মতামত

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও প্রত্যাশা

পুরো জাতি আজ ব্যাপক আনন্দের সাথে মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতীয় দিবস পালন করছে। আজ আমাদের হৃদয় আনন্দে উদ্বেলিত। আনন্দ প্রকাশের ভাষা আমাদের নেই। যাদের কল্যাণে আজ আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি তাদের প্রতি জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি ও শুভেচ্ছা।

Advertisement

আমাদের মাতৃভূমি বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক কিছু, দিতে হয়েছে লাখ প্রাণের তাজা রক্ত। পাকিস্তানি শাসনের শৃঙ্খল থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার সেই গৌরব ও অহংকারের দিন ২৬ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার হত্যা, ধ্বংস ও পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে ৯ মাসের মরণপণ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের, জন্ম হয় লাল-সবুজ পতাকার। এদিনে বাঙালি পরাধীনতা থেকে দেশমাতৃকাকে রক্ষার উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র। আক্রমণকারী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নেমেছিল সশস্ত্র যুদ্ধে।

একটি জাতির স্বাধীনতা তার ইতিহাসে যেমন গৌরবের, তেমনি বেদনার। অনেক রক্ত, অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের বিজয়। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস ও পটভূমি। একদিনের ঘোষণায় বা কারও বাঁশির শব্দ শুনে গোটা জাতি জীবন বাজি রেখে মরণপণ লড়াই-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। ’৪৭-এ অদ্ভুত দ্বিজাতিতত্তের ভিত্তিতে দেশ বিভক্তির পর থেকেই উর্দু শাসকদের নানা কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বাঙালির রক্ত সংগ্রামের চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে।

মাতৃভাষার দাবিতে সেই ’৪৮ সাল থেকে শুরু করে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তদান সংগ্রাম-আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে জাতির রায়, ’৫৬-তে এসে সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি আদায়, ’৬২-এর শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফার মধ্য দিয়ে বাঙালির মুক্তিসনদ ঘোষণা, ’৬৯-এর ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিদায় এবং ’৭০-এ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয়ের ধারাবাহিকতায়ই এসেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং স্বপ্নের স্বাধীনতা। ’৭০-এর নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয়ের পর বাঙালির স্বপ্নপুরুষ, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়েই আইনগত ও সাংবিধানিকভাবে অর্জন করেন দেশ পরিচালনার ক্ষমতা এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করার যোগ্যতা।

Advertisement

৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এই জগদ্বিখ্যাত ঘোষণার মধ্য দিয়েই মূলত বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে যায়। খুঁজে পায় গেরিলাযুদ্ধের গোপন কৌশল ও দিকনির্দেশনা। তার পরও ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধুর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর জাতিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

সমগ্র জাতি দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান বুকে ধারণ করে এবং হৃদয়ে বিশ্বাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিপাগল বাঙালির রক্তের বন্যায় ভেসে যায় পাকিস্তানের দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত দু’লক্ষাধিক হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ, জ্বালাও-পোড়াও অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

প্রায় এক কোটি মানুষের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ এবং মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দান, রাশিয়ার অস্ত্র সরবরাহ ও ক‚টনৈতিক সমর্থন এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধেই পৃথিবীর মানচিত্রে আর একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের জন্ম হয়- সেই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। যে ভারত স্বাধীনতার যুদ্ধে আমাদের মা-বোনদের আশ্রয় দিয়েছে, দেশ স্বাধীন করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করেছে সেই দেশের সরকার প্রধান যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে স্বাগত জানাতে দেশে আসে তখন আমরা না বুঝে কত কিছুই না করছি। তার আগমনের বিরোধিতা করছি, যা মোটেও ঠিক নয়।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমাদের অর্জন অনেক। একান্তই সত্য যে, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার প্রসার, নারী উন্নয়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, করোনা নিয়ন্ত্রণে অসাধারণ ভূমিকা পালনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ অনেকটা সফল হয়েছেন বর্তমান সরকার। জঙ্গিবাদ যেভাবে মাথাচাড়া দিয়েছিল এর উত্থান ঠেকিয়ে বর্তমান সরকার দেশ বিদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন।

Advertisement

প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার এ দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও এই বাংলার খাদ্য রপ্তানি করা হচ্ছে। আয় হচ্ছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশ এখন এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারে গত দুই যুগে সিঙ্গাপুর ও হংকংকে ছাড়িয়ে আজকের অবস্থানে উঠেছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী মহামারির কারণে যেখানে দেশে দেশে প্রবৃদ্ধির গতি ব্যাহত হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী করোনা অতিমারির ফলে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলেও বাংলাদেশ অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলে আপাতদৃষ্টিতে অনেকেই মনে করছেন। করোনা মোকাবিলা সক্ষমতায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ও বিশ্বে ২০তম। এ অভূতপূর্ব অগ্রগতি আমাদেরকে ভবিষ্যতেও ধরে রাখতে হবে।

আজ জঙ্গি হামলায় জর্জরিত পাকিস্তানের দিকে তাকালে মনে হয়, স্বাধীনতা না এলে হয়তো আমাদের অবস্থাও হতো তাদের মতো। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা এড়াতে পেরেছি সে পরিস্থিতি। ইতিমধ্যেই সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ, হত্যা, খুন, ধর্ষণ, লুট ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করে যাচ্ছেন এর ফলে দেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী লক্ষ-কোটি মানুষের মনে বিরাট আশার সঞ্চার হয়েছে।

মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের একটাই প্রত্যাশা।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা যেন পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়। আমাদের এ শান্তিময় দেশে ধর্মের নামে যেন কেউ অশান্তি সৃষ্টি করতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখতেন তার বাস্তবায়ন আজ খুবই প্রয়োজন। ১৯৭২ সালে ৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন: ‘জনাব স্পীকার সাহেব, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। ২৫ বৎসর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যাবিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এ সব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয় নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি’। বঙ্গবন্ধুর এই আদর্শ যদি আজ পূর্ণ রূপে বাস্তবায়িত করা হত তাহলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এ দিনে দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার মত সাহস দেখানোর মত হয়তো কাউকে পাওয়া যেত না।

পরিশেষে বলতে চাই, আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ অনুযায়ী রাষ্ট্র ও মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারি, তার বিশ্বাস, আদর্শ ও কর্মকে লালন করি, তাহলে সেটাই হবে তার প্রতি সত্যিকারের সম্মান প্রদর্শন, দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ।

জাতি আজ নানান উৎসবের পাশাপাশি গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় স্মরণ করবে মহান মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদদের। স্মরণ করবে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী তার সহকর্মী জাতীয় নেতাদের। জাতি শ্রদ্ধা জানাবে বীরাঙ্গনা আর শহীদ মাতাদের। মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্র ক্ষণে সবার প্রতি রইল শুভেচ্ছা।

এইচআর/এএসএম