মতামত

‘তুমি যাও আমি কিছুটা গুছিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ত্রিপুরায় চলে আসবো’

২৫ মার্চ রাতে কুমিল্লার বাগিচাগাঁওয়ের বাসা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শিবনারায়ণ দাশকে না পেয়ে বাড়িঘর লটুপাট করে, আগুন দেয় এবং বাবা সতীশ চন্দ্রকে ধরে নিয়ে যায়। শিবনারায়ণ দাশের বাবা সতীশ চন্দ্র ছিলেন ক্যামিস্ট। মা যোগমায়া দাশ। তিনি খুব মানবিক ছিলেন। পড়াশোনার প্রতি খুব অনুরাগী ছিলেন—সব সময় চাইতেন তাঁর সব ছেলে-মেয়ে গ্রাজুয়েট, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবে। তিনি ভালো সেলাই কাজ জানতেন, যা পরিবারের জন্য বাড়তি উপার্জনের একটি মাধ্যম ছিল। মা যোগমায়া দাশের মানবিক গুণাবলি ও অতিথিপরায়ণতা ছিল প্রবাদতুল্য। অনেকগুলো টিনের কৌটা ভরা থাকতো নাড়ু–সন্দেশ দিয়ে। বৈয়াম ভরা ঘি রাখতেন তিনি। বিভিন্ন জায়গা থেকে কর্মীরা আসতো। মা তাঁদের কখনই না খেয়ে যেতে দিতেন না।

Advertisement

২ মার্চের পর শিবনারায়ণ দাশকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য কুমিল্লা শহরে তাঁরই এক সহপাঠী মাইকিং করে ইনাম ঘোষণা করে। সে মাইকিংয়ের ঘোষণা তিনিও পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় শুনছিলেন। চশমা ছাড়া খুঁড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। ছদ্মবেশের কারণে অন্যরা চিনতে পারেনি তাঁকে। শৈশবেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রভাব তাঁর রাজনৈতিক চেতনা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে; তিনি ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষক। স্কুলে পড়ার সময়ে তিনি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংস্পর্শে আসেন। বিভিন্ন সভায় যেতেন, রাজনৈতিক গুরুদের বক্তৃতা শুনতেন।

মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় পতাকার দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক আদর্শিক ভাবনার নকশাকার শিবনারায়ণ দাশ বিভিন্ন বইপত্র পড়তেন। দেশের প্রতি আত্মনিবেদন ছাড়া কোনো কিছুই ধ্যান ছিল না। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি মানসিকভাবে তৈরি ছিলেন—কোনো ভয়ভীতি, পিছুটান ছিল না। সব সময় রাজনৈতিক গুরুদের উপদেশ— “কামিনী-কাঞ্চন বিপ্লব পরিপন্থী” মনে রাখার চেষ্টা করতেন। ১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যত আন্দোলন, প্রতিবাদ, মিছিল, অবরোধ হয়েছে—সকল প্রকার আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল শিবনারায়ণ দাশের। তাঁর জেলজীবন শুরু হয় ১৯৬৩ সাল থেকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। সে সময় তিনি কখনও কখনও বাড়িতে এলে মা সে রাতে আর ঘুমাতেন না, রাত জেগে পাহারা দিতেন। গোয়েন্দারাও পাহারা দিত। মা জানতেন পুলিশ এলে কীভাবে পালাতে হয়। প্রতিবেশীরাও সব সময় সাহায্য করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ১৯৭২ সালে তাঁকে জেলে যেতে হয়।

১৯৭১ সালে গোপন সংগঠনের সদস্য অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসারদের মাধ্যমে জানতে পারেন ২৫ মার্চের রাতে ক্র্যাকডাউনের কথা। বেলুচ সেনাসদস্যদের দু’জন সেসময়ে মা যোগমায়া দাশকে বলেন, “তোমরা বাসা ছেড়ে দাও।” মায়ের অবস্থা ছিল খূবই করুণ। সাত ছেলেমেয়েসহ কোথায় আশ্রয় নেবেন ভাবতে থাকেন। ছেলে শিবনারায়ণ দাশের বিরুদ্ধে হুলিয়া ছাড়াও শহরে তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে মাইকিং করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। সে কারণেও আত্মীয়স্বজন ও পরিচিত যারা ছিলেন তাদের কেউ আশ্রয় দেওয়ার সাহস করছিলেন না। এমন রাতও তাঁর জীবনে গেছে যে, বাড়ির মালিককে না জানিয়ে গোয়ালঘরে রাত কাটাতে হয়েছিল। একদিন সকালে খুব ভোরবেলায় স্থানীয় গোলপুকুর পাড়ের এক বাসায় মা যোগমায়া দাশ ছেলে শিবনারায়ণকে বলেন, “তুমি আর এ শহরে থেক না, পুলিশ তোমাকে খুব খুজঁছে। তোমার বাবাকে নিয়ে চিন্তা করছি না যতটা দুশ্চিন্তা করছি তোমাকে নিয়ে।” মেয়েদের নিয়েও দুশ্চিন্তা ছিল। মা বললেন, “তুমি যাও। আমি কিছুটা গুছিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ত্রিপুরায় চলে আসবো।”

Advertisement

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শিবনারায়ণ অস্ত্র-গোলাবারুদ ও কর্মীর নিয়ে নিজের শহর কুমিল্লা ছেড়ে ভারতের সীমান্তে অবস্থিত সোনামুড়ায় চলে যান। নিজের সংগ্রহে থাকা অস্ত্র মাটিচাপা দিয়ে রাখেন যাতে প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধে যখন অংশগ্রহণ করেন তখন তাঁর বয়স ছিল ২৪ বছর। সোনামুড়ায় পৌঁছানোর পর এক কর্মীর মাধ্যমে মাকে খবর জানাতে পেরেছিলেন সীমান্ত অতিক্রমের। মাও মাসখানেকের মধ্যেই ভারতের সীমান্ত সোনামুড়ায় পৌঁছান। ক্যাম্পের রান্নাবান্নার দায়িত্ব পালন করেন হাসিমুখে। কলকাতায় মামাদের সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগের প্রেক্ষিতে মামারা টেলিগ্রামের মাধ্যমে নিতে আসার খবর জানান। মায়ের আত্মসম্মানবোধ খুব প্রখর ছিল তাই কলকাতায় গিয়ে মামাদের আশ্রয়ে না থেকে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন।

শিবনারায়ণ দাশের প্রতি মায়ের পক্ষপাতিত্ব ছিল বাড়াবাড়ি রকমের। অন্য ছেলেমেয়েরা ঠাট্টা করে বলতো, “তোমার কি আর কেউ নেই ; খালি শিবু শিবু কর? আমরা কি তোমার কেউ না?” মায়ের আশ্রয় প্রশ্রয় ভালোবাসা তার জীবনের সবকিছু। রাজনৈতিক চেতনা, দেশপ্রেম, জেল জীবনের নির্যাতন, মুক্তিযুদ্ধের জীবনকাল—সবকিছুতেই মা তাঁর জীবনে জড়িয়ে আছে। মায়ের গয়না বিক্রির টাকায় রাজনৈতিক জীবন ও জেল জীবনের মামলা ইত্যাদি বিভিন্ন দুঃসময়ের প্রয়োজন মিটিয়েছেন তিনি। শিবনারায়ণ দাশের প্রতি মা এবং পরিবারের প্রত্যাশা ছিল শুধু তাঁর নিজের জীবনের নিরাপত্তাটুকু। মা অন্যদের বলতেন, “ও যা করে তাতে রাজরোষ আসবেই। শিবু কি চুরি-ডাকাতি করে? তা তো না, ও রাজনীতি করে। দেশের কাজ করে। দেশের কাজ করলে রাজরোষ আসবেই। তা মেনে নিয়েই কাজ করতে হবে।” শিবনারায়ণের জীবনের তাই চেতনাজুড়ে আছে মা। সরকারি দলিলপত্র বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি না থাকলেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কয়েকটি গবেষণা গ্রন্থ ও উইকিপিডিয়ায় স্বা ধীন বাংলার পতাকার নকশাকার হিসেবে শিবনারায়ণ দাশের নাম উল্লেখ রয়েছে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে লেখা ডা. মাহফুজুর রহমানের বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম : মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম গ্রন্থে একই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া আবুল কাশেম হৃদয়ের মুক্তি সংগ্রামে কুমিল্লা গ্রন্থে বিষয়টির সচিত্র উল্লেখ রয়েছে।

২ মার্চ স্বাধীন বাংলার পতাকার জন্য একটি বিশেষ দিন হলেও এর জন্ম আরো আগেই। ১৯৭০ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশ নেওয়ার কথা ছিল। সেজন্য ছাত্রদের নিয়ে জয় বাংলা বাহিনী গঠন করা হয়। ছাত্রনেতারা একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। একদিন আগে ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (এখন সার্জেন্ট জহুরুল হক ছাত্রাবাস) ১১৬ নম্বর কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদু রব, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ ও মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। এতে আরো উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন। জানা যায়, ওই বৈঠকে কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করে সবার আলোচনা শেষে সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্যের মাঝে সোনালি হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্রখচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলের ৪০১ নম্বর (উত্তর) কক্ষে ১৯৭০ সালের ৬ জুন রাত ১১টার পর পুরো পতাকার নকশা আঁকেন শিবনারায়ণ দাশ।

আড়ালেই থেকে গেলেন নকশাকার শিবনারায়ণ। স্বাধীনতার আগে মুক্তিকামী মানুষের পতাকা ছিল গাঢ় সবুজ জমিনের ভেতর লাল সূর্য। আর সূর্যের মাঝে হলুদ রঙে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র। ১৯৭০ সালের উত্তাল দিনগুলোতে এবং একাত্তরের রণাঙ্গনে এই পতাকা হয়ে দাঁড়ায় স্বাধীন বাংলার প্রতীক। দেশ-বিদেশে “৪০ বছর ধরে আমাদের শাসকগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের নামে যে আদর্শ প্রচার করছে তা তাদের দলীয় আদর্শ। অথচ মুক্তিযুদ্ধ কোনো দল বা গোষ্ঠীর যুদ্ধ ছিল না। সেনা কর্মকর্তাদের যুদ্ধও নয়। এটি ছিল একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, লুঙ্গি পরা লোকের মুক্তির লড়াই। কিন্তু স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত আদর্শটি হাতছাড়া হয়ে গেছে। আমরা যারা জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, এটি আমাদেরই ব্যর্থতা।” মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তাঁর আমৃত্যু।

Advertisement

বরাবরই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে গেছেন ঐতিহাসিক পতাকাটির নকশাকার শিবনারায়ণ দাশ। সরকারি নথিপত্র, পাঠ্যপুস্তক বা গণমাধ্যমেও বরাবর উপেক্ষিত থেকে গেছেন পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাশের নামটি। মেলেনি তাঁর কোনো রাষ্ট্রীয় পদক বা স্বীকৃতি। স্বাধীনতার পর মূল পতাকাটি ঠিক রেখে কেবল লাল সূর্যের ভেতরের মানচিত্রটি বাদ দেওয়া হয়। শিবনারায়ণ দাশের অবশ্য এসব নিয়ে আক্ষেপ নেই। জয় বাংলার পতাকার এই নকশাকার এ নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তারিত বলতেও নারাজ। ২০১৬ সালে সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “আমি কখনো পদক বা স্বীকৃতি চাইনি। সে আশায় মুক্তিযুদ্ধও করিনি। কাজেই আমার কোনো স্বীকৃতি বা সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন নেই।” স্বাধীন বাংলার পতাকার নকশা নিয়ে স্মৃতিচারণের অনুরোধও এই নিভৃতচারী বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, “এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না। কারণ বলতে গেলে অনেক অপ্রিয় সত্য বলতে হয়। সব অপ্রিয় সত্য বলার সময় এখনো আসেনি। সময় হলে সব একসঙ্গেই বলব।” শিবনারায়ণ দাশ বলেন, “যে আদর্শ নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, স্বাধীনতার পর সেই আদর্শ ছিনতাই হয়ে গেছে। আমরা একটি প্রকৃত বিপ্লব বা আমূল পরিবর্তন চেয়েছিলাম যেখানে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য আর ঘুষ-দুর্নীতি থাকবে না। আমরা চেয়েছিলাম একটি সুখী সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে। কিন্তু তা হয়নি।”

পরিচয় : মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাশ মুক্তিযোদ্ধা : ২নং সেক্টরসাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ : ৯ নভেম্বর, ২০১৬সাক্ষাৎকার স্থান : ৫/২, চারতলা, ৫নং গেট, মণিপুরীপাড়া, ঢাকা।

‘একাত্তর মুক্তিযোদ্ধার মা’, মার্জিয়া লিপি, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ৪৬/১ হেমেন্দ্র দাস রোড, সূত্রাপুর, ঢাকা-১১০০।

ফারুক/এমকেএইচ