৎপাদনে খরচ অনেক কম। কারণ বোরোর মতো বেশি সার দিতে হয় না, সেচও কম লাগে। এক মণ বোরো ধান উৎপাদন খরচ যেখানে সাড়ে সাতশ` টাকার উপরে পড়ে এই ধানে সেখানে খরচ পড়ে ৫’শ থেকে সাড়ে ৫’শ টাকার মধ্যে। তবে ধান কাটার সময় শ্রমিক সঙ্কট এবং মজুরি বেশি হওয়ার কারণে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়। আর ভরা মৌসুমে যখন ধানের প্রচুর আমদানি হয় তখন হাটগুলোতে মূল্য পতনের সম্ভাবনাও থাকে বেশি।কৃষক আরও জানান, প্রতি বছরই তারা ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ বছর পরিস্থিতি আরও খারাপ। কারণ ভারতীয় চালে দেশ সয়লাব হয়ে গেছে। সরকারের শুল্কমুক্ত সুবিধার সুযোগ নিয়ে চাহিদা বিবেচনা না করেই লাখ লাখ টন ধান ভারত থেকে আমদানি হয়েছে। শেষ সময়ে চাল আমদানির ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হলেও এর মধ্যে চাহিদার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আমদানি হয়েছে। আরও চাল আসছে। ফলে এখন শুল্ক আরোপ করেও খুব বেশি লাভবান হওয়া যাবে না।বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, এবার জেলায় ১২টি উপজেলাতে আমন ধানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৮৪ হাজার ৯৩৭ হেক্টর। আর অর্জন হয়েছে ১ লাখ ৯৪ হাজার ৬৫৫ হেক্টর জমিতে। আর এই পরিমাণ জমিতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৯১ হাজার ৪৯৪ মেট্রিক টনের। পুরোদমে ধান কাটা শুরু না হলেও তারা আশা করছেন এই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে উৎপাদন দাঁড়াবে সোয়া ৫ লাখ মেট্রিক টনে। তাদের গবেষণা অনুযায়ী প্রতি বিঘায় এবার গড় ফলন এসেছে ১৫ থেকে ১৬ মণ করে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক চন্ডিদাস কুন্ডু বলেন, মাঠের মাত্র ২৫ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। এখনো পড়ে আছে বেশির ভাগ ধান। তিনি বলেন, বাজারে এখন ব্রি-৪৯ জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে বেশি। সব জাতের ধান আসলে বাজার দর ঠিক হয়ে যাবে।বেশ কয়েকটি হাট ঘুরে দেখা গেছে, গত বছরের এই সময়ের চেয়ে এবার কৃষকরা ধান বিক্রি করে প্রতি মণে প্রায় ১শ টাকা কম পাচ্ছেন। দুপচাঁচিয়ার ধাপসুলতানগঞ্জ ধানের হাটে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রজাতির আমন ধানের মধ্যে রনজিত ৬১০ থেকে ৬১৫, মামুন স্বর্ণা ৫৪০ থেকে ৫৫০ ও বিনা সেভেন ৫৫০ থেকে ৫৬৫ টাকা দরে কেনাবেচা হচ্ছে। এসএস/আরআইপি
Advertisement