চার পায়ায় চারটি বড় পরী। চার পরীর হাতে উড়ছে চার প্রজাপতি। আর খাটের চার কোণে চারটি মাঝারি আকারের পরী এবং দুই পাশের ঝলমে চারটি করে আটটি ছোট্ট আকারের পরী। পরী আর প্রজাপতি ছাড়াও নানা রকমের নকশায় তৈরি করা হয়েছে ‘পরী পালং খাট’।
Advertisement
সেগুন কাঠের তৈরি এ খাটটি বানিয়েছেন খাগড়াছড়ির গুইমারার স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক মো. নুরুন্নবী। নান্দনিকতার ছোঁয়ায় তিন বছর দুই মাসে খাটটি পরিপূর্ণ করে তোলেন আবু বক্কর ছিদ্দিক ওরফে কাঞ্চন মিস্ত্রি।
প্রায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি করা এ খাটের কোনো নকশা বা ক্যাটালগ ছিল না। নিজের মনের আবেগ আর ভালোবাসায় খাটটির নকশা তৈরি করেছেন কাঞ্চন মিস্ত্রি। খাটটি তৈরি করতে স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ী মো. নুরুন্নবীর কাছ থেকে সাড়ে নয় লাখ টাকা মজুরি নিয়েছেন তিনি।
খাটের মিস্ত্রি আবু বক্কর ছিদ্দিক ওরফে কাঞ্চন
Advertisement
‘পরী পালং খাট’ তৈরির বিষয়টি এরইমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়েছে। খাটটি দেখতে প্রতিদিনই নানা বয়সী মানুষ ভিড় করছেন নুরুন্নবীর বাড়িতে। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আসছেন অনেকে।
কথা হয় খাগড়াছড়ি থেকে আসা ব্যবসায়ী মো. আব্দুল গফুরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘খাটটির কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জেনেই শখের বসে দেখতে এসেছি। এমন খাট জীবনে প্রথম দেখলাম।’
খাটটি তৈরি করতে যে পরিমাণ অর্থ ও শ্রম গেছে তা অবিশ্বাস্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একজন সৌখিন মানুষের পক্ষেই এটা তৈরি করা সম্ভব।’
মাটিরাঙ্গার বাসিন্দা মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘এ খাট রুচিবোধের বহিঃপ্রকাশ। শুধু অর্থ থাকলেই এমন একটি নান্দনিক খাট তৈরি সম্ভব নয়।’
Advertisement
গুইমারা ইউনিয়ন পরিষদের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ফার্নিচার মিস্ত্রি আবু বক্কর ছিদ্দিক যা করেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এ খাট তৈরিতে অর্থ বিনিয়োগ করার মাধ্যমে মো. নুরুন্নবী তার সুন্দর মনের পরিচয় দিয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন বলেন, ‘পরী পালং খাট’ গুইমারাকে দেশবাসীর কাছে নতুন করে পরিচিত করে তুলেছে। কাঞ্চন মিস্ত্রির এমন প্রতিভা আছে এই খাট না দেখলে জানা হতো না। তার এই কাজ মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
গুইমারার মুসলিমপাড়ার বাসিন্দা ফার্নিচার মিস্ত্রি কাঞ্চন ২০১৭ সালের দিকে নুরুন্নবীর ইচ্ছায় খাটটি তৈরির কাজ শুরু করেন। তিন বছর দুই মাস পরিশ্রমের পর খাটি তৈরির কাজ শেষ করেন।
চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়া ফার্নিচার মিস্ত্রি আবু বক্কর ছিদ্দিক ওরফে কাঞ্চন মিস্ত্রি ১৪ বছর বয়সে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় একটি ফার্নিচার দোকানের সহকারী হিসেবে এ পেশায় কাজ শুরু করেন। চার বছরের মাথায় নিজেই মিস্ত্রি হয়ে যান। পরে তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাঙামাটিতে বিভিন্ন ফার্নিচার দোকানে কাজ করেন। সর্বশেষ কুষ্টিয়ার একটি ফার্নিচার দোকানে কাজ শেষে নিজের জন্মভূমি খাগড়াছড়ির গুইমারা বাজারে কাজ শুরু করেন।
কাঞ্চন মিস্ত্রি জানান, খাটটি তৈরিতে প্রায় একশ ফুট কাঠ লেগেছে। এ খাটের নকশা তৈরি থেকে শুরু করে তিনি একাই সব কাজ করেছেন। তার কোনো সহযোগী ছিল না। তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল নিজের মনের মতো করে একটি খাট তৈরি করার। কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক ছিল। একসময় তার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসেন সৌখিন মানুষ মো. নুরুন্নবী।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ নেতা নুরন্নবী জানান, ব্যতিক্রমী কিছু করার অভিপ্রায় থেকেই কাঞ্চন মিস্ত্রিকে দিয়ে একটি ভিন্ন মাত্রার খাট তৈরির পরিকল্পনা করেন সৌখিন ব্যবসায়ী মো. নুরুন্নবী। কথাবার্তা চূড়ান্ত হওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে কাঠ সংগ্রহ শুরু করেন তিনি। কাজ শুরু করার তিন বছর দুই মাস পর তার স্বপ্নের পূর্ণতা লাভ করে।
ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থেকেই খাটটি তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারির কারণে এখন আর তা হচ্ছে না। তবে স্থানীয়ভাবে একটি প্রদর্শনী করার ইচ্ছে থাকলেও বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় সে চিন্তাও বাদ দিয়েছি।’
পার্বত্য চট্টগ্রামের পিউর সেগুন কাঠ দিয়ে তৈরি করা খাটটির দাম এক কোটি টাকা চেয়েছেন জানিয়ে নুরন্নবী বলেন, ‘এরই মধ্যে ঢাকার এক সাবেক সরকারী কর্মকর্তা তার বাড়িতে এসে খাটটি দেখে ৭০ লাখ টাকা দাম বলেছেন। খাটটি বিক্রির পরে যে অর্থ লাভ হবে তার একটি অংশ নিজে রেখে অন্য অংশ আর্তমানবতার সেবায় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দিয়ে দিব।’
মুজিবুর রহমান ভুইয়া/এসজে/এএসএম