মতামত

‘একখানা বই হলেই তো আমাদের চলে’

এক ড্রয়িংরুম-বিহারিণী গিয়েছেন বাজারে স্বামীর জন্মদিনের জন্য সওগাত কিনতে। দোকানদার এটা দেখায়, সেটা শোঁকায়, এটা নাড়ে, সেটা কাড়ে, কিন্তু গরবিনী ধনীর (উভয়ার্থে) কিছুই আর মনঃপূত হয় না। সবকিছুই তার স্বামীর ভাণ্ডারে রয়েছে। শেষটায় দোকানদার নিরাশ হয়ে বললে, ‘তবে একখানা ভালো বই দিলে হয় না?’গরবিনী নাসিকা কুঞ্চিত করে বললেন, ‘সেও তো ওঁর একখানা রয়েছে।’

Advertisement

যেমন স্ত্রী, তেমনি স্বামী। একখানা বই-ই তাদের পক্ষে যথেষ্ট।-বই কেনা, সৈয়দ মুজতবা আলী

অনেক প্রতীক্ষার পর শুরু হয়েছে অমর একুশে বইমেলা। করোনা মহামারির কারণে ফেব্রুয়ারির মেলা গড়িয়েছে মার্চে। তবে লোকজনের উৎসাহের কোনো কমতি নেই। ১৮ মার্চ শুরু হওয়া বইমেলার প্রথম দিনই ছিল ক্রেতা-দর্শকের ভিড়। নানা প্রতিকূলতার পরও মেলা জমবে-এমনটি বলা যায় নিশ্চিত করেই। এ বছর এমন একটি সময়ে বইমেলা হচ্ছে যখন মুজিববর্ষ চলছে। স্বাধীনতারও সুবর্ণজয়ন্তী। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেশ-বিদেশের বরেণ্য অতিথিরা আসছেন বাংলাদেশ সফরে। ফলে মেলা আলাদা একটি মাত্রা পেয়েছে। অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে মেলায় যেতে হবে। বিশেষ করে মাস্ক পরা অত্যাবশ্যক।

‘মুক্তধারা’র স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা যে মেলার বীজ বপন করেছিলেন সেটি ফুলে-ফলে এখন এক বিরাট মহীরুহ। আজ এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক ও জাতিগত আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত এক জাতীয় মেলা। এর রূপ, রং, চরিত্র আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক চেতনার সমার্থক। কেননা বইমেলা প্রাঙ্গণে যাঁরা সমবেত হন তাঁরা শুধু বই কিনতেই আসেন না। আসেন সামাজিক দায় মেটানোর বোধ থেকেও।

Advertisement

একুশের আরেক অর্জন বইমেলা। আর বইমেলা মানে পুরো মাসজুড়েই সৃজনশীল বই প্রকাশনার মৌসুম। লেখক, প্রকাশক, পাঠক সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকেন এই বইমেলার জন্য। পরিসর, ব্যাপ্তি ও আবেগের দিক থেকে এই বইমেলা হয়ে উঠেছে আমাদের প্রাণের উৎসব। বাঙালির কোনো সাংস্কৃতিক উৎসব নেই। সেদিক থেকে বাঙালির প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসবও এই বইমেলা। বইমেলা জড়িত বাঙালির চেতনা এবং আবেগের সঙ্গে। যে একুশের চেতনার পথ ধরেই এসেছে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার এবং এরই পথ ধরে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা।

বাঙালির যত আন্দোলন, সংগ্রাম, ইতিহাস ঐতিহ্য তা সৃষ্টি হয়েছে সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়েই। বইমেলা সাংস্কৃতিক জাগরণে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভাষা সংস্কৃতির প্রতি আবেগ এবং অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক উদার চেতনাসমৃদ্ধ হয়ে একুশে বইমেলা রূপ নিয়েছে বাঙালির সর্বজনীন উৎসবে। এখানে শুধু ক্রেতা-বিক্রেতা-পাঠকেরই সমাগম হয় না, মেলা পরিণত হয় লেখক-প্রকাশক-পাঠক, দর্শকসহ বয়স শ্রেণি-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের মিলন মেলায়। সৃজনশীল প্রকাশকরা হাজারো বইয়ের পসরা নিয়ে হাজির হন বইমেলায়। মেলায় আগত দর্শক সমাগম নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে সারা দেশের অগণিত গ্রন্থ পিপাসুর নতুন বই হাতে পাওয়ার বিপুল আকাঙ্ক্ষাকে।

বইমেলায় আসেন লেখকেরা, বিশেষত তরুণ-তরুণীরা, কিশোর-কিশোরীরা, ছাত্র-ছাত্রীরা, আর আসেন মধ্যবিত্ত। যারাই মেলার প্রধান ক্রেতা। জনপ্রিয় ও পাঠকনন্দিত লেখকের বই ছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত আমলা, প্রবাসী বাঙালি কিংবা নবীন লেখকের কাঁপা হাতের প্রথম লেখাটিও ফেব্রুয়ারির বইমেলায় প্রকাশের অপেক্ষায় থাকে। একুশের মেলাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক। এটা প্রকাশনা শিল্প, লেখক পাঠক কারো জন্যই শুভকর নয়। সারা বছর ধরে বইয়ের প্রবাহ ঠিক রাখতে হলে এই মেলাকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।

পেশাদারি প্রকাশক ছাড়াও অপেশাদারি প্রকাশকরাও মেলা উপলক্ষে বই প্রকাশ করেন। এর ভালোমন্দ দুই দিকই রয়েছে। অনেকে লেখক হওয়ার বাসনায় গাঁটের পয়সা খরচ করে নিজ উদ্যোগে বই বের করেন। এতে মেলায় বইয়ের সংখ্যা বাড়লেও সে হারে মান বাড়ছে না। যেনতেনভাবে নতুন বই মেলায় আনার প্রবণতার ফলে মানহীন বই, ভুল বানান, তথ্য ও মুদ্রণত্রুটিযুক্ত বইয়ে বাজার ভরে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে তা প্রকাশনা শিল্প, লেখক, ক্রেতা, পাঠক সবার জন্যই ক্ষতিকর। এ জন্য সারা বছরই বইয়ের প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে হবে। এতে মেলার সময়ে বই প্রকাশের বাড়তি চাপ থেকে লেখক, প্রকাশক সবাই মুক্ত থাকতে পারবেন। তখন প্রকাশনার প্রতি যথাযথ মনোযোগ এবং যত্নশীল হওয়ার অবকাশ সৃষ্টি হবে। আর একটি বিষয় হচ্ছে বইমেলায় যত বই প্রকাশিত হয় সে তুলনায় বিক্রি হয় না। যদিও প্রতিবছর মেলায় প্রায় ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয় বলে প্রকাশকরা বলে থাকেন।

Advertisement

প্রতিবছরই ঘুরে-ফিরে আসে অমর একুশে বইমেলা। একুশের চেতনাসমৃদ্ধ মেলাকে কিভাবে আরো সম্প্রসারণ করা যায়, এর শ্রীবৃদ্ধি করা যায়—এ নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের। এর কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সময়ের অভিঘাতে সব কিছু পাল্টাচ্ছে। মানুষের রুচি ও মূল্যবোধও পাল্টাচ্ছে। যে কারণে এর সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য বইমেলার চেতনা, উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। বইকেন্দ্রিক একটি সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে বইমেলা যেন আরো বেশি অবদান রাখতে পারে সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বইমেলায় যত বই প্রকাশিত হয় সে তুলনায় বিক্রি হয় না। যদিও প্রতিবছর মেলায় প্রায় ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয় বলে প্রকাশকরা বলে থাকেন। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের দেশে বই বিক্রির এই অর্থের পরিমাণ তো অতি সামান্যই। প্রয়াত লেখক ও সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক এ জন্যই হয়তো আফসোস করে বলেছিলেন, ‘বাঙালি লেখে না, পড়ে না—সার্থক করে বুদ্ধিজীবী হত্যাকে।’

এবারের বইমেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে নতুন প্রজন্মকে বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংযুক্ত হয়ে তিনি এ পরামর্শ দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ছোটদের বইয়ের প্রতি ঝোঁক বাড়ানো দরকার। আমাদের সময় বাচ্চাদের বই পড়ে শোনানো হতো। এখনও আমরা তা করি। সব সময় ঘরে একটা ছোট লাইব্রেরি করে রাখি। বইয়ের প্রতি ঝোঁক বাড়াতে হবে। পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আমাদের বক্তৃতা বিবৃতিতে মানুষের কাছে যত দ্রুত পৌঁছা যায়, সাহিত্যে আরও আগে পৌঁছা যায়। সাহিত্যের মাধ্যমে ইতিহাস, ভাষা-সংস্কৃতিও জানা যায়।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন তো মোবাইল ডিভাইসেও পড়ার সুযোগ আছে। তবে বই হাতে নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টে পড়ার আনন্দই আলাদা। বইয়ের আবেদন মুছে যাবে না।’ প্রধানমন্ত্রীর বইপড়ার অভ্যাস সর্বজনবিদিত। তিনি একজন সুলেখকও। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা- ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইমেলার সেরা আকর্ষণ এবং বেস্ট সেলার।

বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় লেখক হুমায়ুন আজাদের কথায়—‘বই পড়া যায় না, নিজেকে পড়তে হয়, মনোযোগ দিতে হয়, বুঝতে হয়, জ্ঞান বা শিল্পকলার প্রতি আকর্ষণ থাকতে হয়; এবং বই পড়ে হাতে হাতে নগদ আমরা কিছু পাই না। একটা ফাইল চাপা দিয়ে এক লাখ টাকা রুজি করতে পারি; যদি মন্ত্রী হই, তাহলে স্ত্রীর নামে পঞ্চাশ কোটি টাকার জমি পাঁচ হাজার টাকায় নিতে পারি; এমনকি একটি পোক্ত ক্যাডার হলেও দিনে দশ হাজার অর্জন করতে পারি। আমাদের রাষ্ট্র যারা চালায়—মন্ত্রী, আমলা, বিচারপতি, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সেনাপতি এবং অন্যরা বই পড়ে না; কেননা তাতে কোনো আশু লাভ নেই, বরং পড়া বেশ কষ্টকর কাজ; আর শিল্পকলা ও জ্ঞানে গুলশান-বারিধারায় প্রাসাদ ওঠে না।’ কিন্তু এই বন্ধ্যত্ব আর কত দিন?

আমাদের পাঠাভ্যাস বাড়ানোর পাশাপাশি বইকেনার অভ্যাসও করতে হবে। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’র সেই দম্পতির মতো আমাদের ‘একখানা বই হলেই চলে’- এই মনোভাব পরিহার করতে হবে। সবসময়ের জন্য সেরা পুরস্কার হচ্ছে বই। প্রিয়-অপ্রিয় সবাইকে বই উপহার দিন। বইকেন্দ্রিক একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলুন।

মনে রাখতে হবে, প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ ২০০৪ সালে এই বইমেলা থেকে ফেরার পথেই একদল ধর্মান্ধ আততায়ীর হাতে মারাত্মক আহত হন। চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেও জার্মানিতে মৃত্যুবরণ করেন কিছুদিন পরই। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ না হতেই ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার সময় অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা তাঁকে কুপিয়ে হত্যা ও তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে আহত করে। এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এখনো ক্রিয়াশীল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভেঙে তছনছ করে দিতে চাচ্ছে তারা। সৃজনশীল, প্রগতিবাদী, অসাম্প্রদায়িক মানুষরা এদের পরম শত্রু। এ কারণেই সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডূকতা এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বইমেলা হতে পারে এক বিরাট প্রতিবাদ। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায়ও বইমেলার অবদান কম নয়।

আবারও হুমায়ুন আজাদের শরণ নিতে হয়। একটি লেখায় তিনি বলেছেন—‘একজন তরুণ বা তরুণী যখন একটি বই কিনে জ্বলজ্বল করে ওঠে, তখন আমি তাদের চোখেমুখে অসংখ্য শুকতারা ঝলমল করতে দেখি।’

সত্যি, এই ঝলমলে তারুণ্যই তো পাল্টে দিতে পারে সব কিছু। ইন্টারনেট, ফেসবুক আর মুঠোফোনের মায়াজালের মধ্যেও নানা রঙের আনকোরা প্রচ্ছদে ছাপা নতুন বইয়ের ম-ম গন্ধে কি মাতাল হবে না তারুণ্য? সার্থক করবে না মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী কিংবা শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকে?

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্টharun_press@yahoo.com

এইচআর/এমএস