জাতীয়

করোনার বছরে নতুন যক্ষ্মা রোগী তিন লাখ

এক সময় বহুল প্রচলিত প্রবাদ ছিল ‘যার হয় যক্ষ্মা, তার নেই রক্ষা’। সময়ের পরিক্রমায় আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বদৌলতে যক্ষ্মা চিকিৎসায় কার্যকর ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলে পুরোনো প্রবাদ এখন নিছক গল্প। বর্তমানে বাস্তবতা হলো- দ্রুত শনাক্ত ও চিকিৎসা নিলে যক্ষ্মা রোগ সম্পূর্ণভাবে নিরাময় হয়, মৃত্যু ঝুঁকি থাকে না বললেই চলে।

Advertisement

দেশে গত এক দশকে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু ৫৬ শতাংশ কমেছে। ২০১০ সালে যক্ষ্মায় আক্রান্ত প্রতি এক লাখ রোগীতে মৃত্যু হতো ৫৪ জনের। এক দশক পর ২০২০ সালে এ সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ২৪ জনে। শতাংশের হিসেবে এক দশকে যক্ষ্মা রোগীর মৃত্যু কমেছে ৫৬ শতাংশ।

২০২০ সালে দেশে নতুন রোগী শনাক্ত হয় দুই লাখ ৯২ হাজার ৯৪০ জন। চিকিৎসা নিরাময়ের হার গত ১০ বছর যাবত ৯৫ শতাংশ থাকলেও করোনার বছরে নিরাময় হার এক শতাংশ বেড়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত নানা পরিসংখ্যান তুলে ধরে এসব তথ্য জানান।

Advertisement

তারা জানান, ২০২০ সালে যক্ষ্মার উপসর্গ আছে বা সম্ভাব্য উপসর্গ আছে এমন ২৭ লাখ রোগীকে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আগাম পরীক্ষার ফলে রোগ চিহ্নিত ও দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আসার ফলে গত দশকে প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়।

এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশে বুধবার (২৪ মার্চ) বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালিত হবে। আন্তর্জাতিকভাবে এ বছর যক্ষ্মা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘কি ক্লক ইজ টিকিং, ইটস টাইম টু কিপ আওয়ার প্রমিসেস, ইটস টাইম টু এন্ড টিবি’।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশে এবারের যক্ষ্মা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘মুজিববর্ষের অঙ্গিকার যক্ষ্মা মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার’।

করোনার কারণে রাজধানীসহ সারাদেশে এ বছর সীমিত পরিসরে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালিত হবে। আগামীকাল (বুধবার) রাজধানীর শ্যামলীর ২৫০ শয্যা টিবি হাসপাতালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শোভাযাত্রা, জনসচেতনতামুলক পোস্টার, লিফলেট বিতরণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।

Advertisement

যক্ষ্মার ইতিহাস ও বাংলাদেশের অবস্থান

যক্ষ্মার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৮৮২ সালে ২৪ মার্চ ডা. রবার্ট কক যক্ষ্মা রোগের জীবাণু মাইক্রোব্যাটেরিয়াম টিউবারকিউলসিস আবিষ্কার করেন। যক্ষ্মা রোগের জীবাণু আবিষ্কারের ১০০ বছর পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জীবাণু আবিষ্কারের দিনটিকে স্মরণীয় করা ও যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর ২৪ মার্চ বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালিত হচ্ছে।

যক্ষ্মা বাংলাদেশের জন্য একটি অন্যতম মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের উচ্চ যক্ষ্মা-প্রবণ ৩০টি দেশে ৮৭ শতাংশ যক্ষ্মা রোগী রয়েছে। তন্মধ্যে শীর্ষ যক্ষ্মা আক্রান্ত আটটি দেশে মোট যক্ষ্মা রোগীর দুই তৃতীয়াংশ রোগী রয়েছে। এ আটটি দেশ হলো- ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ফিলিপাইন, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকা।

যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক যা বললেন

স্বাস্থ্য অধিদফতরের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম সাদি জানান, ১৯৯৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যক্ষ্মাকে গ্লোবাল ইমার্জেন্সি ঘোষণার পর থেকেই সরকার ও কিছু বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশে যক্ষ্মার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

বর্তমানে স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি যক্ষ্মা নির্মূলে ও যক্ষ্মার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার দেশের সব নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে যক্ষ্মা শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা প্রদান করছে।

যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা, মৃত্যু ও সংক্রমণের হার হ্রাস করাই এসব কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০১৫ সালের পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যক্ষ্মা মহামারিকে আলোকপাত করতে নতুন কৌশল অনুমোদন করে, যাতে ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে যক্ষ্মা রোগের মৃত্যুহার ৯৫ শতাংশ (বেজ লাইন ২০১৫ সালের তুলনায়) কমাবে এবং নতুনভাবে সংক্রমিত যক্ষ্মা রোগীর হার ৯০ শতাংশ (বেজ লাইন ২০১৫ সালের তুলনায়) কমিয়ে আনবে।

রাজধানীর শ্যামলীতে ২৫০ শয্যার বিশেষায়িত যক্ষ্মা হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার জানান, সম্প্রতি বিশেষায়িত এ হাসপাতালে ওয়ান স্টপ টিবি সেন্টার উদ্বোধন হয়েছে। এ কার্যক্রমের আওতায় যক্ষ্মা রোগীদের উন্নত চিকিৎসা সেবা, বায়োসেইফটি লেবেল-২ ল্যাবরেটরি স্থাপন, ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগীদের ভর্তির ব্যবস্থা ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, দেশে সরকার বিনামূল্যে যক্ষ্মা রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করছে। দ্রুত শনাক্ত হলে এ রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, জনসচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

এমইউ/এআরএ/এএএইচ