খেলাধুলা

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘ডাক্তার নয়, ফুটবলার হবি’

সেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা না হলে হয়তো জাকারিয়া পিন্টুর নামের আগে বসতো ‘ডাক্তার’ শব্দটি। ‘ডা. জাকারিয়া পিন্টু’- এভাবেই সমাজে-রাষ্ট্রে পরিচিতি হতো তার। কারণ, পিন্টুর বাবা নজিব উদ্দিন আহমেদ যে ছেলেকে নিজের মতো ডাক্তার বানানোর স্বপ্নই বুনছিলেন!

Advertisement

জাকারিয়া পিন্টুকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। দেশের মানুষের কাছে তিনি অধিনায়ক পিন্টু হিসেবেই পরিচিত। অধিনায়ক হিসেবে তার গর্ব অনেক। কারণ, এ সাধারণ কোনো অধিনায়ক নয়, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক।

গর্ব করে প্রায়ই জাকারিয়া পিন্টু বলেন, ‘অনেক অধিনায়ক হয়েছেন, অনেক হবেন। পৃথিবী ও ফুটবল যতদিন থাকবেন ততদিন অধিনায়কও আসবেন-যাবেন; কিন্তু আমার মতো স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক কেউ হতে পারেননি। হয়তো পারবেনও না। দেশের জন্য ফুটবলপায়ে যুদ্ধ করা দলটির যে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম আমি!’

জাকারিয়া পিন্টুর জীবনের লক্ষ্যটা ডাক্তার হওয়ার দিক থেকে ফুটবলের দিকে চলে যাওয়ার ৭৫ বছর আগের সেই ঘটনার জায়গা থেকে ঘুরে আসা যাক।

Advertisement

১৯৫৬ সালে জাকারিয়া পিন্টু তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র। বরিশালের মঠবাড়িয়া স্কুলের পাশের পুকুরপাড় দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তৎকালীন তুখোড় ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। জাকারিয়া পিন্টু এগিয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে বললেন,‘আপনার আগমন উপলক্ষ্যে পরের দিন স্কুল মাঠে একটি প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ খেলতে চাই। আপনি থাকবেন।’

৭৫ বছর আগের স্মৃতি হাতড়ে জাকারিয়া পিন্টু বললেন, ‘ফুটবল ম্যাচ শুনেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ফুটবল-ফুটবল! আমি আছি, ম্যাচে থাকবো। পরের দিন তিনি খেলা দেখতে আসলেন।’

প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ হলো মঠবাড়িয়া স্কুল ও অফিসার্স ক্লাবের মধ্যে। অফিসার্স ক্লাবের অধিনায়ক ছিলেন জাকারিয়া পিন্টুর বাবা ডাক্তার নজিব উদ্দিন আহমেদ। বাবার দলের বিপক্ষে খেলেছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। জিতেছিলেন ২-০ গোলে। দুটি গোলই করেছিলেন পিন্টু।

জীবনের বাঁক বদলানোর মুহূর্তটা ছিল ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের সময়। কি ঘটেছিল তখন? জানা যাক জাকারিয়া পিন্টুর মুখ থেকেই।

Advertisement

তিনি বলেন, ‘পুরস্কার নেয়ার সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, তুই বড় ফুটবলার হবি। তোর বাবা কই? বাবা আসলেন। বঙ্গবন্ধু জানতে পারলেন বাবা আমাকে ডাক্তার বানাতে চান। বাবাকে বঙ্গবন্ধু বললেন, পিন্টু বড় ফুটবলার হবে। আমাকে ওয়াদা করেন- ওকে ফুটবলার বানাবেন। বাবা বঙ্গবন্ধুর হাতে হাত রাখলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন- আমি চাই-আপনার ছেলে ডাক্তার নয়, ফুটবলার হোক। আমার কথা রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে বাবা ওয়াদা দিলেন- আমাকে ডাক্তার নয়, ফুটবলার বানাবেন।’

জাকারিয়া পিন্টুর জন্ম নওগাঁ জেলায়। বাবা ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও এমবিবিএস ডাক্তার। বাবার চাকরির কারণেই বরিশালে বেড়ে ওঠা। সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর বরিশালেই স্থায়ী হয়ে যান জাকারিয়া পিন্টুর বাবা এবং তার পরিবার।

মঠবাড়িয়া থেকে এসএসসি পাশ করে এইচএসসিতে পড়াশুনা করেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে সবার বড় জাকারিয়া পিন্টু। তার বাবা মারা যান ১৯৮২ সালে।

তিনবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল জাকারিয়া পিন্টুর। দ্বিতীয়বার শেষ স্বাধীন হওয়ার পরপর। এপার বাংলা এবং ওপার বাংলা দুই দলের মধ্যকার প্রদর্শনী ফুটবলে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন ঢাকা স্টেডিয়ামে (এখন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম)। সেই স্মৃতি রোমান্থন করে জাকারিয়া পিন্টু বলেন ‘করমর্দনের সময়ই আমাকে বলেছিলেন- কি বড় ফুটবলার হইছিস তো?’

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জাকারিয়া পিন্টুর তৃতীয় ও শেষবার দেখা হয়েছিল ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়ার মারদেকা কাপে খেলতে যাওয়ার আগে। ‘আমরা মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। জাতীয় দল প্রথম দেশের বাইরে খেলতে যাবে। তিনি মিষ্টি এনে সবাইকে খাওয়ালেন’- বলছিলেন জাকারিয়া পিন্টু।

মারদেকা কাপের সময় একটি ঘটনা মনে করলে এখনো গা শিহরিত হয়ে ওঠে জাকারিয়া পিন্টুর, ‘আমরা যখন খেলছিলাম তখন দর্শকরা শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ বলে স্লোগান দিচিছল। দেশ থেকে এতদ দূরে গিয়ে এই স্লোগান শুনে আনন্দে আমার বুক ভরে গিয়েছিল।’

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কিভাবে দেশের জন্য ভারতের মাটিতে ফুটবল খেলেছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল? জাকারিয়া পিন্টুর কাছে জানা যাক তার সার সংক্ষেপ।

‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সঙ্গে থাকার সময়গুলো আমার জীবনের সবচেয়ে গর্বের। ১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরের নদীয়া স্টেডিয়ামে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রথম ম্যাচ ছিল নদীয়া জেলা একাদশের বিপক্ষে। ম্যাচের আগে ভারতের পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত ছিল। কিন্তু ম্যাচ শুরুর আগে নদীয়ার ডিসি আপত্তি জানিয়েছিলেন।

প্রতিবাদে ভাঙচুর হয়েছিল গ্যালারিতে। তখন নদিয়ার ডিসি ১০ মিনিটের জন্য পতাকা ওড়ানোর অনুমতি দিয়েছিলেন। ভারতের পতাকা উড়িয়েছিলেন ডিসি দিপক ঘোষ, আমি উড়িয়েছিলাম বাংলাদেশের পাতাকা। জীবনে এর চেয়ে বড় আর কী পাওয়ার আছে? বিদেশের মাটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের পতাকা প্রথম ওড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছে আমার। যখন জাতীয় সঙ্গীত বাজলো, তখন আমরা গান গাওয়ার সময় চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি’- বলছিলেন জাকারিয়া পিন্টু।

পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ১৭টি ম্যাচ খেলে কয়েক লাখ রুপি সংগ্রহ করেছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুর মতে ৫ লাখ রুপি সংগ্রহ করে তারা মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে জমা দিয়েছিলেন।

আরআই/আইএইচএস/এমকেএইচ