রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) পরিচালনা আইন ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশের ১১(১) নম্বর ধারা অনুযায়ী সিনেটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ নতুন উপাচার্য নিয়োগের জন্য সিনেট সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন সদস্য বিশিষ্ট উপাচার্য প্যানেল গঠন করা। তবে গত দুই দশক ধরে উপেক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়টির প্যানেল নির্বাচনের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টি সচল করা যাচ্ছে না।
Advertisement
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. ইফতেখারুল আলম মাসঊদ বলেন, ‘১৯৯৬ এ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালে ১৮৯৯ সালের জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্টের প্রয়োগের মাধ্যমে মেয়াদ পূর্তির আগে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম ইউসুফ আলীকে সরানো হয়। যদিও সিনেট কর্তৃক নির্বাচিত উপাচার্য ছিলেন তিনি। ওই সময়ে নিয়োগ পাওয়া উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল খালেককে তখন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। পরবর্তী বছর ১৯৯৯ সালে সিনেট অধিবেশনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে উপাচার্য হন ড. সাইদুর রহমান খান।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এলে পূর্বের দেখানো পথেই হাঁটেন তারা। তৎকালীন সিনেট নির্বাচিত উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান খানকে সরিয়ে ড. ফাইসুল ইসলাম ফারুকীকে নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর আর সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ সম্ভব হয়নি।’
ড. ফাইসুল ইসলাম ফারুকীর পর ড. আলতাফ হোসেন, ড. মামনুনুল কেরামত, ড. এম আব্দুস সোবহান, ড. মুহাম্মদ মিজানউদ্দিনসহ ছয় জন উপাচার্য নিয়োগে সিনেট উপেক্ষিত রয়েছে। সর্বশেষ দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করে আসা অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহানের মেয়াদ শেষ হচ্ছে এ বছরের ৭ মে।
Advertisement
তবে এর আগেই সিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল তৈরির দাবি সিনেট শিক্ষকদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ও সিনেট সদস্য অধ্যাপক ড. এনামুল হক বলেন, ‘সিনেটের মাধ্যমে নির্বাচিত উপাচার্য না হওয়ায় উপাচার্যদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জায়গা থাকে না। উপাচার্যরা ইচ্ছামতো প্রশাসন পরিচালনা করেন। সিনেট অধিবেশন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রমের বৈধতা থাকে। আর সিনেটের বৈধতা না নেয়ায় অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং দুর্নীতি করার সুযোগ থাকে। বর্তমানে যেমন অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম কম কিন্তু উন্নয়ন বা সৌন্দয্য বর্ধনের নামে বিভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যাপার সংক্রান্ত বিষয়গুলো ঠিকই হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিনেটের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের জন্য একজন যোগ্য মানুষকে উপাচার্য হিসেবে পাওয়ার একটা সুযোগ থাকে। তিনিও প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য তার সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিতে পারেন। এবারও উপাচার্য প্যানেল তৈরির মাধ্যমে একজন উপাচার্য নির্বাচন করা আমাদের চাওয়া।’
সিনেট অকার্যকর পাঁচ বছর:এদিকে ২০১৫ সালে ২১তম অধিবেশনের মধ্য দিয়ে ভাঙে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের ১৪ বছরের অচলায়তন। পরবর্তী বছর ২২তম অধিবেশনও অনুষ্ঠিত হয়। এরপর প্রায় পাঁচ বছর হতে যাচ্ছে কিন্তু সিনেটের একটি সভাও বসেনি। বিষয়টিকে আইনের লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, আবারও দীর্ঘ অচলায়তনের পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী এই ফোরাম।
Advertisement
সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালে ২৮ ও ২৯ জুন ২০তম সিনেট অধিবেশনের পর সিনেটের কার্যক্রম থেমে থাকে ১৪ বছর। এরপর ২০১৫ সালের ১৮ মে ২১তম সিনেট অধিবেশনের মাধ্যমে এই অচলায়তন ভাঙেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মিজানউদ্দিন। পরবর্তী বছর তার সভাপতিত্বে ২০১৬ সালের ১৯ মে সর্বশেষ সিনেটের ২২তম অধিবেশন বসার পর আর সিনেটের সভা হয়নি।
যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশের ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী, উপাচার্য বছরে অন্তত একবার সিনেটের সভা ডাকবেন, যা বার্ষিক সভা হিসেবে অভিহিত হবে।
বছরে একবারও সিনেটের অধিবেশন না হওয়াকে আইনের ব্যতয় বলে মন্তব্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মিজানউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী বছরে একবার সিনেটের অধিবেশন বাধ্যতামূলক এবং বাজেটটা পাস করতে হবে সিনেটে। উপাচার্য যদি সবার আস্থা অর্জন করতে পারেন তাহলে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব বডিগুলো কার্যকর করতে অসুবিধার কোনো কারণ দেখি না। আইনের শাসন যদি কায়েম করা যায় এবং আমি যদি উপাচার্য হিসেবে সবারই ন্যায্য পাওনা দিতে পারি তাহলে আস্থা অর্জন করতে অসুবিধা নেই। আর যদি অন্যায় করি তখন তো আমি আস্থা অর্জন করতে পারবো না। ফলে আমি যেকোনো কিছু করতে গেলেই বাঁধা আসবে।’
এদিকে সিনেট অধিবেশন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশ এর ২২ নম্বর ধারায় বর্ণিত বাজেট অনুমোদন, বার্ষিক প্রতিবেদন পাস, স্টাটিউট সংশোধন ও অনুমোদনসহ যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনোটিই হয়নি সিনেটের মাধ্যমে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ফোরামের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণের সর্বোচ্চ ফোরাম সিনেট বলে আইনেই উল্লেখ্য করা হয়েছে। তবে এসব কার্যক্রম চলছে উপাচার্য এবং সিন্ডিকেটের বিশেষ ক্ষমতাবলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত সিনেট সদস্য ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘সিনেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বডি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এটাকে কোনোভাবে অবহেলা করছে এবং এড়িয়ে যাচ্ছে।’
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘সিনেটের যে বিষয়গুলো দেখা দরকার বা যে বিষয়গুলো আলোচনা হওয়া দরকার সেসব নিয়ে প্রশাসনের কোনো অস্বস্তি আছে বলেই সভা হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুনগুলো করা হয়েছে যেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিকমতো চলে। সেগুলোকে উপেক্ষা করা ও বিশেষ ক্ষমতার ব্যবহার কোনো সুস্থ সংস্কৃতি নয়।’
সিনেটের সভা না হওয়া এবং সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল তৈরি না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, ‘নানা রাজনৈতিক কারণে সিনেটকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। আমাদের মধ্যে একটা এস্টাবলিশমেন্ট বিরোধী মনোভাব কাজ করে। উপাচার্যদের কার্যক্রমের অনেক সময় সমালোচনা হয়। তাই সিনেট করে কেউ সমালোচিত বা প্যানেল করে হারতে চায় না। অপরিহার্য একটি অংশ ছিল চার বছরের মধ্যে একটা প্যানেল হবে। সেই অপরিহার্য অংশ ব্রিটিশ আইন প্রয়োগ করে বন্ধ রাখা হয়েছে। মূলত না করার মানসিকতা দ্বারা এটি বন্ধ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো উপাচার্য যদি মনে করেন তাহলে যেকোনো সময় এটি কার্যকর করা সম্ভব।’
এ প্রসঙ্গে জানতে রোববার (২১ মার্চ) বিকেলে রাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহানকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
এমআরআর/জিকেএস