মতামত

ঢাকা-দিল্লির সম্পর্ক এবং মোদির সফরে প্রত্যাশা

কয়েকটি বাম ও ইসলামি সংগঠনের বিরোধিতার মুখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা সফর কিছুটা বৈরী আবহাওয়ায় শুরু হলেও সরকারের তরফ থেকে তাকে আন্তরিকভাবে বরণ করার সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ২৬ মার্চ ২০২১ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে তিনি ঢাকায় আসছেন। বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে ভারত তথা এর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নাম জড়িয়ে আছে। তাই কংগ্রেসের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ একটু আবেগপ্রবণ। দ্বিতীয়ত কংগ্রেসের অসাম্প্রদায়িক নীতিমালাও বাংলাদেশের সরকার ও অসাম্প্রদায়িক শ্রেণির মানুষের জন্য স্বস্তিদায়ক।

Advertisement

তাই বলে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক মধুর গেছে এ কথা বোধহয় জোর দিয়ে বলা যায় না। বরং অ-কংগ্রেসি সরকার দিল্লিতে ক্ষমতায় থাকতে বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর দ্রুত সমাধান হতে দেখা গেছে। আবার এটাও সত্য যে, সেসব ইস্যু সমাধানের ক্ষেত্রে কংগ্রেস সরাসরি ভূমিকা না রাখলেও তারা বিরোধিতা করেনি। যেমন- বিগত কংগ্রেস সরকার আমলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ছিটমহল বিনিময়সহ স্থলসীমান্ত চুক্তি চূড়ান্ত থাকলেও বিজেপির বিরোধিতার কারণে সেটা হয়নি। কংগ্রেসের তৈরি করা বিল বিজেপি ক্ষমতায় এসে হুবহু বাস্তবায়ন করেছে কিন্তু কংগ্রেস বিজেপির মতো বিরোধী আসনে থেকে বিরোধিতা করেনি।

বাংলাদেশ তিস্তা নদীর পানি নিয়ে ভারতের সঙ্গে ফলপ্রসূ কিছুই করতে পারছে না তবে গঙ্গার পানির জন্য ঐতিহাসিক এবং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি যখন সম্পন্ন করেছে তখনও কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল না। দেবগৌড়ার নেতৃত্বে জনতা দলের সরকার ক্ষমতায় ছিল।

যাক, গত এক দশকে ঢাকা-দিল্লির সম্পর্ক আর আগের মতো নেই। দুই দেশের সম্পর্ক যেকোনো সময়ের তুলনায় উষ্ণ এবং নিঃসন্দেহে এই সম্পর্ক বিশেষ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সহযোগিতা বড় ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরে ভারতবিরোধী কোনো শক্তিকে মাথাচাড়া দিতে দেয়নি। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটি একে একে ধ্বংস করেছে এবং বিদ্রোহী কিছু বড় বড় নেতাকে ধরে ভারত সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশ সেটি করে নিজেকে হুমকির মধ্যে ফেললেও, বাংলাদেশ তার এক ইঞ্চি মাটিও অন্য দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেবে না বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে অঙ্গীকার করেছেন, তা তিনি বাস্তবায়ন করেছেন।

Advertisement

ট্রানজিট আর ট্রান্সশিপমেন্টের বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ দ্রুত সাড়া দিয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে ভারতের দীর্ঘদিনের চাওয়া পূরণ হয়েছে। সর্বশেষ কলকাতা বন্দর দিয়ে পণ্য আনার ১৬০০ কিলোমিটারের দূরত্ব কমিয়ে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরত্বে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য আনার জন্য গত ৯ মার্চ বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির রামগড়ের সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুমকে সংযোগকারী মৈত্রী সেতু চালু করেছে। এই সেতুর মাধ্যমে ত্রিপুরা ভারতের উত্তর-পূর্ব সাতটি রাজ্যের জন্য যোগাযোগের হাব হিসেবে কাজ করবে।

দুই দেশের অমীমাংসিত সমস্যার মধ্যে স্থল ও সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হলেও আকাশসীমা চিহ্নিতকরণ বাকি রয়েছে এখনও। বারবার প্রতিশ্রুতির পরও সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামায়নি ভারত। প্রায় ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও তিস্তা চুক্তি সই হয়নি মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার অজুহাত দেখিয়ে। দুই দেশের অভিন্ন নদীর পানির চুক্তি কবে হবে, সেটা এখনো অজানা।

বর্তমানে দুই দেশের নেতারা বাংলাদেশ–ভারতের সম্পর্ককে ‘সোনালি অধ্যায়’ হিসেবে বর্ণনা করলেও নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতীয় পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাস করিয়ে এই সম্পর্ককে অস্বস্তিতে ফেলেছে। বিলের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে দেশত্যাগে উসকানি দেয়াসহ বাংলাদেশকে হিন্দু নির্যাতনকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছে মোদি সরকার। অস্বস্তির আরও কারণ দিল্লির দাঙ্গা, সারা ভারতে মুসলমানদের নাগরিকত্বহীন করার প্রচেষ্টা।

ভারতের লোকসভায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে অমিত শাহের মনগড়া কথাকার্তায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলতে বাধ্য হন যে, ‘ভারত যা বলছে তা সত্য নয়। বিশ্বের খুব কম দেশই আছে, যেখানে বাংলাদেশের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান। আমাদের কোনো সংখ্যালঘু নেই। আমরা সবাই সমান। অমিত শাহ যদি বাংলাদেশে কিছুদিন থাকেন, তিনি এখানকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ দেখতে পাবেন। ভারতের নিজেরই অনেক সমস্যা বিদ্যমান। বন্ধুদেশ হিসেবে আমরা আশা করি, ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট হয়।’

Advertisement

অনুপ্রবেশের হাস্যকর দাবি নিয়েও বাংলাদেশ মুখ খোলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অর্থনৈতিক চিন্তা করলে বাংলাদেশের মানুষ কেন ভারতে যাবে! দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী সেখান থেকে আসার আগে বলেন, ‘ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে আমাদের নিয়ে সমালোচনা হয়। কিন্তু আমি বলতে পারি, বাংলাদেশের মানুষ সমুদ্র সাঁতরে ইতালিতে যাবে, তবু ভারতে আসবে না। যেসব দেশে বাংলাদেশের মানুষ ভালো আয় করতে পারবে, সেখানে যাবে কিন্তু ভারতের মতো কম আয়ের দেশে আসবে না।’

ভারত অবশ্য বহুল আলোচিত এনআরসি বাস্তবায়ন এখন ঝুলিয়ে রেখেছে করোনার দোহাই দিয়ে। যদি এনআরসি বাস্তবায়ন করতে চায়- কী ধরনের গোলযোগে পড়তে যাবে দেশটি তারাই জানে, যেখানে অর্থনীতি, সাম্প্রদায়িকতা, কাশ্মীরসহ নানা ইস্যুতে সরকার দেশের মধ্যে চরম সমালোচিত।

যাই হোক, পত্রিকার খবর অনুসারে নরেন্দ্র মোদির সফরকালে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে একটি যৌথ ঘোষণা বিবৃতির মাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। এতে দুই দেশের সম্পর্কের আগামীর রূপরেখা থাকবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উদযাপনে যোগ দিতে ২৬ মার্চ দুদিনের সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আসছেন। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানে যোগদানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন তিনি।

সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে। বৈঠকের পর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের ব্যাপারে সহযোগিতা, পরিবেশগত সুরক্ষায় সহযোগিতা এবং দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক সহযোগিতাসহ কয়েকটি এমওইউ সই করার কথা আছে।

সফরকালে ঢাকা ও নিউ জলপাইগুড়ির মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেন সার্ভিস উদ্বোধন করা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে এ ট্রেন সার্ভিসের উদ্বোধন করবেন। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন সামনে থাকায় সেখানকার নির্বাচন কমিশন ট্রেন সার্ভিস উদ্বোধনে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় শুধু বাংলাদেশ অংশে চালানোর মাধ্যমে ট্রেন সার্ভিসের উদ্বোধন হবে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের পর এবং কোভিড-১৯ মহামারি কমলে দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত নতুন এই ট্রেন সার্ভিস চলাচল করবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমানে ঢাকা-কলকাতা এবং খুলনা-কলকাতার মধ্যে যাত্রীবাহী এবং বাংলাদেশের রোহনপুর এবং ভারতের সিঙ্গাবাদের মধ্যে মালবাহী ট্রেন সার্ভিস চালু হয়েছে।

সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল জাদুঘরের উদ্বোধন করবেন। দুই দেশের জাতির পিতাকে যৌভভাবে তুলে ধরার এবং মর্যাদা দেয়ার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্ব বহন করে। মোদি যদি বাংলাদেশের সঙ্গে এই সম্পর্ককে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে যেতে চান, তাহলে তার উচিত হবে আগামী দিনগুলোতে অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরও জোরদারের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ‘কমপ্রিহেনসিভ ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট’ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা, যার মাধ্যমে দুটি দেশ করোনা পরিস্থিতিতে উইন-উইন পরিস্থিতি তৈরি করে এগিয়ে যেতে পারে। যেখানে সেভেন সিস্টারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের বিশেষ সুযোগ রাখা যেতে পারে।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সামান্য মাত্রায় বাড়লেও ব্যবধান এখনও বিস্তর। পাশাপাশি পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে বাধা দেয়াসহ ভারত যত নন-ট্যারিফ বাধা দিচ্ছে তা দূর করা। সবচেয়ে বড় বিষয় লোক দেখানো নয়, বাস্তবে এ সম্পর্ককে এই অঞ্চলের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা। তার জন্য প্রয়োজন পরস্পরের আস্থা অর্জন, একে অন্যের আত্মমর্যাদাকে গুরুত্ব দেয়া।

তাছাড়া স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষ করে ভারতের বাইরে অন্যদের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক কী হবে তাতে নাক না গলানো। বাংলাদেশের ঘাড়ে ১০ লাখ রোহিঙ্গা। চীনের সহযোগিতা দরকার এদের ফেরাতে। চীন বিশ্বের এক নম্বর ধনী রাষ্ট্র হওয়ার পথে। বাংলাদেশের জন্য তার দুই প্রতিবেশীর সহযোগিতা দরকার। চীন-ভারতের বিরোধে বাংলাদেশকে না জড়িয়ে দুই চিরচেনা বন্ধুর সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেয়া উচিত মোদির।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।anisalamgir@gmail.com

এইচআর/বিএ/এমএস