স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশ ও অর্থনীতি তরতর করে এগিয়ে গেলেও তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি পুঁজিবাজার। ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হলেও পুঁজিবাজার যেন ক্রমশ পিছু হঠেছে। শিল্পায়নে যেখানে মুখ্য ভূমিকা রাখার কথা, সেখানে শিল্পায়নে ক্রমেই কমছে পুঁজিবাজারের ভূমিকা।
Advertisement
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ওই সময় জিডিপি’র আকার ছিল ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার। দারিদ্র্যের হার ছিল ৭০ শতাংশ।
৫০ বছর পর ২০২০ সালের হিসাবে রফতানি আয় বেড়ে ৩৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। মাথাপিছু আয় ১৬ গুণ বেড়ে দুই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। জিডিপির আকার প্রায় ৪০০ গুণ বেড়ে ২৭ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। দারিদ্র্যের হার কমে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে।
দেশের অর্থনীতি এভাবে এগিয়ে যেতে বড় ভূমিকা রেখেছে শিল্পখাত। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিএনপি) শিল্প খাতের অবদান ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখন শিল্প খাতের অবদান বেড়ে ৩৫ শতাংশ ছাড়িছে।
Advertisement
দেশের শিল্প খাত তরতর করে এগিয়ে গেলেও এ খাতের উন্নয়নে খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারছে না পুঁজিবাজার। অথচ শিল্প খাতের বিকাশে সব থেকে বড় ভূমিকা রাখার কথা পুঁজিবাজারের। মূলত ব্যাংকঋণ সহজলভ্য হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি অর্থের জন্য ব্যাংকে ছুটছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। এ কারণেই শিল্পায়নে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। ফলস্বরূপ বাধাগ্রস্ত হয়েছে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের পুঁজিবাজারের যতটা উন্নয়ন হওয়ার দরকার ছিল, তা হয়নি। পুঁজিবাজারের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন আমরা দেখতে পারছি না। এর অন্যতম কারণ ব্যাংকঋণের সহজলভ্যতা।’
তিনি বলেন, ‘দেশে রেওয়াজ হয়ে গেছে ব্যাংক থেকে টাকা নিলে আর ফেরত দিতে হবে না। যে কারণে উদ্যোক্তারা পুঁজিবাজার থেকে টাকা না নিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা নিচ্ছেন। এতে একদিকে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ছে, অন্যদিকে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পুঁজিবাজারের উন্নয়নের জন্য ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়ার রীতি বন্ধ করতে হবে।’
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও অধ্যাপক আবু আহমেদ
Advertisement
গত কয়েক বছরের ব্যাংকঋণ ও পুঁজিবাজার থেকে উদ্যোক্তাদের তোলা অর্থের পরিমাণের তথ্য পর্যালোচনা করেও এই অর্থনীতিবিদের কথার মিল পাওয়া যায়। তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দিন যত যাচ্ছে ব্যাংকের ঋণের তুলনায় পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ তত কমছে। সর্বশেষ পাঁচ বছর ব্যাংক থেকে যে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে তার ১ শতাংশের কম।
এর মধ্যে ২০১৯ সালে ব্যাংক থেকে এক লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। বছরটিতে উদ্যোক্তারা পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করেছেন ৬৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকঋণের মাত্র দশমিক ৪২ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহ করেন উদ্যোক্তারা।
আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে এর পরিমাণ ছিল দশমিক ৪৪ শতাংশ। বছরটিতে ব্যাংক থেকে ঋণ হিসাবে উদ্যোক্তারা সংগ্রহ করেন এক লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা, বিপরীতে পুঁজিবাজার থেকে নেন ৬৫৫ কোটি টাকা।
২০১৭ সালে ব্যাংকঋণের দশমিক ৮৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহ করেন উদ্যোক্তারা। বছরটিতে এক লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকঋণের বিপরীতে পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করা অর্থের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৪২ কোটি টাকা।
এছাড়া ২০১৬ সালে এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকঋণের বিপরীতে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ৯৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকঋণের দশমিক ৭৯ শতাংশের সমান অর্থ পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করেন উদ্যোক্তারা। ২০১৫ সালে ব্যাংকঋণের দশমিক ৬৬ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করেন তারা।
পাঁচ বছর ধরে পুঁজিবাজার থেকে উদ্যোক্তাদের অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ ব্যাংকঋণের ১ শতাংশের কম হলেও ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২ শতাংশের ওপর ছিল। এর মধ্যে ২০১৪ সালে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ব্যাংকঋণের ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশের সমান।
তারও আগে অর্থাৎ ২০১৩ সালে ২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, ২০১২ সালে ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ২০১১ সালে ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ, ২০১০ সালে ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং ২০০৯ সালে ২ শতাংশ ছিল।
শিল্পায়নের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার কারণে জিডিপির সঙ্গেও তাল মেলাতে পারছে না পুঁজিবাজার। ফলে জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধনের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০১০ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন ছিল জিডিপির ৫০ দশমিক ৭০ শতাংশের সমান। ধারাবাহিকভাবে তা কমে মাত্র ৯ শতাংশে নেমে এসেছে।
এদিকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইনে কোনো কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার বেশি হলেই পরবর্তী এক বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা আছে। তবে এই আইনের বাস্তবায়নও দেখা যাচ্ছে না।
যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদফতরের (আরজেএসসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৫৫টি। এর মধ্যে পরিশোধিত মূলধন ৫০ কোটি টাকার বেশি আছে এক হাজারের বেশি কোম্পানির। অথচ বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা মাত্র ৩৩৪টি।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘পলিসিগত দুর্বলতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে না পারায় আমাদের পুঁজিবাজারের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। বিশ্বের অন্যান্য দেশে জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধন যেখানে ১০০ শতাংশের বেশি, সেখানে আমাদের দেশে জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধন মাত্র ৯ শতাংশের মতো।’
তিনি বলেন, ‘শিল্পায়নে সব থেকে বড় ভূমিকা রাখার কথা পুঁজিবাজারের। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হচ্ছে না। সহজে ঋণ পাওয়ায় উদ্যোক্তারা ব্যাংকে যাচ্ছেন। ব্যাংকঋণ পরিশোধ না করলে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু পুঁজিবাজারে এলে জবাবদিহিতার মধ্যে আসতে হবে। এ কারণে তারা পুঁজিবাজারে আসছেন না।’
এমএএস/ইএ/এমকেএইচ