মতামত

সচেতনতায় এড়ানো যায় যক্ষ্মা

ডা. আয়শা আক্তার

Advertisement

আগে যক্ষ্মা বা টিবি রোগের নাম শুনলেই এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ত। সেই রোগীর ত্রিসীমানায় কেউ সহেজে যেত না। কিন্তু এখন চিকিৎসায় এ রোগ সহজেই সারিয়ে ফেলা যায়।

যক্ষ্মা’ শব্দটা এসেছে ‘রাজক্ষয়’ থেকে। ক্ষয় বলার কারণ এতে রোগীরা খুব শীর্ণ (রোগা) হয়ে পড়েন। যক্ষ্মা প্রায় যে কোনো অঙ্গে হতে পারে (ব্যতিক্রম কেবল হৃৎপিণ্ড, অগ্ন্যাশয়, ঐচ্ছিক পেশি ও থাইরয়েড গ্রন্থি)। যক্ষ্মা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ফুসফুসে। এটি সংক্রামক রোগ, যার কারণ মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস নামের জীব।

যক্ষ্মা এড়াতে সবচেয়ে বেশি জরুরি সচেতনতা। একদম ছোট থেকেই সচেতন থাকা উচিত। ছোট থেকেই ঘন ঘন হজমের সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া দরকার। রোগী প্রাপ্তবয়স্ক হলে, তার ব্লাড সুগার বা এইচআইভি রয়েছে কি-না, তা দেখে নেয়া দরকার। কারণ তাদের মধ্যে সহজে টিবিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা প্রয়োজন।

Advertisement

প্রায়ই বুকে ব্যথা হলে সাবধান হোন। এর থেকে হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে। যক্ষ্মা শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও প্রভাব ফেলে। যেমন পিঠে ও কোমরে ব্যথা। এছাড়া কিডনিতেও প্রভাবে ফেলে। তাই প্রস্রাবে রক্ত গেলে অবশ্যই সাবধান হোন।

সর্দি কাশি হলে কেউই সেভাবে গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু অনবরত কাশি হওয়া এবং তার সঙ্গে রক্ত যাওয়া যক্ষ্মার অন্যতম উপসর্গ। ক্ষুধা না পাওয়াও অন্যতম উপসর্গ। কিন্তু বহু দিন ধরে ক্ষুধা না পেলে দ্রুত ডাক্তার দেখান।

হঠাৎ রাতে ঘেমে গেলে সাবধান হোন। অনেকেই আবহাওয়ার কারণে গরম লাগছে ভেবে এড়িয়ে যান। কিন্তু নিয়মিত রাতে ঘুমানোর সময় ঘাম হলে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যান।

ফুসফুসে যক্ষ্মা হলে হালকা জ্বর ও কাশি হতে পারে। কাশির সঙ্গে গলার ভেতর থেকে থুতুতে রক্তও বেরোতে পারে। মুখ না ঢেকে কাশলে যক্ষ্মা সংক্রমণজনিত থুতুর ফোঁটা বাতাসে ছড়ায়। আলো-বাতাসহীন অস্বাস্থ্যকর বদ্ধ পরিবেশে মাইকোব্যাক্টেরিয়াম অনেকক্ষণ বেঁচে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট হিসেবে ৫-৬ মাস জ্বর থাকার মূল কারণ এই যক্ষ্মা।

Advertisement

যক্ষ্মা ফুসফুস থেকে অন্যান্য অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের এবং বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। তখন একে ‘অ-শ্বাসতন্ত্রীয় যক্ষ্মা’ (Extrapulmonary Tuberculosis) বলা হয়, যেমন প্লুরাতে প্লুরিসি, কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে মেনিনজাইটিস, লসিকাতন্ত্রে স্ক্রফুলা, প্রজননতন্ত্রে প্রজননতন্ত্রীয় যক্ষ্মা, পরিপাকতন্ত্রে পরিপাকতন্ত্রীয় যক্ষ্মা এবং অস্থিকলায় পট’স ডিজিস। বিশেষ ধরনের ছড়িয়ে যাওয়া যক্ষ্মাকে বলা হয় মিলিয়ারি যক্ষ্মা (Miliary tuberculosis)। অনেক ক্ষেত্রে ফুসফুসীয় এবং অ-ফুসফুসীয় যক্ষ্মা একসঙ্গে বিদ্যমান থাকতে পারে। পৃথিবীর যক্ষ্মা রোগীদের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি (প্রায় অর্ধেক) ভারতীয় উপমহাদেশের।

যেভাবে যক্ষ্মা ছড়ায়যক্ষ্মার জীবাণু বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে জীবাণু বাতাসে মিশে এবং রোগের সংক্রমণ ঘটায়।

কারা বেশি ঝুঁকিতেযক্ষ্মা রোগীর কাছাকাছি থাকেন এমন লোকজন—যেমন, পরিবারের সদস্য, চিকিৎসক, নার্স বা সেবা-শুশ্রূষাকারীর আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, মাদকাসক্তি, বার্ধক্য, অপুষ্টি ইত্যাদির কারণে যক্ষ্মার ঝুঁকি থাকে। আবার যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম—যেমন, এইডস রোগী, দীর্ঘ মেয়াদে স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধসেবী মানুষের যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

সাধারণ লক্ষণঅস্বাভাবিকভাবে ওজন হ্রাস পাওয়া, অবসাদ অনুভব করা, জ্বর, রাতে ঘাম হওয়া, কাপুনি, ক্ষুধা মন্দা প্রধানত যক্ষ্মার লক্ষণ। এছাড়া তিন সপ্তাহ বা এর অধিক সময় ধরে কাশি, কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া, বুকে ব্যথা অথবা শ্বাস নেয়ার সময় ও কাশির সময় ব্যথা হওয়াও যক্ষ্মার লক্ষণ।

যক্ষ্মা প্রতিরোধে করণীয় > জন্মের পর পর প্রত্যেক শিশুকে বিসিজি টিকা দেয়া > হাঁচি-কাশির সময় রুমাল ব্যবহার করা> যেখানে সেখানে থু থু না ফেলা > রোগীর কফ থুথু নির্দিষ্ট পাত্রে ফেলে তা মাটিতে পুঁতে ফেলা।

জীবাণু গেলেই যক্ষ্মা হয় নাশরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা যক্ষ্মার জীবাণুকে ধ্বংস করতে পারে। এ জীবাণু সাধারণত কাশির মাধ্যমেই ছড়ায়। অনেক সময় যক্ষ্মা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। পরবর্তী সময়ে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে গেলে তা প্রকাশ পেতে পারে। আবার অনেক সময় যক্ষ্মার জীবাণু দ্রুত শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে যায় ও জটিল আকার ধারণ করে।

কখন ডাক্তার দেখাবেনযক্ষ্মার লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

কোথায় চিকিৎসা করাবেনদেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি ক্লিনিক/হাসপাতাল, নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র, এনজিও ক্লিনিক ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিনামূল্যে কফ পরীক্ষা, রোগ নির্ণয়সহ যক্ষ্মার চিকিৎসা ও ওষুধ দেয়া হয়।

কী ধরনের চিকিৎসা আছেডটস পদ্ধতিতে অর্থাৎ স্বল্পমেয়াদী, সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা করা হয়। এজন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোগের ধরন, মাত্রা এবং রোগীর বয়স অনুসারে ওষুধের কোর্স সম্পূর্ণ করতে হবে।

লেখক : সহকারী পরিচালক, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতাল, শ্যামলী, ঢাকা

এএইচ/এইচএ/জেআইএম