মতামত

কিশোর অপরাধ বাড়ছে কেন?

মনিরা নাজমী জাহান

Advertisement

পল্লীকবি জসীমউদদীন তার তরুণ কিশোর নামক কবিতায় লিখেছেন : তরুণ কিশোর ! তোমার জীবনে সবে এ ভোরের বেলা,ভোরের বাতাস ভোরের কুসুমে জুড়েছে রঙের খেলা।

আজ আমরা আলোচনা করবো সেই কিশোরদের কে নিয়ে যারা অতিক্রম করছে তাদের বয়ঃসন্ধি কাল। যেই বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের আচরণ পরিবর্তিত হয় এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনা পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক অবক্ষয়, সমাজ পরিবর্তন এবং সমাজের নানাবিধ অসঙ্গতি এবং অস্বাভাবিকতায় অনেক সময় খেই হারিয়ে ফেলে সেই উন্মাদনা অবক্ষয়ে রুপ নেয়। অপরাধের পথে পা বাড়ায় সেই কিশোরদের কেউ কেউ। যে বয়সে তাদের চপলতা, উচ্ছ্বাসে মেতে থাকার কথা সেই বয়সে তারা জড়িয়ে পরে বিভিন্ন অপরাধে। নিজেদের হারিয়ে ফেলে অপরাধের চোরাগলিতে। কখনো কি আমরা চিন্তা করেছি, কেন একজন কিশোর জড়িয়ে পড়ছে অপরাধের ভয়ংকর জগতে? একজন কিশোরের ভুল পথে পরিচালিত হবার দায় কার?

একজন কিশোরের এই ভুল পথে পা বাড়ানোর দায় পরিবার, সমাজ , রাষ্ট্র কেউ এড়াতে পারে না। এই দায় পরিবার সমাজ রাষ্ট্র সবার উপর সমভাবে বর্তায়। ভুলে গেলে চলবে না যে কেউ জন্মগত ভাবে অপরাধী হয়ে জন্মায় না বরং বিভিন্ন পরিবেশ,বিভিন্ন পরিস্থিতি,বিভিন্ন ঘটনা তাকে অপরাধের রাস্তায় ধাবিত করে।

Advertisement

পরিবারের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে যদি আমরা দেখি তাহলে দেখবো। পুঁজিবাদের এই যুগে অনেক অভিভাবকরাই উর্ধ্বশ্বাসে অর্থ , বিত্ত , প্রতিপত্তি, ক্ষমতা প্রভৃতির পিছনে ছুটছেন। তারা ব্যস্ততার কারণে সন্তানের সাথে সময় কাটাতে পারছেন না। একাকীত্ব নিঃসঙ্গতা হতাশা জেঁকে বসছে সন্তানের মনে। এই হতাশা থেকে উত্তরণের জন্য সন্তান ঝুকে পড়ছে আকাশ সংস্কৃতি এবং ইন্টারনেটের দিকে। যেহেতু প্রতিটি প্রযুক্তির মত এই আকাশ সংস্কৃতি এবং ইন্টারনেটের রয়েছে কিছু অকল্যাণকর দিক এবং পরিবারের সদস্যদের নির্দেশনা দেবার মত সময় নেই তাই তারা সঠিক নির্দেশনার অভাবে জড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেট ভিত্তিক বিভিন্ন গ্যাং কিংবা মাদক কেন্দ্রিক কোন গ্রুপে।

শুধু মাদক বা গ্যাং কালচার নয় ইন্টারনেট কে কেন্দ্র করে আরও বিভিন্ন প্রকার সাইবার ক্রাইমে জড়িয়ে পড়ছে তারা। আরেকটি কু প্রভাব কিশোরদের বিপথগামী করে তুলছে তা হচ্ছে আকাশ সংস্কৃতির কু প্রভাব। সম্প্রতি গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা জেনেছি ক্রাইম পেট্রোল নামের বিদেশী এক চ্যানেলে প্রচারিত একটি প্রোগাম থেকে বিভিন্ন কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার গল্প।

অথচ দুঃখের বিষয় হচ্ছে পরিবার থেকে সঠিক প্যারেন্টিং পেলে হয়ত অপরাধে জড়িয়ে পরা কিশোরটি বিপথগামী হতো না। অভিভাবকের সঠিক নির্দেশনা অনেক ক্ষেত্রে একজন কিশোরকে বিপথগামী পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট ।

সমাজের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে যদি আমরা দেখি তাহলে দেখবো, সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ধর্মীয় মহাফিলের নামে চলছে অন্য ধর্ম, গোত্র বর্ণের মানুষের প্রতি ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ানোর প্রতিযোগিতা, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরে। যে কিশোরটি এই ধরনের সমাজে বেড়ে উঠবে খুব স্বাভাবিক ভাবে তার মধ্যে উগ্র সাম্প্রদায়িক চর্চা বেড়ে যাবে। অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণার বিষবাষ্প তার মধ্যেও লালিত হতে থাকবে ফলশ্রুতিতে সেই কিশোরটি জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদের মত ভয়াবহ অপরাধে।

Advertisement

আমরা হলি আর্টিসানের ঘটনার সময় দেখেছি কিশোরদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পরার করুন পরিনতি। আমাদের সমাজের আরেকটি ভয়াবহ দিক একজন কিশোরকে অপরাধে উৎসাহিত করে। আমাদের সমাজে যখন কোন নারীর প্রতি সহিংসতা ঘটে তখন সমাজের এক শ্রেণির মানুষ সেই নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংসতাকে বৈধতা দিতে উঠে পরে লেগে যায়। বিভিন্ন অজুহাতে সেই সহিংসতা কে বৈধতা দিতে চেষ্টা করে।

যখন একটি সমাজে কোন অপরাধ কে বৈধতা দিবে তখন স্বাভাবিক ভাবে সেই সমাজে বড় হতে থাকা কিশোরটি সেই অপরাধের দিকে ঝুকে পড়বে। সেই সুত্র ধরেই আমরা দেখি আমাদের কিশোররা নারীর প্রতি বিভিন্ন রকম সহিংসতার দিকে ঝুকে পড়ছে। একটি সমাজে যখন বিভিন্ন অজুহাতে সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ করে দেয়া হয়। যখন পাঠাগার, খেলার মাঠ, পার্ক বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন সেই সমাজের কিশোরেরা স্বভাবতই হতাশাগ্রস্ত হয়ে যায় এই হতাশা তাদের মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধের দিকে ধাবিত করে।

রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার দিক থেকে চিন্তা করলে সবার আগে যে বিষয়টি উল্লেখ করতে হবে তা হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আমরা প্রায়ই দেখতে পাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তে শক্তি প্রদর্শনের অস্ত্র হিসেবে কিশোরদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক সময় অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কে দিয়ে রাজনৈতিক কর্মসুচিতে ভাংচুর , বোমাবাজিসহ বিভিন্ন নাশকতা মূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়। একটি রাষ্ট্রের এই ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রভাবে কিশোরের বিপথে পা বাড়ায়।

এবার আসা যাক একজন কিশোর যখন কোন ভুল করে তখন তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করে সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। এই ধরনের সংশোধনাগারে পাঠানোর উদ্দেশ্য থাকে যেন কিশোরটি তার ভুল বুঝতে পেরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে এই সংশোধনাগারে পরিবেশ এতই ভয়াবহ যে একজন কিশোর সংশোধন হওয়া তো দুরের কথা বরং সেখানে গিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টার মত ভয়াবহ ঘটনাও আমরা দেখতে পাই।

কিশোর অপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে প্রবেশনারি অফিসার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ আমাদের দেশের নেই পর্যাপ্ত প্রবেশনারি অফিসার। শিশু আইন ২০১৩ এর ৪৪ ধারা অনুযায়ী শিশুদের গ্রেফতারের পর হাতকড়া পরানো বা কোমড়ে বেড়ি বা রশি ইত্যাদি পরানো নিষেধ এবং বলা হয়েছে গ্রেফতারের পর থেকে আদালতে হাজির করা পর্যন্ত শিশুকে প্রাপ্তবয়স্ক বা ইতোমধ্যেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এইরূপ কোন শিশু বা অপরাধী এবং আইনের সংস্পর্শে আসা কোন শিশুর সাথে একত্রে রাখা যাবে না। আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বিষয়গুলো আসলে কতটুকু মানা হচ্ছে তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

সব শেষে বলা যায় আজকের কিশোরে আগামী দিনের নেতৃত্ব দিবে তাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে কিশোরদের বিষয়ে রাষ্ট্র ,সমাজ, অভিভাবক সকলকে সচেতন হতে হবে। কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের জন্য ‘অলটারনেটিভ মেজারস’ বা ‘বিকল্প ব্যবস্থা’র ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।

লেখক : শিক্ষক , আইন বিভাগ , ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/জেআইএম