দেশজুড়ে

শাল্লায় আসলে কী ঘটেছিল?

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ও তৎপরবর্তী আইনি প্রক্রিয়ায় নজর এখন দেশের সচেতন মহলের। ওই ঘটনায় করা দুটি মামলায় আসামি করা হয়েছে দেড় হাজার জনকে। রোববার (২১ মার্চ) পর্যন্ত দুই মামলায় প্রধান আসামিসহ মোট ৩৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

Advertisement

গত ১৭ মার্চের ন্যক্কারজনক ঘটনাটির জন্য প্রথম দিকে হেফাজতে ইসলামের সমর্থকদের দিকে অভিযোগের তীর গেলেও প্রধান আসামি শহিদুল ইসলাম স্বাধীন (৫০) গ্রেফতার হওয়ার পর আলোচনায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। হবিবপুর ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য (মেম্বার) স্বাধীনকে কিছু কিছু গণমাধ্যমের খবরে যুবলীগ নেতা বলা হলেও ২০ মার্চ দুপুরে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দেয়, শহিদুল ইসলাম স্বাধীন যুবলীগের কেউ নন। এমনকি ২০০৭ সালের পর থেকে শাল্লায় যুবলীগের কোনো সাংগঠনিক কমিটিও নেই।

নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা ও মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৫-১৬ মার্চ থেকেই শাল্লায় উত্তেজনা ছড়াচ্ছিল। ১৫ মার্চ সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে ‘শানে রিসালাত সম্মেলনে’ বক্তব্য রাখেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব মুহাম্মাদ মামুনুল হক। তার সূত্র ধরে ফেসবুকে মুহাম্মাদ মামুনুল হককে ‘কটাক্ষ করে’ ঝুমন দাস আপন নামে একটি আইডি থেকে পোস্ট দেয়া হলে সেই উত্তেজনা ভিন্নমাত্রা নেয়। তখন মামুনুল সমর্থকদের প্রশমিত করতে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সচেতন জনতা ঝুমন দাস আপনকে খুঁজে বের করে ১৬ মার্চ রাতেই পুলিশের হাতে তুলে দেন

সংখ্যালঘু অধ্যুষিত নোয়াগাঁও গ্রাম ঘেরাও করতে যাওয়া লোকজনের হাতে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র দেখা যায়

Advertisement

কিন্তু পরদিন ১৭ মার্চ সকালে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত নোয়াগাঁও গ্রাম ঘেরাও করে রাখে শত শত লোক। তখন তাদের হাতে রামদা, লাঠি-সোটা দেখা যায়। এরপর ওই লোকজন গিয়ে সংখ্যালঘুদের মন্দির এবং ৮৭টি বাড়িতে হামলা করে ভাঙচুর চালায়। করে স্বর্ণালঙ্কার-আসবাবপত্র লুট। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনার ভয়াবহতার চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।

১৮ মার্চ সকালে নোয়াগাঁও গ্রামে ছুটে যান র‍্যাবের মহা পরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আব্দুলাহ আল মামুন। তিনি সেখানে বলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে শান্তির দেশ। এই শান্তির দেশে কেউ অশান্তি সৃষ্টি করলে তাদের ছাড় দেয়া হবে না।’

পরে এ ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের হয়। এর মধ্যে শাল্লা থানা পুলিশ বাদী হয়ে একটি এবং হবিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল বাদী হয়ে অপর মামলাটি দায়ের করেন। চেয়ারম্যানের করা মামলার প্রধান আসামি ইউপি মেম্বার স্বাধীনকে ১৯ মার্চ রাতে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থেকে গ্রেফতার করা হয়। ধরা হয় আরও ৩২ জনকে।

মামুনুল হককে ‘কটাক্ষ’ করে ফেসবুক পোস্টদাতা ঝুমন দাস আপনকে পুলিশে সোপর্দ করে স্থানীয় জনতা

Advertisement

রোববার শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হক জাগো নিউজকে বলেন, এ পর্যন্ত এ মামলার ৩৩ আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে গত রাতে গ্রেফতার হয়েছে তিন আসামি। বাকি আসামিদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

আলোচনায় জলমহাল নিয়ে বিরোধমামুনুল হককে ফেসবুক পোস্টে কটাক্ষের জেরে হেফাজতের সমর্থকেরা উত্তেজনা ছড়ালেও কারও কারও দাবি, ওই উত্তেজনায় ঘি ঢালা হয়েছে পুরনো বিরোধ থেকে। এক্ষেত্রে নোয়াগাঁও গ্রামবাসীর সঙ্গে ইউপি মেম্বার অর্থাৎ প্রধান আসামি স্বাধীনের জলমহাল সংক্রান্ত বিরোধই আসছে আলোচনায়। স্থানীয় অনেকে দাবি করেন, এই হামলা-ভাঙচুরের ঘটনার আগে নোয়াগাঁওয়ের সঙ্গে জলমহাল নিয়ে স্বাধীনের বিরোধের কারণে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর লিখিত অভিযোগও দিয়েছিলেন গ্রামবাসী। তাদের পক্ষে বীর মুক্তিযোদ্ধা জগদীশ চন্দ্র দাশ ও হরিপদ দাশ এই লিখিত দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বিরোধ মেটাতে উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে দাবি গ্রামের বাসিন্দাদের।

ঘটনাটির বিষয়ে আবু মুসা নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জাগো নিউজকে বলেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি মসজিদের মাইকে মাইকিং করা হচ্ছে—হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিবকে কটাক্ষ করা যুবককে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার কারণে নোয়াগাঁও গ্রামবাসী ইসলামকে গালিগালাজ করছে। সেটার প্রতিবাদে নোয়াগাঁও গ্রামে মিছিল অনুষ্ঠিত হবে।’

আবু মুসার দাবি, ‘ওই মাইকিংয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেই প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিতে যাই। কিন্তু হঠাৎ করে আমাদের সঙ্গে একদল মানুষ দা-রামদা নিয়ে শামিল হলো, অথচ এদের এই গ্রামে আমি এর আগে দেখিনি। আমাদের আগে ওরা এই সব অস্ত্র নিয়ে দৌড়ে আসে। তখনো বুঝতে পারিনি আসলে কী হচ্ছে। ওই গ্রামের সামনে গিয়ে দেখি হাজারো মানুষ ধাড়ইন নদীর ওপার থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে, মিছিলের কথা বলে কারা যেন নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা চালাচ্ছে। পরে আমরা ভয়ে একসঙ্গে সবাই সেখান থেকে সরে আসি।’

মামলার প্রধান আসামি শহিদুল ইসলাম স্বাধীন, তিনি ইউপি সদস্যও

নোয়াগাঁও গ্রামে গিয়ে কথা হয় হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত শৈলেন দাশের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বাধীন মেম্বারের বিরুদ্ধে জলমহাল অবৈধভাবে সেচ দিয়ে শুকানোর প্রতিবাদ করায় তার সঙ্গে গ্রামবাসীর বিরোধ ছিল, তার বিরুদ্ধে ইউএনও বরাবর লিখিত অভিযোগও দিয়েছে গ্রামবাসী। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’

আর ১৬ মার্চ নোয়াগাঁও গ্রামের ঝুমন দাস ফেসবুকে মামুনুল হককে নিয়ে পোস্ট দিলে পুরো এলাকায় উত্তেজনা ছড়ায়, সেই বিষয়টিকে ইস্যু বানিয়ে মাইকিং করে নোয়াগাঁও গ্রামে হামলার পরিকল্পনা করা হয় বলে অভিযোগ করেন ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকজন।

হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হরিপদ চন্দ্র দাশ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি ঘরে ছিলাম, দেখি কয়েকজন ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে আমার যা কিছু আছে সব লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে।’

কারা নিয়ে গেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একজন হলো পকন মিয়া, আরেকজন হলো ইউপি সদস্য স্বাধীন।’

কেন একজন ইউপি সদস্য হয়ে স্বাধীন এমন কাজ করবেন, প্রশ্ন করা হলে হরিপদ চন্দ্র দাশ বলেন, ‘স্বাধীন মেম্বারের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা আছে জলমহাল নিয়ে, সেজন্য পরিকল্পিতভাবে মেম্বার এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে।’

প্রথম থেকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর জন্য হেফাজতের সমর্থকদের অভিযুক্ত করা হলেও সংগঠনটির দিরাই শাখার সাধারণ সম্পাদক মুখতার হোসেন চৌধুরী তা অস্বীকার করেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা জানি হেফাজত ইসলাম কখনো হামলা, লুটপাট করতে পারে না। ধীরে ধীরে এখন আসল সত্যটা বেরিয়ে আসছে। আমরা পুলিশ-প্রশাসনকে অনুরোধ জানাই, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আসল অপরাধীদের চিহ্নিত করা হোক।’

সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান রোববার তার কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন

স্বাধীন মেম্বারের বিরুদ্ধে নোয়াগাঁও গ্রামবাসীর লিখিত অভিযোগ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুক্তাদির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘জলমহাল শুকিয়ে মাছ নিধন করা হচ্ছে, এমন একটি অভিযোগ নোয়াগাঁও এলাকাবাসী আমাদের কাছে দিয়েছিল। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সেখানে অভিযান চালাই এবং দুটি মেশিন জব্দ করি।’

সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘শাল্লার ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা অপরাধী, তাদের আর কোনো পরিচয় নেই। জড়িত কারা ছিল আর কারা ছিল না, তা তদন্তের পর জানা যাবে। পুলিশ তদন্ত ছাড়া কথা বলতে পারে না। অনেক তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাইয়ের পর পুলিশ কথা বলে। তদন্ত শেষে বলা যাবে, এ ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত ছিল আর কারা দায়ী এবং কী কারণে এমন ঘটনা ঘটেছিল। আমরা সতর্ক না হলে এর খারাপ প্রভাব পড়বে। যদি সতর্ক না থাকি তাহলে এরকম ঘটনা আরও ঘটতে পারে। সেজন্য সবাইকে চোখ-কান খোলা রেখে কাজ করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘এই মামলার তদন্ত সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে করা হবে। সর্বোচ্চ জ্ঞান মেধা প্রজ্ঞা দিয়ে তদন্ত করা হবে। সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ থেকে তদন্ত কাজ করা হবে। পুলিশের দায়িত্ব হচ্ছে এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। পুলিশ সবার সহযোগিতা নিয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চায়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও জনগণের জানমাল রক্ষা করা প্রশাসনের দায়িত্ব।’

সবার উদ্দেশে পুলিশের তরফ থেকে পরিষ্কার বার্তা দিয়ে এসপি বলেন, ‘কারও প্রতি কোনো বেআইনি আচরণ করা হবে না। শাল্লার ঘটনায় জড়িত নিশ্চিত না হয়ে একজন মানুষকেও গ্রেফতার করবো না। কাউকে কোনো ধরনের হয়রানি বা বিপদে ফেলার চেষ্টা করা হবে না। পুলিশের পরিষ্কার বার্তা, শাল্লায় বেআইনি ঘটনা ঘটেছে, আইনি পন্থায় তার সমাধান হবে।’

লিপসন আহমেদ/এইচএ/এমকেএইচ