প্রতিটি ভাষার লেখক সে জাতির শ্রেষ্ঠ ঘটনা নিয়ে তার শ্রেষ্ঠ লেখাটি লেখার চেষ্টা করেন। গবেষক হলে গবেষণা করেন, ঔপন্যাসিক হলে সেই ঘটনার ওপর ভিত্তি করে উপন্যাস লেখেন কিংবা এক বা একাধিক গল্প লেখেন, রচনা করেন সঙ্গীত, নাটক কিংবা আখ্যান। বাঙালি জাতির জ্ঞাত ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ঘটনার ক্রমবিন্যাশ করলে সবার আগে উঠে আসবে ১৯৭১ সাল, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির স্বাধীন অস্তিত্ব লাভের কাল, একটি জাতি হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে নাম লেখানোর বছর। দীর্ঘ পরাধীনতার নিকষ অন্ধকার যখন আমাদের বুকের ওপর জেঁকে বসেছিল তখন সাধারণ বাঙালি-উচ্চতার চেয়ে উচ্চতর এক বাঙালি পুরুষ তার শালপ্রাংশু দেহ নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন, দিয়েছিলেন নেতৃত্ব, স্বাধীনতা যুদ্ধের। তখনও যাদের জন্ম হয়নি তারা কেউই এ দৃশ্য কল্পনা করে উঠতে পারি না ঠিক, একটি আঙুল তুলে সাতকোটি বাঙালিরে কী করে তিনি জাগালেন? কী করে পারলেন তিনি গরিষ্ঠ সংখ্যক বাঙালিরে মুক্তির সোপানতলে এনে দাঁড় করাতে?
Advertisement
আমাকে অবাক করে যা তাহলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার সমর্থক ও সহযোগী নেতৃবৃন্দ ১৯৪৮-এ এসেই বুঝে গেলেন যে, যে পাকিস্তান তারা ভারত থেকে ভেঙে বের করে আনলেন তা আসলে তাদের নয়। এমনকি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ও এই সত্য বুঝেছিলেন বলে হতাশায় উচ্চারণ করেছিলেন, এই পোকায় কাটা পাকিস্তান দিয়ে আমি কী করবো? চেয়েছিলেন পাকিস্তানেও দুই বিবদমান ধর্মগোষ্ঠীর সম্মিলন ঘটাতে, অন্ততঃ একটি সংবিধান রেখে যেতে যাতে সকল নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। তিনি পারেননি। বঙ্গবন্ধু পেরেছেন, বাঙালি জাতিকে তিনি কেবল স্বাধীনতাই দেননি, দিয়েছেন একটি আন্তর্জাতিক মানের, গণতান্ত্রিক সংবিধানও। কিন্তু সে পর্যন্ত পৌঁছুতে তাকে পার হতে হয়েছিল দীর্ঘ পথ। একে একে বঙ্গবন্ধুপূর্ব নেতাদের কেউ মারা গেছেন, কেউ বা পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, কেউ সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেছেন বা দ্বিধাবোধ করেছেন শুধু বঙ্গবন্ধু এবং তার সহযোগী নেতৃত্ব কখনও ভুল করেননি, না তারা পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, না তারা সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেছেন, না তারা করণীয় নির্ধারণে কখনও দ্বিধা করেছেন।
আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগকে সর্বজনীন করেছেন, এতে সায় ছিল না অনেক সিনিয়র নেতার। সে জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তরুণ তুর্কীরা শক্তি প্রয়োগেও দ্বিধা করেননি। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নিজেদের নিয়ে একটি সর্বজনীন রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছেন নিজেদেরকে। চষে বেড়িয়েছেন গোটা দেশ, মিশেছেন সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে, তাদের ভাষা বুঝতে শিখেছেন এবং সেই ভাষাতেই আবার তাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন তাদের চাওয়াগুলিকে দাবীতে পরিণত করে। পৃথিবীর তাবৎ জননেতাই এই কাজটি সঠিক ভাবে করতে পেরেছিলেন বলে তারা ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু কেবল সাধারণ্যের ভাষাতেই গরিষ্ঠের দাবীকে আন্দোলনে রূপ দিতে পেরেছিলেন তাই-ই নয়, বরং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে সেগুলো আদায় করে নিতে কোনোদিন আপোস করেননি। যে জন্য তাকে জীবনের তেরটি বছর কাটাতে হয়েছিল জেলখানায়। শাসকের অত্যাচারকে তিনি পরিণত করতে পেরেছিলেন একটি সুতীক্ষè তরবারিতে, যা দিয়ে তিনি ফালাফালা করে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের ভিতকে। সত্যিকথা বলতে কি বঙ্গবন্ধু এমন এক বাঘের পিঠে চেপে বসেছিলেন যে, বাঘকে তার নির্দিষ্ট গন্তব্য পর্যন্ত দাবড়ে নিয়ে যেতেই হতো, তিনি যদি নেমে পড়তেন তাহলে হয় তাকে বাঘের সঙ্গে আপোস করতে হতো কিংবা বাঘ তাকে খেয়ে ফেলতো। তাই তিনি শেষ পর্যন্ত বাঘটিকে দাবড়ে নিয়ে গিয়েছেন, এই বাঘ আর কিছুই নয়, বাঙালির স্বাধীনতা, বাঙালির স্ব-অধিকার।
এখানেই বঙ্গবন্ধু তার পূর্বেকার এবং তার সময়কার নেতৃবৃন্দের চেয়ে ভিন্ন। তিনি সংসারের মোহে বাঁধা থাকেননি, আবার তার চেয়ে সংসারি আমরা কাউকে দেখতে পাইনে তখনকার দিনে। যে টুকু সময় তিনি পেতেন সেটুকু সময়ই তিনি মেপে মেপে স্ত্রী-সন্তান-পরিজনকে দিয়েছেন রেশনের মতো রাজনৈতিক জীবন ও সঙ্গীসাথীদের কাছ থেকে কেটে এনে। মন্ত্রীত্ব থেকে প্রধানমন্ত্রীত্ব, সকল প্রস্তাবনাকেই তিনি অনায়াসে পাশ কাটিয়ে যেতে পেরেছিলেন কারণ তিনি লক্ষ্য ঠিক করেই নিয়েছিলেন। এবং সেই লক্ষ্যেই তিনি বাঙালিকে প্রস্তুত করতে সময় নিয়েছেন। নানাবিধ ছক কষেছেন। বাতিল করেছেন অনেক সিদ্ধান্ত, কৌশল বদলেছেন একের পর এক। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগরতলা দিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে একটি প্রবাসী সরকার গঠনের চেষ্টা চালিয়েছেন কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার মুখে অবিচল থেকে মোকাবিলা করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই দেশের একটি নাম, জাতীয় সঙ্গীতসহ খুঁটিনাটি অনেক কিছুই নির্ধারণ করেছেন। মোটকথা একটি রাষ্ট্রচরিত্র সেই পয়ষট্টি সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তার অনুসারী নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের জন্য ঠিক করে ফেলেছিলেন। আরও বড় কথা হলো, পাকিস্তানী সামরিক সরকারকে নির্বাচন দিতে বাধ্য করে সেই নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়লাভ করে সংসদের বাইরে জনতার-সংসদে নির্বাচিতদের শপথ পড়িয়ে পাকিস্তানের নিগড়ের বাইরে একটি সম্পূর্ণ সরকার ব্যবস্থা চালু করে দিয়েছিলেন ২ ৬শে মার্চ আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার আগেই। একজন সাহসী এবং স্বজাতির জন্য জীবন উৎসর্গকারী নেতার উপযুক্ত কাজটি শেখ মুজিবুর রহমান করেছিলেন পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর হাতে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করে। সে রাতে বন্দী মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির স্বাধীনতার একমাত্র প্রতীক, একমাত্র লক্ষ্য। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও মৃত্যুর মুখে স্বেচ্ছায় ঝাঁপ দেওয়ার মতো শক্তি, সাহস ও আত্মবিশ্বাস কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরই ছিল, পরবর্তীতেও আমরা তার প্রমাণ পাই Ñ ঘাতকদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে “তোরা কী চাস?” প্রশ্ন করার সাহস বাঙালির আর কোনো নেতা করতে পারতেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করাই যায় কারণ আর কোনো নজির আমাদের সামনে নেই।
Advertisement
ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগের কথার সঙ্গে আজ সামগ্রিক ভাবে বাঙালি জাতির আত্মত্যাগকেও স্মরণ করা প্রয়োজন। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘ নয় মাস ধরে বাঙালির ওপর যে নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে তা ইতিহাসে বিরল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মান নাৎসী বাহিনী ইহুদিদের ওপর যে অত্যাচার চালিয়েছিল তাকে ‘নির্মমতম’ আখ্যা দিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। কিন্তু বাঙালির ওপর চালানো গণহত্যাসহ ধর্ষণ ও নির্যাতন রয়ে গেছে ইতিহাসের অন্তরালে। জিঞ্জিরা থেকে ফরিদপুর পর্যন্ত অন্তস্বত্ত¡া এক নারীর হেঁটে যাওয়া এবং পথমথ্যে অপুষ্ট সন্তান প্রসব করার মতো ঘটনা যেমন দেশব্যাপী অসংখ্য রয়েছে, তেমনই রয়েছে রংপুরে আটক মুক্তিযোদ্ধাকে লোক জড়ো করে ক্ষুধার্থ বাঘ দিয়ে খাওয়ানোর মতো নৃশংস ঘটনাও। আর পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর একেকটি ক্যাম্পে কত সংখ্যক বাঙালি নারীকে ধরে এনে নির্মম ও নিষ্ঠুর কায়দায় যৌন নীপিড়ন চালানোর কথা আজও আমরা সম্পূর্ণভাবে জানিনে। কিন্তু আমরা স্বাধীনতার পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে, বীরাঙ্গণাদের সংখ্যা নিয়ে জাতিকে কেবল বিভক্তই করেছি তা নয়, আমরা সৃষ্টি করেছি চরম হাস্যপরিহাসের। এই পঞ্চাশ বছরে আমরা সত্যিকার অর্থেই একটি নির্লজ্জ ও অকৃতজ্ঞ জাতিতে পরিণত হয়েছি, যাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ স্বাধীনতার ইতিহাস, স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গীকৃত জাতীয় বীর, পাকিস্তানীদের হাতে নির্যাতিত নারীসহ ভারতে গিয়ে একটি পরিপূর্ণ যুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনা করে বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে নোংরা, অসত্য, বানোয়াট তত্ত¡ হাজির করে বাঙালির গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধকে বার বারই অপমানিত করেছে। শুধু তাই-ই নয়, এই পক্ষের হাতে গেছে রাষ্ট্র ক্ষমতা এবং রাজনীতি সকলই। পঞ্চাশ বছরে আমরা সবচেয়ে বেশি দেখেছি স্বাধীনতা-বিরোধীদের উল্লম্ফণ এবং মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারীদের ক্ষমতার দম্ভ।
অনেকেই বলবেন যে, পরিস্থিতিতো বদলেছে কিছুটা। আমার মনে হয় না। কারণ, আজকে যে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপিত হচ্ছে, হাজার হাজার জীবিত মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের অর্জনকে নিঃশঙ্কচিত্তে উদযাপন করতে পারছেন তা সর্বার্থে সত্য নয়। আজও মানুষের বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের ভেতর এক ভয়াবহ শঙ্কা কাজ করে কবে আবার সেই অপশক্তিটি রাষ্ট্রের সবৈব ক্ষমতা দখল করে বসে, কবে আবার বাংলাদেশ উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করে, কবে আবার বাংলাদেশ তার সকল অর্জন, গৌরব আর সম্মান হারিয়ে ফেলে ব্যর্থরাষ্ট্রের তকমা লাভ করে। এই ভয় যে অমূলক নয় তার প্রমাণ পেতে আমাদের খুব বেশিদূর যেতে হবে না, ২০০৬ সালের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে প্রকাশিত সংবাদে একবার ঝাঁক মারলেই তা জানা যাবে। প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও কেন বাঙালিকে এই ভয়ের ভেতর দিয়ে যেতে হবে? কেন স্বাধীনতাকে এখনও সুস্থির ও সঠিক অবস্থানটি পাইয়ে দেওয়া সম্ভবপর হয়নি? তা নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের, এবং এই পঞ্চাশতম জন্মদিনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগামি পঞ্চাশ বছর এই ভয় ও শঙ্কা নিয়েই আমরা থাকতে চাই নাকি নতুন সময়ে, নতুন যাত্রায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং এগিয়ে যাওয়া হবে সুস্থির এবং সঠিক ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো এবং একাত্তরের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম এবং সর্বোতভাবে শক্তিমান। এই ভয়-ভীতি দূর করার ক্ষমতা অন্য দেশ থেকে অন্য কেউ এসে আমাদের দিয়ে যাবে না, এটা আমাদের ভেতরেই পরশপাথরের মতো তৈরি হতে হবে, একের ছোঁয়ায় বহু আলোকপ্রাপ্ত হবে এবং সকলের ভেতরই এই বিশ্বাস প্রোথিত থাকতে হবে যে, আমরা পারবো, আমাদেরকে পারতেই হবে। পঞ্চাশ পেরুলাম, এভাবেই আমরা পার হবো একশ এবং হাজার। বাঙালির এই নতুন পথচলা নিয়ে রচিত হবে নতুন ইতিহাস, লেখা হবে নতুন উপন্যাস, গল্প কিংবা রচিত হবে গান অথবা আখ্যান।
শুভ ৫০ বাংলাদেশ। ঢাকা। ২৬ মার্চ, ২০২১masuda.bhatti@gmail.com
এইচআর/বিএ/এমকেএইচ
Advertisement