মতামত

পঞ্চাশের প্রত্যাশা

২৬ মার্চ বাংলাদেশের ক্যালেন্ডারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর অন্যতম। কারণ আর কিছু না। কারণ এই দিনটিতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাটি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পথ ধরেই আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে আবারো এসেছে মার্চের ২৬। এবারের ২৬ অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এবারের ২৬-এ আমাদের স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী।

Advertisement

করোনাকে প্রায় পরাজিত করে বাঙালি আজ মেতেছে তার ইতিহাসের এ সুবর্ণতম অর্জনটি উদযাপনে। কারণ এ উদযাপনটির জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে হাজার বছরেরও বেশি সময়। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে আমাদের কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল না। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই আমাদের সেই অনন্য অর্জন আর তার ৫০তম পূর্তিতে আজ আমাদের সাথে শামিল বিশ্ব নেতারাও। এসেছেন ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ভুটানের রাজা আর নেপালের প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি। ডিজিটাল মেসেজ পাঠিয়েছেন আরও অনেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান। লকডাউন পেছনে ফেলে আর করোনার অনিশ্চয়তার বাতাবরণ ঝেড়ে দিয়ে পুরো দেশ আজ উৎসবমুখর।

বাংলাদেশ যখন পঞ্চাশে, আমিও তখন তাই। নিজের বেলায় যেমন ঠিক তেমনি বাংলাদেশের পঞ্চাশে দাঁড়িয়েও আমার ভাবনাজুড়ে এখন আমাদের সামনের দিনগুলো। দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার চিন্তা সামান্যই। এই করোনাকালে যখন থমকে গেছে পৃথিবীর তাবৎ নামি-দামি অর্থনীতি, তখন সচল আমাদের উন্নয়নযজ্ঞ। শুধু উন্নয়নেই নয়, কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণেও বিশ্বের রোল মডেল আমরা। যে কারণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের স্থানীয় প্রতিনিধি থেকে শুরু করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক কিংবা জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল সবার মুখে মুখে আজ বাংলাদেশের অর্জনগুলো আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অশেষ প্রশংসা। এ ধারাবাহিকতায় আমাদের সবচেয়ে বড় সাফল্যটি হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণ। আমাদের এ অর্জন যে কোনো মাপকাঠিতেই অসাধারণ। করোনাকালে এমন অর্জনকে শুধু অসাধারণ বললে খাটো করা হয়। যদি অসাধারণের উপরে আরও কোন কিছু থেকে থাকে তবে এই অর্জনটি সেই পর্যায়েরই।

কিন্তু এ অর্জনগুলোকে ব্যর্থ আর অকার্যকর প্রমাণ করার লোকেরও কোনো ঘাটতি নেই। অন্ধকারের শক্তিগুলো এখনও একই রকম সক্রিয়। একাত্তরে জিতে গিয়ে আমরা মনে করেছিলাম আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছে। আমাদের ভুল ভেঙেছিল পঁচাত্তরে আগস্টের পনেরতে। এখন যখন আমরা আবারও ছুটছি সামনের দিকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে, তখন চারপাশে নানারকম চক্রান্ত ঘনঘটা। এই কদিন আগেই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে জাতিকে আরও একবার বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়ার সর্বাত্মক ব্যর্থ প্রয়াস আমরা দেখেছি।

Advertisement

করোনাকালে ঘুমিয়ে থাকা কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙেছে হঠাৎই, দেশে যখন করোনা ভ্যাকসিন প্রাপ্তি সুনিশ্চিত। নানা ভাবে মানুষকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা আমরা দেখেছি নানা মানুষের মধ্যে। তাদের কারও পরিচয় রাজনীতিবিদ, কারও বুদ্ধিজীবী তো কেউ এমনকি মুক্তিযোদ্ধাও। কোভিশিল্ডকে বুড়িগঙ্গার পানি থেকে মুরগির টিকা কত কিছুই না বলা হলো। অথচ নিজেদের ভালোটা বোঝার বেলায় ষোলআনা এই মানুষগুলো ঠিক ঠিকই- নিজেরা কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে নিতে একদম ভুল করেনি। এসবেরই ধারাবাহিকতায় আমরা আল জাজিরাকাণ্ডটি সংগঠিত হতে দেখলাম। এমন একটা সময় এই অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হলো যখন রাষ্ট্রীয় সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের সেনাপ্রধান আর মাত্রই একটি সেনা অভ্যুত্থানে বিপর্যস্ত প্রতিবেশী মিয়ানমার। উসকানি দেয়ার সব উপাদান আল জাজিরাকাণ্ডে একদম স্পষ্ট।

অপশক্তি এখন সক্রিয় নানা ফ্রন্টে। ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি হাইকমিশনারের সাম্প্রতিক ছুটোছুটির কারণ বুঝি, শুধু বুঝি না কীভাবে তিনি এতটা আস্কারা পান এদেশে। পাকি রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্কে গভীরতর করার আজগুবি বুলিতে মুখে খৈ কেন ফোটাচ্ছেন সেটা বুঝি, কিন্তু বুঝি না তার সাথে কি যুক্তিতে সুর মেলান দেশের বড় দুই শহরের ব্যবসায়ী নেতারা। বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান সফরের অ্যালবাম ছাপানোর কথা তিনি কেন বলছেন সেটা বুঝি, কিন্তু বুঝি না তাকে কি যুক্তিতে এই সব বাকোয়াস করার সুযোগ করে দিচ্ছে ঢাকার নামি-দামি গ্যালারি। এসব যত শুনি ততই বিবমিষা হয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জয় বাংলা হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। সেই ইতিহাস আমাদের জানা। আমরা অনেকেই অবশ্য ভুলে গেছি যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের নামটাও অল্প সময়ের জন্য হয়ে গিয়েছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্র, আর খুনি খন্দকার মোশতাকের ট্রেডমার্ক জিন্নাহ ক্যাপসদৃশ টুপিটিকে বানানো হয়েছিল বাংলাদেশের জাতিয় পোশাক। ছিয়াত্তরের ৭ মার্চ দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ধর্মীয় মাহফিলের নামে শোডাউন করে দাবি তুলেছিল বাংলাদেশের নাম, জাতীয় সঙ্গীত আর পাতাকা পরিবর্তনের। সাথে দাবি ছিল শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়ারও। আর সেই দাবিগুলোর প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন সেই সমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত জেনারেল জিয়ার উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব। আমাদের গর্বের জায়গা, ৭ মার্চ আর ১৬ ডিসেম্বরের স্মৃতিবহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ওই সময় বানানো হয়েছিল শিশুপার্ক।

আজকে যখন আমরা উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে, হেসে আমাদের স্বাধীন অস্তিত্বের ৫০তম বর্ষপূর্তির উৎসবে মাতছি, তখন ১৫ আগস্ট পঁচাত্তর আর তার পরিবর্তী ঘটনাপ্রবাহ আমাদের বিস্মৃত হলে চলবে না। আমাদের শুধু নিজেদের গৌরবগাথা প্রচার করে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না, পাশাপাশি ৪৭ পরবর্তী ২৪টি বছরে পাকিস্তানি শোষণ আর একাত্তরের ৯টি মাসে বর্বর এই রাষ্ট্রটির বাঙালির ওপর বর্বরতম নির্যাতন এবং তাদের এদেশীয় দালালদের সেদিনের ভূমিকার কথাও আমাদের একই ভাবে জোরেশোরে উচ্চারণ করতে হবে।

Advertisement

আমাদের দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করতে হবে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং তারপর যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে ভারতের ভূমিকার কথা। আমরা কেউ কেউ চীন, ভারত আর পাকিস্তানকে গুলিয়ে ফেলি। সেটা অবশ্য অস্বাভাবিকও নয়। পঁচাত্তরের পর বছরের পর বছরে আমাদের তো রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই মিথ্যা ইতিহাসই সেখানো হয়েছে। এখনও তো এদেশে এমন মুক্তিযোদ্ধা আর বুদ্ধিজীবী আছেন যারা জাতীয় প্রেস ক্লাবে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে চার ঘণ্টা অনুষ্ঠান করেন ঠিকই, কিন্তু একটিবারের জন্যও জয় বাংলা বা বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন না। আমার সংজ্ঞায় পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করা আর ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার মধ্যে ভারতীয় দালালের নয়, দেশপ্রেমিক বাঙালির পরিচয়। এ সংজ্ঞাটা আমরা আমাদের পঞ্চাশে এসে ধারণ করি আমার পঞ্চাশে আমার এমনটাই প্রত্যাশা।

লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এইচআর/ফারুক/এমকেএইচ