বিশেষ প্রতিবেদন

১৪ দলে ‘পাওয়া না পাওয়ার ক্ষোভ’

২৩ দফার ভিত্তিতে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত হয় ১৪ দলীয় জোট। যার মধ্য দিয়েই মূলত ক্ষমতারোহন। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় দলের মতো জোটেও দেখা দিয়েছে মৃদু দ্বন্দ্ব। ফুটে উঠছে পাওয়া না পাওয়ার ক্ষোভ। যদিও এটিকে জোট নেতারা সহজভাবেই নিচ্ছেন। এ ক্ষোভ দিন দিন পুঞ্জীভূত হয়ে জোটের ঐক্যে সমস্যা তৈরি হয় কিনা, ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন।

Advertisement

সম্প্রতি ১৪ দলের একাধিক সভায় নেতারা নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ নিয়ে জোটের শীর্ষ নেতারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টাও করেছেন বলে জানা গেছে। সুরাহা হয়েছে কিনা, নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

গত ২৯ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আলোচনায় ১৪ দল নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে আসন বণ্টন ও বিদেশি অতিথিদের সঙ্গে ১৪ দল নেতাদের সাক্ষাতে সবাইকে নেয়া হয়নি।

এতে জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মুজিব চিরন্তরী অনুষ্ঠানে আমাদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। তবে রাজনীতিবিদদের অবহেলা করা হয়েছে। তাদের প্রবেশ থেকে আসন বিন্যাস যথাযথ ছিল না। জাতীয় রাজনৈতিক নেতারা অবহেলার শিকার হয়েছেন।’

Advertisement

একই বৈঠকে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। কিন্তু আমরা জানতে পারিনি। আমু ভাই জানিয়েছেন, তারা একটি তালিকা পাঠিয়েছিলেন। এটা নাকি ভারতীয় হাইকমিশন সমন্বয় করেছে। একটি জোটের তালিকা এভাবে সমন্বয় করতে পারে কিনা আমার প্রশ্ন।’

এর আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় ১৪ দলীয় জোটে ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদন নিয়ে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। জোটের এক নেতা এ বিষয়টি অবতারণা করলে কিছুক্ষণের জন্য বৈঠকে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়।

ওই সভায় বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের আহ্বায়ক রেজাউর রশিদ খান বলেন, ‘ভাষা ও স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন আন্দোলনের ফল একক দলবহির্ভূত সাধারণ মানুষের ঘরে ওঠেনি। ১৪ দল মাঝে মাঝে সরব হলেও নীরব থাকে বেশিরভাগ সময়। অনেকবার বিষয়টি ১৪ দল নেতাদের বিভিন্ন সময় বললেও কার্যকর হয়নি। জোটের অভ্যন্তরীণ দলগুলো কীভাবে চলছে, বার বার জানালেও কোনো ফলাফল আসেনি।’

তিনি বলেন, ‘১৪ দলের মধ্যে উপযুক্ত চিন্তা করে প্রত্যেক দলকে জনগণের কাছে পৌঁছাতে সক্ষমতা দানে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সভাপতি (আমির হোসেন আমু) যেন এটি ভালো করে তুলে ধরেন।’

Advertisement

রেজাউর রশিদ খান বলেন, ‘জামায়াতসহ বিভিন্ন দল ও জোট দেশ-বিদেশে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এগুলো করতে তারা সুযোগ পাচ্ছে আমাদের নিজেদের অনেকের কাজের কারণে। ক্ষমতায় থেকে ফুলে ফেঁপে প্রাচুর্যে অনেকে দেশের বাইরে অর্থপাচার করছেন। এগুলো দেখে জামায়াত জোট আরও শক্তিশালী বিরোধিতা করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি ও আমার দল সব সংগ্রামে ছিলাম-থাকবো। তবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের শতভাগ বাস্তবায়ন চাই। ১৪ দলের মধ্যে বঞ্চিত দল ও নেতাদেরর টিকে থাকার নির্দেশনা চাই।’

তার বক্তব্যের পর সভার সঞ্চালক মৃণাল কান্তি দাস বিষয়টি সভাপতির নজরে আনেন। তিনি বলেন, ‘সভাপতি, রেজাউর রশিদ খান শহীদ দিবসের আলোচনায় জোটের অভ্যন্তরীণ বিষয় অবতারণা করেছেন। এ বিষয়ে আপনার কথা থাকলে বলতে পারেন।’এসময় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘থাক। এটি পরে দেখা যাবে।’১৪ দলের আরেক নেতা বলেন, ‘এটি ওভারফোনে বললেই হবে।’

জবাবে আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস বলেন, ‘বার বার নিষেধ করা সত্ত্বেও রেজাউর রশিদ খান সবসময় ভার্চুয়াল মিটিংয়ে এসব কথা বলেন। এগুলো তো আর আমাদের মধ্যে থাকে না। প্রকাশ হয়ে যায়। তাই সভাপতির কিছু নির্দেশনা থাকলে বলার জন্য বলছিলাম।’ জবাবে আমির হোসেন আমু বলেন, ‘আমি শুরুতেই বলেছি। শেষে বক্তব্য দেব।’

১৪ দলের বর্তমান এসব কর্মকাণ্ড ও ক্ষোভ নিয়ে কথা হয় জোটের শীর্ষনেতা ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়ার সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘১৪ দলের ব্যাপারে আমাদর বক্তব্য স্পষ্ট। এই জোট অতীতে অনেক ইতিবাচক কাজ করেছে। কিন্তু এখন সামনে আগাতে হলে নতুন করে চিন্তা করতে হবে।’ তিনি বলেন, যেহেতু অনেক আগেই ১৪ দল আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়েছে। আমাদের দলীয় অনেক নেতাকর্মী এ সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, এটা নিয়ে নতুন করে ভাবতে গেলে দলের ন্যাশনাল কমিটিতে আলোচনা করতে হবে। করোনার কারণে এখন ন্যাশনাল কমিটি ডাকাও অসুবিধা। তাই আপাতত ১৪ দলের নিয়মিত অনুষ্ঠানে অংশ নিই।

১৪ দলের এই শীর্ষনেতা বলেন, ‘১৪ দলের এখন কোনো রুল (কার্যকারিতা) নেই। দিবসকেন্দ্রিক কিছু ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান হয়, অন্যান্য ব্যস্ততা থাকলে যাইও না।’

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জাগো নিউজকে বলেন, করোনাকালে সব ধরনের তৎপরতা তো এমনিতেই স্থবির হয়ে আছে। রাজনৈতিক তৎপরতা নেই। তারপরও তো ১৪ দলীয় জোটে বিভিন্ন দিবস উদযাপন হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে যেটুকু রাজনৈতিক তৎপরতা আছে, এর বাইরে কিছু নয়।

সম্প্রতি ১৪ দলের সভায় ক্ষোভ প্রকাশের বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো ব্যক্তিগত ক্ষোভ। আওয়ামী লীগ কেন খোঁজখবর রাখবে? দল তো নিজেরাই চালাবে। এটা তো খোঁজখবর রাখার ব্যাপার নয়, একজন আরেকজনের প্রশ্নে সহযোগিতার ব্যাপার। আন্দোলন-সংগ্রামের প্রশ্নে পারস্পরিক খোঁজখবর রাখার দরকারই নেই।

জোটের সভায় ক্ষোভ নিয়ে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, এটা সাংগঠনিক জীবনের একটা অংশ। সব দলের নেতাকর্মীরাই পাওয়া না পাওয়ার প্রশ্ন তোলে। এটাও তারই অংশ। তবে রাজনৈতিক দল যারা করে, কিছু পেলেও করতে হবে, না পেলেও। কেউ দিলে ভালো, না দিলেও ভালো। তিনি বলেন, আমাদের একটাই চাওয়া; জোট বাস্তবিক অর্থে সমমর্যাদার ভিত্তিতে চলুক। এই সমমর্যাদার অর্থ হলো; পার্টি টু পার্টি। আমরা তো আওয়ামী লীগের সমান হতে পারবো না। সেই দুঃসাহসও নেই।

বৈঠকে উত্থাপিত বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইলে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের আহ্বায়ক রেজাউর রশিদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ১৪ দলীয় জোট রাজনৈতিক আদর্শিক জোট হিসেবে গঠন হয়েছে। জোটের রাজনৈতিক আদর্শিক নির্দেশনাগুলো মাঝে মাঝে ব্যত্যয় ঘটে এবং আমরা সেটাকে তৃণমূল থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত কার্যকরী করার জন্য সুস্থ ও সঠিক কর্মসূচি নেয়া উচিত বলে মনে করি। এটিই আমার বলার উদ্দেশ্য ছিল।

তিনি বলেন, সরকারের সব কিছু একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় আছে। ১৪ দলীয় জোটের নামে চলছে। ১৪ দলের কয়েকজন সংসদ সদস্য ছাড়া অন্য কেউ নেই। এটা একটা বিষয়। পদ-পদবি বা মন্ত্রিত্বের বিষয়টি বড় নয়, বড় বিষয় হচ্ছে কমিটমেন্ট টু দ্য পিপল বা একাত্তরে জাতির জনকের যে বক্তব্য ছিল, সেটি। আমরা সেখান থেকে তো সরতে চাই না। এসময় তিনি জোট গঠনে ২৩ দফা প্রতিপালনের বিষয়েও জোর দেন।

অব্যস্থাপনা বা অবহেলার নজির উল্লেখ করে বাসদের এই নেতা বলেন, এই যে সেদিন বিদেশি অতিথিদের (ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি) সঙ্গে দেখা করার জন্য কয়েকজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এটা ঠিক নয়। জোটের নাম যখন আসছে, তখন সবাইকে সম্পৃক্ত করা উচিত।

এসব ক্ষোভ ও কর্মকাণ্ড নিয়ে জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র এবং আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে ‘মামুলি ব্যাপার’ বলে উড়িয়ে দেন।

১৪ দলের একাধিক নেতা বলছেন, বিষয়গুলো আসলেই মামুলি, কিন্তু এগুলোই রাজনীতির কার্টেসি। এই সৌজন্য রক্ষা না করলে এক সময় এগুলোই হয়তো বড় আকার ধারণ করবে। ছোট ছোট ক্ষোভ থেকে দূরত্ব তৈরি হবে। এজন্য আগে থেকে সচেতন হয়ে বিষয়গুলো দেখা দরকার।

এসইউজে/এসএইচএস/এমকেএইচ