তিনি ছিলেন বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম স্বাধীন করতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। ছিলেন আলম গ্রুপের লিডার। তার অসীম সাহস ও বীরত্ব নেতৃত্ব দিয়েছিল অনেক সফল অপারেশনের। সেসব অজানা ছিল।
Advertisement
অজানা ছিল ১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর বোর্ড রাজাকার ক্যাম্পে অপারেশনের সময় রহস্যজনকভাবে তার শহীদ হওয়ার গল্প। সেইসব অজানা গল্প অনুসন্ধান করে বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিআলম চৌধুরীকে সবার সামনে তুলে এনেছেন তার ভাতিজি মারজান বেগম।
রক্ত কথা বলে, বোধহয় এটাকেই বলে। মহিআলমের মতো বীরকে তো পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। তার ইতিহাসও মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে পাকিস্তানি দোসররা। কে ভেবেছিল কোনো উত্তরসূরি না থাকা এই নায়ককে ঠিকই জাতির সামনে তুলে ধরবে কেউ একদিন?
মানুষ যা ভাবে না তাই হয় প্রকৃতির খেয়ালে। মহিআলম চৌধুরীর ভাতিজি মারজান বেগমের বয়স তখন সাত কি বা আট। ক্লাস থ্রিতে পড়েন। মায়ের কাছে গল্প শুনেছেন তার চাচা বিরাট বড় যোদ্ধা ছিলেন। তিনি নাকি বীরদেরও বীর। স্কুলে যখন তার কাছে বীরশ্রেষ্ঠদের নাম জানতে চাইলেন শিক্ষক তিনি সাত বীরশ্রেষ্ঠ'র সঙ্গে তার চাচার নামও বলে দিলেন।
Advertisement
ক্লাসে সবাই তখন হেসেই খুন। ভীষণ লজ্জা পেলেন মারজান। সেদিন থেকেই তিনি নেমে গেলেন চাচার বীরত্বের গল্প অনুসন্ধান করতে। তার কচি মনে প্রশ্ন জেগেছিল তার চাচা এতোই যদি বীর হন তবে সেটা সবাই জানে না কেন? সত্যটা কী? তার চাচা কোথায় শহীদ হয়েছেন? কীভাবে? কোথায় আছে তার কবর।
পারিবারিক একটি ছবির সূত্র ধরে তিনি নেমে পড়েন নতুন যুদ্ধে। চাচার বীরত্বের গল্প দুনিয়াবাসীকে জানিয়ে তার স্বীকৃতি আদায়ের সেই যুদ্ধ; তিনি সফলও হলেন দীর্ঘ ৩০ বছরেরও বেশি সমর পর।
২০১৯ সালে মধ্যবয়সী মারজান খবর পান চট্টগ্রামে বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর বোর্ড রাজাকার ক্যাম্পে অপারেশনের সময় রহস্যজনকভাবে তার চাচা শহীদ হয়েছেন। সেই গল্প উদ্ধার করতে তিনি স্বামী ও এক পুত্রকে নিয়ে সেখানে হাজির হন।
সাহায্য নেন স্থানীয় চেয়ারম্যানের। খুঁজে বের করেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের। সবাই মিলে অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হলেন মারজানের চাচা মহিআলম চৌধুরীই সেই বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধাদের দল ‘আলম গ্রুপ’র লিডার।
Advertisement
তারপর যেসব তথ্য জানলেন তা যেমন ভাতিজি হিসেবে গর্বিত করেছে মারজানকে তেমনি ঝরিয়েছে চোখের জল। তার চাচা সত্যিই বীর! মায়ের শোনানো গল্প মিথ্যা নয়। বরং যে দেশকে স্বাধীন করতে জীবন দিয়ে গেলেন তার চাচা সেই দেশ ও দেশের মানুষ জানতেই পারেনি এতদিন অনাদরে চট্টগ্রামের এক জঙ্গলে ঘুমিয়ে আছেন জাতির সূর্যসন্তান মহিআলম চৌধুরী।
সহযোদ্ধারা শোনালেন মহিআলমের বীরত্বের নানা গল্প। কীভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে বুকে ধারণ করেছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে। কেমন করে পাকিস্তানি শত্রুদের বধ করতে মরিয়া ছিলেন এই শহীদ যোদ্ধা। মৃত্যুর আগে একবারের জন্যও ভাবেননি মৃত্যু নিয়ে। এভাবেই সম্মুখযুদ্ধে দেশের জন্য বিলিয়ে দিয়ে গেছেন জীবনটাও।
মহিআলম চৌধুরীর এই বীরত্বমাখা যুদ্ধ ও তার যোগ্য ভাতিজি মারজান বেগমের অনুসন্ধানের হৃদয় ছোঁয়া যুদ্ধের গল্পকে একটি গল্প বানিয়ে দেশের জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল দীপ্ত টিভি তৈরি করেছে ডকুড্রামা। ‘দুইটি যুদ্ধের একটি গল্প’ শিরোনামের এই প্রামাণ্যচিত্রটি পরিচালনা করেছেন চ্যানেলটির সিইও ফুয়াদ চৌধুরী।
আজ বুধবার (২৪ মার্চ) এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ডকুড্রামাটি প্রচার হবে আগামী ২৬ মার্চ রাত ১১টায়।
এই ড্রামায় মহিআলম চৌধুরীর চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যাবে তরুণ অভিনেতা রিয়াদ রায়হানকে। তার ভাজিতি মারজান বেগমের চরিত্রে দেখা যাবে অহনা মিথুনকে। আরও অভিনয় করেছেন সাইদুর রহমান পাভেল, মির্জা শাখেছেপ শাকিব, জয়শ্রী মজুমদার লতা ও চট্টগ্রামের নান্দিমুখ থিয়েটারের একদল নাট্যকর্মী।
প্রামাণ্যচিত্রটি রচনা করেছেন ফাহমিদুর রহমান। লাইন প্রডিউসার হিসেবে ছিলেন ফাহাদ হোসেন এবং এর অ্যাসোসিয়েট প্রডিউসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন রওশন জাহান নূপুর।
সম্মেলনে প্রামাণ্যচিত্রটির পরিচালক ফুয়াদ চৌধুরী বলেন, ‘বেশ ক’জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার ও নাটকীয় দৃশ্যায়নের মাধ্যমে নির্মিত হয়েছে ‘দুইটি যুদ্ধের একটি গল্প’। শহীদ সার্জেন্ট মহিআলম চৌধুরীর মহান আত্মত্যাগকে মূল উপজীব্য রেখে মারজান বেগমকে একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি আদায় করতে গিয়ে যে আরেক যুদ্ধ করতে হয়েছে সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।’
‘মারজান বেগম রক্তের টানে শহীদ মহিআলম চৌধুরীর বীরত্বকে আমাদের সামনে তুলে এনেছেন। দেশের জন্য, ন্যায়ের জন্য জীবন দান করলে সেটা যে বৃথা যায় না এ গল্প তার প্রমাণ। এখন আমরা চাইবো রাষ্ট্র ও সরকার এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে তার প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা ফিরিয়ে দেবে’- যোগ করেন ফুয়াদ চৌধুরী।
তিনি জানান বেশকিছু আনন্দের খবরও। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এরই মধ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদ সার্জেন্ট মহিআলম চৌধুরীকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় খোঁজখবর করে যা তাদের করণীয় তা করছে। স্থানীয়রাও এ যোদ্ধার ব্যাপারে এখন আন্তরিক। তাকে নিয়ে নিয়মিত স্মরণসভা হচ্ছে। তার স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। রাস্তাঘাটের নামকরণ করা হচ্ছে তার নামে।
শুধু তাই নয়, বাঁশখালী উপজেলায় একটি বিশাল কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানে নিয়ে আসা হবে এই বীরের কবর। এদিকে বিমান বাহিনীর সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে।
যেহেতু মহিআলম চৌধুরী এই বাহিনীর একজন সার্জেন্ট ছিলেন তাই সেখান থেকেও তিনি যেন সম্মানিত হন সেই চেষ্টা করা হবে। আশা করি আরও অনেক পরিকল্পনা নেয়া হবে সরকারের পক্ষ থেকে। সবচেয়ে বেশি দরকার জাতি হিসেবে আমাদের তার সম্পর্কে জানা, তার অবদান স্মরণ করা।’
এই প্রামাণ্যচিত্রে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী, কবি আসাদ চৌধুরী। তারা দুজনই শহীদ মহিআলম চৌধুরীর পরিবারেরই সন্তান।
এলএ/এমএস