আতি-উন-নাহার
Advertisement
বাংলা গদ্যের ইতিহাস মাত্র দুশ বছর। এত অল্প সময়ে বাংলা গদ্য মননশীল ও সৃজনশীল হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষা সাহিত্যচর্চার গতিশীল বাহন হয়ে ওঠার পেছনে যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য; তাঁরা হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর দুই দিকপাল। আলোচনার প্রথম অংশে আছে গদ্যশিল্পী বঙ্কিমের বাংলা ভাষা-চিন্তা এবং দ্বিতীয় অংশে ভাষাবিজ্ঞানী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষা-পরিকল্পনার ভাবধারা। এখানে ‘সংস্কৃতায়ন’ বলতে বোঝানো হয়েছে, কিভাবে বাংলা ভাষায় প্রচুর সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করে ভাষাকে সাধারণের অবোধগম্য করে তোলা হয়েছে।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে ইংরেজ রাজত্বে বাংলা গদ্যের বিকাশ ঘটেছিল। নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড, উইলিয়াম কেরী প্রমুখ বিদেশি পণ্ডিতবর্গ তৈরি করেছিলেন বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও অন্যান্য গদ্যরচনা। তাঁরা সংস্কৃত ভাষা রপ্ত করেছিলেন বেশ ভালো করেই। এ শতাব্দীর অন্যসকল পণ্ডিত-মুন্সী সকলেই বিশ্বাস করতেন বাংলা সংস্কৃতের সন্তান। বাংলা ভাষার উৎস সম্পর্কে সংস্কৃত পণ্ডিতদের মতো বঙ্কিমচন্দ্রের বিশ্বাসও ছিল মোটামুটি একই। উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার বাংলা ভাষা-ভাষি উচ্চ শ্রেণিতে (এলিট শ্রেণি) এ ধরনের মনোভাব থেকেই বাংলা গদ্যের চর্চা চলছিল। বস্তুত কলকাতার শিক্ষিত সমাজে বাংলা ভাষার ‘সংস্কৃতায়নের’ প্রক্রিয়াটি চলছিল ব্যাপকভাবে। ঠিক এই সময়ে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। তখন কলকাতার শিক্ষিত মহলে বাংলা ভাষা বিষয়ে একটি বির্তক চলছিল, যার একদিকে ছিল প্রাচীনপন্থীদের দল, অপরদিকে ছিল নব্যপন্থীদের দল। প্রাচীনপন্থীদের দলটি বিশ্বাস করতেন অ-সংস্কৃত উপাদান বাংলা ভাষার বিশুদ্ধতা নষ্ট করছে। আর নব্যপন্থীরা তথা বাংলা পন্থীরা সংস্কৃত শব্দ বহুলতা পরিহারের পক্ষে ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর প্রবন্ধে বাংলা ভাষার দুটো নীতির কথা বলেছেন- লিখিত ভাষা ও কথিত ভাষা। এই দুটো রীতির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। বিশেষ করে অপ্রচলিত শব্দ লিখিত ভাষাকে করেছে দুর্বোধ্য, জটিল ও দুরূহ। প্যারীচাঁদ মিত্রই প্রথম এই জটিল দুর্বোধ্য ভাষার বিরূদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন তাঁর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসের মাধ্যমে। তবে বাংলা ভাষায় প্রচলিত এই দুই রীতি বঙ্কিমের পূর্বেও ছিল। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের গদ্যগ্রন্থ রচনার আগে বাংলা গদ্যের অনেক নিদর্শনেই তার পরিচয় মেলে। এই দুই রীতির প্রধান পার্থক্য ছিল শব্দ ব্যবহারে। সাধু রীতিতে তৎসম-তদ্ভব শব্দের প্রাধান্য ছিল। (গোলাম মুরশিদ, কালান্তরে বাংলা গদ্য, ১৩৯৯)।
কাজেই বঙ্কিমচন্দ্রকৃত বাংলা গদ্যরীতি বিভাজন নতুন কোন বিষয় নয়। তিনি তার আলোচনা কথিত বাংলায় না গিয়ে লিখিত ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়নের জন্য তিনি সংস্কৃত পণ্ডিতদের দায়ী করেছেন। বস্তুত ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাংলা ভাষা পরিস্থিতি বেশ জটিল ছিল বলেই বাংলা গদ্যে সংস্কৃত শব্দের প্রচুর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সংস্কৃত পণ্ডিতরা সুযোগটি গ্রহণ করেছিলেন। ‘তার পূর্বে বাক্য লেখা হত খাটো দৈর্ঘ্যর, সরল প্রকৃতির। ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে আদান-প্রদানের ফলে বাংলা গদ্যের এই সরলতা দ্রুত লোপ পেতে শুরু করে। এক দিকে শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরবি-ফারসি শব্দ সজ্ঞানে বর্জন করে তৎসম শব্দ আমদানির প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়; অন্য দিকে বাক্য কাঠামোয় বড়ো রকমের পরিবর্তন সূচিত হয়। সরল এবং খাটো বাক্যের বদলে জটিল এবং দীর্ঘ বাক্য লেখার রীতি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়।’ (গোলাম মুরশিদ, ঐ)।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, ‘মুসলিম শাসনের পরিবর্তে বাংলাদেশে ইংরেজ রাজত্ব স্থাপিত হওয়াই সংস্কৃতায়নের প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। মুসলিম শাসনের চাপ না থাকায় আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারের বাস্তবতা পরিবর্তিত হয়। এই শব্দগুলোর স্থান দখল করে সংস্কৃত শব্দ। উনবিংশ শতাব্দীতে সংস্কৃতায়নের প্রক্রিয়াটি ব্যাপকভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। কলকাতার এলিট শ্রেণির ভাষার সঙ্গে সাধারণ জনগণের ভাষার কোন যোগ ছিল না। তাই আরবি-ফারসি শব্দের সঙ্গে লোক প্রচলিত বাংলা শব্দ, বাগধারা-বাগবিধি ও উচ্চারণ ভঙ্গি লিখিত বাংলা থেকে বাদ পড়েছিল। এর পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল গভীর শ্রেণিগত ব্যাপার তথা সাম্প্রদায়িকতা। কারণ ভদ্রলোকেরা প্রায় সবাই ছিল হিন্দু এবং বাদ পড়া অধিকাংশ শব্দই ছিল মুসলমানের।’ তবে প্যারীচাঁদ মিত্রের সৃষ্ট আলালী ভাষার ব্যবহার কলকাতার ভদ্র সমাজ কর্তৃক গৃহীত হয়নি বলেই পরে তিনি আর ঐ ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেননি।
বঙ্কিমচন্দ্রের নিজের রচনায় সংস্কৃত শব্দের বহুল প্রয়োগ রয়েছে, তারপরও তিনি সংস্কৃতপন্থীদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছেন। বাংলা গদ্যের জন্মলগ্নে সংস্কৃতায়নের কাজ সমাধা করেছিলেন হ্যালহেড, উইলিয়াম কেরী প্রমুখ ইউরোপীয় লেখকরা, ব্যাকরণ প্রণয়ন কিংবা অভিধান সংকলনের মধ্য দিয়ে। বঙ্কিমচন্দ্র তৎকালীন ভাষা পরিস্থিতিকে দেখেছেন খুব সরলভাবে; এর পেছনে তিনি কোন গভীর ঔপনিবেশিক কারণ খুঁজতে যাননি, যা পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত দক্ষ হাতে পরিচালনা করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধে ভাষার আলোচনা শব্দের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। শ্যামাচরণ বাবুর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলা শব্দ তিন রকম। ১. সংস্কৃতমূলক শব্দ, যা বাংলায় রূপান্তরিত; যথা-গৃহ-ঘর, ভ্রাতা-ভাই ২. সংস্কৃতমূলক শব্দ, যার রূপান্তর হয়নি, যথা-জল, মেঘ, সূর্য্য৩. যে সকল শব্দের সংস্কৃতের সঙ্গে কোন সম্বন্ধ নাই।’
বঙ্কিমচন্দ্র ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্বের আলোচনা করেননি। তাঁর বিবেচনায় যে রীতিকে তিনি বাংলা ভাষার জন্য উৎকৃষ্ট বলে মনে করেছেন, তাই তিনি প্রবন্ধে আলোচনা করেছেন। তিনি একটি ভিন্ন রীতিতে চলার কথা বলে প্রবন্ধটি সমাপ্ত করেছেন- ‘নব্য ও প্রাচীন উভয় সম্প্রদায়ের পরামর্শ ত্যাগ করিয়া, এই রীতি অবলম্বন করিলে, আমাদিগের বিবেচনায় ভাষা শক্তিশালিনী, শব্দৈশ্বর্য্যে পুষ্টা এবং সাহিত্যালংকারে বিভূষিতা হইবে।’
আমরা জানি যে পরবর্তীতে বঙ্কিম প্রবর্তিত গদ্যরীতির প্রভূত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। নতুন চলিত গদ্যরীতির প্রচলনের মধ্যদিয়ে বাংলা ভাষা আরও বেশি ঐশ্বর্যশালী, শক্তিশালী ও সৃষ্টিশীল হয়ে উঠেছে। তবে ভাষা বিশ্লেষণ ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আজও তেমন কোন উন্নত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ভাষা পরিস্থিতির ক্ষেত্রেও কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেনি। যার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে আমরা ঔপনিবেশিকতা ও তার ধারাবাহিক অনুসরণকে দায়ী করতে পারি। কারণ আমাদের মধ্যে এখনও পুরোনো প্রতিষ্ঠিত রীতি-নীতিকে মেনে নেওয়ার প্রবণতা বিদ্যমান। তবে বঙ্কিমচন্দ্রের সর্বাপেক্ষা বড় অবদান তিনি গদ্যরীতিকে গতিশীল করেছেন। তিনি ভাষা বিষয়ক আলোচনায় লিখিত ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে ‘কহিবার’ ভাষাকে উপেক্ষা করে গেছেন। যাকে ভাষা-পরিকল্পনার মুখ্য বিষয় রূপে প্রতিপন্ন করা হয়।
Advertisement
এভাবেই আমরা উপনীত হলাম বিংশ শতাব্দীতে। ভাষা-পরিকল্পনা বিষয়টি বিংশ শতাব্দীর অবদান হলেও, এ ধারণা আরও প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা-পরিকল্পক ভারত উপমহাদেশের অধিবাসী ছিলেন। তিনি হলেন বৈয়াকরণিক পাণিনি। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে তিনি সংস্কৃত ভাষা নিয়ে প্রচণ্ড সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তিনি সংস্কৃতকে সুপরিকল্পিতভাবে মান্যায়িত করে, তাকে সমস্যামুক্ত করে, সে ভাষার একটি সুস্থিত রূপ দেন। (মৃণাল নাথ, ১৯৯৯)
ভাষা পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তার অবয়ব পরিকল্পনা। অবয়ব পরিকল্পনার অর্থ হলো ভাষার মান্যায়ন, নতুন শব্দ বা পরিভাষার উদ্ভাবন, বানানের সংস্কার বা বানানকে নিয়মিত করা, ভাষার রূপতত্ত্বে সমতা আনা এবং নতুন লিপি অভিযোজন বা গ্রহণ। অর্থাৎ ভাষিক ব্যাপারে শৃঙ্খলা আনার সচেতন প্রয়াস ভাষার অবয়ব পরিকল্পনা।
ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ভাষা-পরিকল্পনার বিষয়টি কতদূর অগ্রসর হয়েছিল এবং এ বিষয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা যাক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি হিসেবে পরিচিত হলেও ভাষাবিজ্ঞানে তাঁর প্রতিভা বিস্ময়কর। তিনি বাংলা ভাষার প্রথম বর্ণনামূলক আলোচনার জনক এবং পথিকৃৎ হয়ে আছেন। বিংশ শতাব্দীর বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষা-পরিকল্পনা নীতি সর্বাত্মকভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।
উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের জন্মকথা সম্পর্কে ভাষাবিজ্ঞানী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ভাষার কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যের সূত্রপাত হইল বিদেশির ফরমাশে, এবং সূত্রধার হইলেন সংস্কৃত পণ্ডিত।... তারা সংস্কৃত ব্যাকরণের হাতুড়ি পিটিয়া নিজের হাতে এমন একটা পদার্থ খাড়া করিলেন যাহার কেবল বিধিই আছে, কিন্তু গতি নাই।’ এখানে তিনি বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়নের অসাড়তাই প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। বাংলা গদ্যের সূচনালগ্নে রাজা রামমোহন রায়কে রাস্তা বানিয়ে চলতে হয়েছিল। পরে বিদ্যাসাগর মহাশয় এই কাঁচা রাস্তার মধ্যে সৌর্ন্দয ফুটিয়ে তোলেন। তখন থেকেই বাংলা গদ্য ভাষায় রূপের আবির্ভাব হলো। তারপর বঙ্কিমই ভাষাকে দিয়েছিলেন চলার স্বাধীনতা। (বাংলা ভাষা পরিচয়, রবীন্দ্র রচনাবলী)
বিংশ শতাব্দীতেও বাংলা ভাষার বিশুদ্ধ ব্যাকরণ কি হবে তা নিয়ে চলছে তুমুল বির্তক। কেননা বাজারে প্রচলিত অধিকাংশ বাংলা ব্যাকরণই সংস্কৃত ব্যাকরণের ছাঁচে ঢালা এবং সংস্কৃত ভাষা বিশ্লেষণের সূত্রাদিতে পরিপূর্ণ। ভাষাবিজ্ঞানী মুহম্মদ আব্দুল হাই বলেন, ‘সংস্কৃত থেকে বিবর্তনের পথে বাঙলা উদ্ভুত হলেও সংস্কৃত থেকে বাংলা সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতির ভাষা।’ ইত্যাদি কারণে বিশ শতকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদকে কেন্দ্র করে ১৯০১ সালে বাংলা ব্যাকরণ সম্পর্কিত একটি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এসময় রবীন্দ্রনাথই ব্যাখ্যা করলেন যে, বাংলা ভাষার প্রকৃত কাঠামো সংস্কৃত থেকে পুরোপুরি আলাদা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ ব্যাকরণ সমিতির সদস্য ও আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করিয়ে দেন যে, চলিত বাংলা ব্যাকরণ হবে প্রাকৃত বাংলা ব্যাকরণ। তিনি তার শব্দতত্ত্ব প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, বাংলা ভাষা বাংলা ব্যাকরণের নিয়মে চলে এবং সে-ব্যাকরণ সম্পূর্ণরূপে সংস্কৃত ব্যাকরণের দ্বারা শাসিত নহে।’ (শব্দতত্ত্ব, রবীন্দ্র রচনাবলী)
ওই বিতর্কে হীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, ‘...শিক্ষা বিস্তারের জন্য রচনার ভাষা যত কথিত ভাষার নিকটবর্তী হইবে ততই সুফল ফলিবে। ভাষা অর্থে যদ্দারা ভাষণ করা যায়, সুতরাং তাহা কথিত ভাষার নিকটবর্তী হওয়াই উচিত।’ বঙ্কিম তাঁর আলোচনায় নিজেকে মধ্যম পথের পথিক করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধে খাঁটি বাংলা পন্থী বা প্রাকৃত পন্থীকে সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ‘যথার্থ বাংলা ভাষা প্রাকৃত ভাষা, সংস্কৃত ভাষা নয়।’ বিদগ্ধ জনের কাছে তিনি জানতে চান, ‘বাংলা ব্যাকরণ সংস্কৃতমূলক হইবে কেন?’ অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দের বাহুল্য বাংলায় বেশি বলে ভাষার গঠনাদিও সংস্কৃত ব্যাকরণানুসারে করতে হবে কেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাষা-পরিকল্পনার কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর ভাষা পরিকল্পনার বৃহৎ পরিসর সম্পর্কেও কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। বিশেষত রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাঁর ভাষা-পরিকল্পনা নীতি সম্ভবত আলোচিত হয়নি।
ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে অহিংসা নীতির জনক গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ বিরোধী বিকেন্দ্রিক রাজনীতি প্রচার করেন। ভারতবর্ষের দুই পরমাত্মা ছিলেন দুজন। তাঁরা ছিলেন মূল্যবোধের পক্ষে। রাজা বিহীন সমাজ এবং বিকেন্দ্রিক স্বায়ত্বশাসন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনা যা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর স্বদেশী সমাজ, কালান্তর, অথবা জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর যে ভাষণ সেগুলোয়। যা আমাদের চিন্তা করতে শেখায় সরকার বা রাজা বিহীন এক সমাজ ব্যবস্থার কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিকেন্দ্রীকরণকে প্রাধান্য দিয়ে সমবায়ভিত্তিক এক ঐক্যবদ্ধ সমাজব্যবস্থার কথা বলেছেন। রাশিয়ার চিঠি প্রবন্ধে আমরা যার পরিচয় পাই। তাঁর বহুত্ববাদী ভাষা-পরিকল্পনা সমৃদ্ধ হতে পারে ‘ভাষা সমবায়, এর মাধ্যমে। বহুভাষার এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বা ভাষা সমবায় দূর করতে পারে ভাষা বিলুপ্তিকে। একটি একক ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাকে কবি তুলনা করেছেন সমস্ত প্রজাদের ঘর থেকে ‘তেল’ নিয়ে শুধু রাজদরবারে আলো জ্বালিয়ে রাখার সাথে। একে আরও তুলনা করা যায় জাতীয়তাবাদী অর্থনীতিবিদদের ‘ড্রেইন অব ওয়েলথ’ মতবাদের সাথে। এর মানে হচ্ছে সমাজের উদ্বৃত্ত মুনাফা ছিনিয়ে নিয়ে এসে সরকারি কোষাগারে রাখা এবং তার মাধ্যমে অন্য জায়গার উন্নতি সাধন। যারা মুনাফা অর্জন করছে তাদের কোন উন্নতি হচ্ছে না। এভাবে একটি ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলে অন্যান্য ভাষা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রবীন্দ্রনাথ এর বিরোধিতা করে ভাষা সমবায় প্রস্তাব করেছেন।
উত্তর ভারতীয় বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে (১৯২৩, সাহিত্যের পথে) তিনি বলেন, বাহ্যিক একতা নিয়ে যায় ‘পঞ্চত্ত্বের’ দিকে যার মানে হচ্ছে মৃত্যু; আর আত্মিক একতা নিয়ে তৈরি হয় ‘পঞ্চায়েত’, যা ঐক্যবদ্ধ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সমাজের প্রতীক। বর্তমানে এমন কোন মানুষ নেই যারা রবীন্দ্রনাথ বা গান্ধীর মতাদর্শকে ধারণ করতে চান। গান্ধীর আদর্শকে তারা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া কবি বলে অভিযোগ করে থাকেন। আমরা জানি তাঁরা ভারতবর্ষের দুই পরমাত্মা ছিলেন।
যা-ই হোক, ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে থেকে রবীন্দ্রনাথ সম্পন্ন করে যেতে পারেননি বাংলা ভাষা-পরিকল্পনার কাজ। তাঁর ব্যাপক সুগভীর ভাষাচর্চার মূল উদ্দেশ্যই ছিল বাংলা ভাষাকে খাঁটি বাংলা করে তোলা। যা হোক, বাংলা গদ্যের দুশ বছর পার হওয়ার পর সম্প্রতি বাংলা একাডেমি ২০০৯ সালে বাংলা ব্যাকরণ বিষয়ক এক কর্মশালার আয়োজন করে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো খাঁটি বাংলা ব্যাকরণ তৈরি করা। এ বিষয়ে দুই বাংলার পণ্ডিতবর্গ একযোগে কাজ করে যাচ্ছেন। আশা করা যায়, রবীন্দ্রনাথের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ হবে। বাংলা ভাষা ফিরে পাবে তার সঠিক অবয়ব-সৌন্দর্য ও পরিকল্পনা।
তথ্যসূত্র:১. কালান্তরে বাংলা গদ্য; গোলাম মুরশিদ২. ভাষাবিজ্ঞান পত্রিকা; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৩. ভাষা ও সমাজ; মৃণাল নাথ ৪. বঙ্কিম রচনাবলী৫. রবীন্দ্র রচনাবলী৬. ইন্টারনেট৭. দৈনিক ইত্তেফাক সাহিত্য সাময়িকী।
লেখক: সিনিয়র প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/এএসএম