মতামত

স্বামীকে হারিয়েও নাবালক সন্তানদের নিয়ে অবিচল ছিলেন আনোয়ারা

 

রাজশাহীর সাহেববাজার সংলগ্ন পুরাতন প্রধান সড়কটির এক পাশে স্টার স্টুডিও আর উল্টো দিকে হাজি সাহেবের ডিসপেনসারি ঘেঁষে একটা মাঠের সাথে পুরাতন বড় জমিদারবাড়ি। পুলিশের অন্যতম জাতীয় গোয়েন্দা দফতর বা ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের (এনএসআই) রাজশাহী বিভাগীয় অফিস। স্বাধীনতা পূর্বকালে এই দফতরের নাম ছিল সিআইবি (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ)। রাস্তা থেকে পুরো অফিসটি চোখে পড়ে না, শুধু মাঠের কিছু অংশ দেখা যায়। মাঠে প্রবেশ করলেই হাতের ডান দিকে অর্থাৎ মাঠের পশ্চিম অংশে একটা টাইলসের দেয়াল দিয়ে ঘেরা ভেতরে দুটো কবর চোখে পড়ে। কবর ফলকে লেখা রয়েছে, ‘শহীদ স্মৃতি—শহীদ আজিজুর রহমান, পুলিশ ইন্সপেক্টর, মৃত্যু : ১৪ই এপ্রিল ১৯৭১’।

Advertisement

উল্লেখ্য, ২৫ মার্চ ঢাকার কালরাতের পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক জেলায়ই তৎকালীন পাকিস্তানি অবাঙালি বর্বর বাহিনীকে বাঙালি ছাত্র, জনতা, বিদ্রোহী পুলিশ, ইপিআর, সেনা সদস্য সমন্বয়ে গঠিত যৌথ শক্তি অবরুদ্ধ করে ফেলে—তেমনি একটি জেলা ছিল রাজশাহী। পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দফায় দফায় আগত অগণিত বর্বর সেনার আক্রমণের মুখে ১৩ এপ্রিল রাত থেকে বাঙালি প্রতিরোধ ভেঙে পড়তে থাকে।

পাবনা থেকে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় অসম মুক্তিযোদ্ধা ডা. লায়লা পারভীন বানু প্রতিরোধ যুদ্ধে অগণিত বাঙালি জনতা দেশমাতৃকার জন্য তাদের বুকের রক্ত ঢেলে দেন। ১৪ এপ্রিল সকালে রাজশাহী শহরে প্রবেশকারী এমনই এক পাকিস্তানি বর্বর সেনা দলের হাতে সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে এই মাঠেই শহীদ হন ইন্সপেক্টর আজিজুর রহমান ও এসপি খন্দকার আবু আক্তার। এরপর মে মাসে ইন্সপেক্টর আজিজুর রহমানের বৃদ্ধ বাবাকে গ্রামে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখে। একজন পরিবারপ্রধানের মৃত্যু সেই পরিবারের কাছে কতবড় ক্ষতি, সেই পরিবার কতখানি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তার অন্যতম উদাহরণ ইন্সপেক্টর আজিজুর রহমানের পরিবার, তাঁর মৃত্যুর পর নিকটাত্মীয়রা যারপরনাই স্বার্থপরের মতো আচরণ করে।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জনকারী শহীদ আজিজুর রহমানের পত্নী আনোয়ারা রহমানের যুদ্ধ শুরু হয় একাত্তর সালে। এপ্রিল মাসের ১৪ দিনের বেতন আর গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার ধলা বিলের মধ্যে রেখে যাওয়া জমির ভাগি দেওয়া ধানে একবেলা ভাত আর একবেলা রুটি খেয়ে নাবালক ছয় সন্তানসহ আনোয়ারা বেগম কোনোরকম দিনযাপন করেছেন। সন্তানদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ও একমাত্র কন্যা তৎকালীন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ৩য় বর্ষে পাঠরত অবস্থায় পিতৃবন্ধু রাজশাহীর বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা (পরবর্তীতে শহীদ জাতীয় চার নেতার অন্যতম) এ এইচ এম কামারুজ্জামান হেনার সহায়তায় তৎকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত ও বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী পরিচালিত একমাত্র মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ‘গোবরা মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প’—কলকাতায় যোগদান করেন। অন্যান্য নাবালক সন্তানদের নিয়ে আনোয়ারা রহমানের দুর্বিষহ জীবন সংগ্রাম কেমন ছিল তা আর দশটা উপার্জনক্ষম-অভিভাবকহীন সংসারের যে হাল হয়েছিল তার থেকে ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধা কন্যা লায়লা পারভীন যখন ফিরে এলেন তখন তিনি শুরু করলেন তার শিক্ষকতা জীবন, যা একসময় তিনি সংসারের ব্যস্ততায় ও নানা কারণে ছেড়ে দিয়েছিলেন। শুরু করলেন বিশেষ শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষাদান, যার ওপর তিনি ১৯৪৬ সালে তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের কলকাতায় বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সেই মন্তেস্বরী শিক্ষা পদ্ধতি।

Advertisement

রাজশাহীর সাধুর মোড়ে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র মন্তেস্বরী স্কুলটি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। শিশু শিক্ষার বিশেষ পদ্ধতি হিসেবে মাদাম মন্তেস্বরী উদ্ভাবিত এই শিক্ষা পদ্ধতির স্কুল বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই অধিক সংখ্যায় রয়েছে। শহীদ জায়া এবং গর্বিত নারী মুক্তিযোদ্ধার জননী আনোয়ারা রহমান জন্মগ্রহণ করেন ১ অক্টোবর ১৯২৭ সালে অবিভক্ত ভারত তথা বাংলার প্রধান শহর কলকাতায়। তার বাবা ছিলেন একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত ও মা ছিলেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষিকা। ১৯৪৫ সালে লন্ডন ইউনাইটেড মিশনারি স্কুল ও কলেজ-কলকাতা থেকে দুটি লেটারসহ প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন। মিশনারি কর্মকাণ্ডের ফলে প্রায়শই মহীয়সী নারী মাদার তেরেসার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হতো। এসময় মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের সাথেও তাঁর কর্মেরযোগ ঘটেছে। বেগম রোকেয়ার ওপর বিভিন্ন লেখালেখিও তিনি করেছেন, যা তৎকালীন অনেক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

সিনিয়র টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে ডিস্টিংশনসহ পুরো বাংলায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর মন্তেস্বরী শিক্ষা পদ্ধতির ওপর বিশেষ কোর্স সমাপ্ত করেন। এতদঞ্চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ও দেশভাগ পূর্ববর্তী হিন্দ-মুসলমান দাঙ্গার করুণ ও রক্তক্ষয়ী স্বরূপ তিনি স্বচক্ষে অবলোকন করেন। অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার শিকারপুর (বর্তমানে ভারতের করিমপুর অন্তর্গত) হাই স্কুল থেকে ধর্মদহ গ্রামের নিবাসী (বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলাধীন) জনাব আজিজুর রহমান প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে বিজ্ঞানে পড়ালেখা শেষ করার পর কলকাতায় বেঙ্গল সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টে ইন্সপেক্টর পদে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালের হিসেবে আনোয়ারা রহমানও সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে শিক্ষকতা করেছেন। এর মধ্যে ২৫ ডিসেম্বর আজিজুর রহমানের সঙ্গে আনোয়ারা রহমান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। দেশভাগের পর ১৯৫১ সালে আজিজুর রহমান পুলিশ বিভাগে যোগদান করেন। পুলিশের ওসি হিসেবে তাঁকে বিভিন্ন জেলায় কর্মরত থাকতে হয়েছে; একই সঙ্গে স্ত্রী খুলনা করপোরেনেশন গার্লস স্কুল, বরিশাল ক্যাথলিক মিশন স্কুল ও রাজশাহী পি এন গার্লস স্কুল উল্লেখযোগ্য। স্বামী আজিজুর রহমান ১৯৬৮ সালে রাজশাহী গোয়েন্দা দফতরে ইন্সপেক্টর পদে যোগদানের পর ছয় সন্তানের জননী আনোয়ারা রহমান নিয়মিত শিক্ষকতা পেশা স্থগিত করেন ও নিজ বাসস্থান সাগরপাড়ার হিন্দু-ধোপা অধ্যুষিত প্রতিবেশী শিশু-সন্তানদের অবৈতনিক শিক্ষাদানে মনোনিবেশ করেন।

২০০৫ সালে আদর্শ শিক্ষক ও সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য রাজশাহী মেট্রোপলিটন রোটারি ক্লাব ‘ফেলোশিপ অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট টিচার’ সম্মানে তাঁকে ভূষিত করে। এছাড়া রাজশাহী সাংস্কৃতিক সংঘ (পদ্মা মঞ্চ), রাজশাহী কোঅপারেটিভ সোসাইটিও তাঁকে বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করে। বেগম রোকেয়া পদকের জন্য রাজশাহী বিভাগ থেকেও তাঁর নাম মনোনীত হয়। স্কুলজীবন থেকেই গানের প্রতি ঝোঁক ছিল এবং নিয়মিত চর্চাও করতেন। ফলে দেশভাগের পর ঢাকা রেডিওর গানের অডিশনে ‘এ’ গ্রেডের শিল্পী হিসেবে মনোনীত হন কিন্তু রক্ষণশীল পরিবারের নানা প্রতিকূলতায় সে প্রতিভা আর বিকশিত হয়ে ওঠেনি। মুক্তিযোদ্ধা ডা. লায়লা পারভীন বানু (এমবিবিএস) ঘোড়ামারা, রাজশাহীতে ১৯৪৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি পারিবারিকভাবেই রাজনীতি-সচেতন ছিলেন এবং ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষে সাধারণ জনগণের সামাজিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও গ্রামের মেয়েদের প্রগতিশীল উন্নয়নের জন্য সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে মহিলা ডাক্তার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

Advertisement

১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো তিনিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সক্রিয় সমথর্ন প্রদান করেন। ১৯৭১ সালের মার্চের অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন এবং অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল রাজশাহী শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাড়িঘর দখল করে, দোকানপাটে আগুন দেয়, মানুষজনকে নির্বিচারে আক্রমণ করে। সকাল সাড়ে ৮টায় পিতা জনাব মো. আজিজুর রহমানের অফিস—এনএসআই-এর রাজশাহী বিভাগীয় অফিসে প্রবেশ করে সকাল ১০টায় কর্মকর্তাদের লাইন ধরে গেটের বাইরে নিয়ে যায় এবং মেশিনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার করে। আহত অবস্থায় বাহির থেকে তিনজন হামাগুঁড়ি দিয়ে গেটের ভেতরে প্রবেশ করেন এবং বেঁচে যান। শহীদ হন বাবা ইন্সপেক্টর আজিজুর রহমান ও এসপি খন্দকার আবু আক্তার।

পাকসেনা যখন তাঁর পিতাকে অফিসের অন্য অফিসারদের সঙ্গে পরিবারবর্গের চোখের সামনে গুলি করে হত্যা করে তখন থেকেই মনের মধ্যে প্রতিশোধ নেশা প্রজ্বলিত হতে থাকে লায়লা পারভীন বানুর। ১২ মে ১৯৭১, তিনি পদ্মা পার হয়ে ভারতের ভেতর দিয়ে কুষ্টিয়ায় দাদাবাড়িতে যান। বাবার মৃত্যুর পর দাদা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ছোট ছোট কাগজে ছেলেকে চিঠি লিখতেন আর ছিঁড়ে ফেলে বলতেন, “আমার বড় ছেলে নেই।” এর মধ্যে পাকবাহিনী ভারতের সীমান্তবর্তী তিন কিলোমিটার খালি করার নির্দেশ দেয়। চাচা-চাচিরাও গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। ২৪ মে দাদাবাড়ির গ্রাম পাকসেনারা পুড়িয়ে দেয়। ওই দিনই দাদা পাকবাহিনীর হাতে নিহত হন। এরপর শিকারপুর সীমান্ত দিয়ে লায়লা পারভীন বানু ভারতে চলে যান। এতদিন পরও মনে করতে পারেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে তার চলে যাওয়ার মুহূর্তকে। দাদার মৃতদেহ পাওয়া আগের দিন—২৩ মে মাকে লেখা চিঠি ছোট চাচাকে দিয়ে যান এবং লিখেন মা-কে জানাতে, “মা আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। আমার বয়স এখন ২০ বছর তাই নিজ দায়িত্বে যুদ্ধে যাচ্ছি।”

পরে কলকাতায় বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী অফিস থিয়েটার রোডের মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং সেন্টারে যোগদান করেন। তিনি ট্রেনিং প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মীরা দে, শিপ্রা সরকার, মঞ্জুশ্রী এবং তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন যোদ্ধা সম্পর্কে গোবরা ক্যাম্পে অবস্থানরত মেয়েদের পড়াতেন। তাঁর ওপর মেয়েদের চিকিৎসার ভার ছিল—শিয়ালদহ রেলওয়ে হাসপাতাল, নীলরতন হাসপাতালে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা নেন। গোবরা ক্যাম্পের জীবনযাপন খুব কঠিন ও সাধারণ ছিল। নিজের ব্যবহারের জন্য সবুজ পাড়ের সাদা শাড়ি, টিনের মগ, রেশনের কাঁকর মেশানো মোটা চালের ভাত খাওয়ার পাশাপাশি বালিশ ছাড়া মেঝেতে রাতে ঘুমাতে হতো। ১৬ জন করে গ্রুপ করে ট্রেনিং দিয়ে মেয়েদের ব্যাচ করে আগরতলা বাংলাদেশ হাসপাতালে পাঠানো হতো। ওই সময় বিশ্বজনমত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আনতে তিনি সব রকম কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেন ।

কলকাতার গোবরা ক্যাম্পে ২৪ মে থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত অবস্থান করেন। সে সময় পরিবারের সঙ্গে অর্থাৎ মা-ভাইদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। কোনো রকম যোগাযোগ ছিল না। ১৪ এপিল্র পিতা এবং ২৪ মে দাদা পাকসেনাদের হাতে নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে এবং পিতার দেহ সৎকার করতে না পারায় তিনি দুঃখে বিহ্বল হয়ে পড়েন এবং প্রতিশোধের নেশায় উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিটি দিনই ছিল স্মরণীয়। ধর্ষিতা মেয়েদের সাহায্য করতে না পারা এবং বাবার লাশ দুদিন ধরে বৃষ্টিতে ভেজার স্মৃতি তার মন থেকে কখনো বিস্মৃত হয়নি। দেশ স্বাধীন হবে এই স্বপ্নটা ছিল মনের মাঝে তাই সব ধরনের প্রতিকূলতা জয় করতে পেরেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ভারতের ক্যাম্প থেকে দেশে ফিরে আসেন, যোগাযোগ হয় মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে। ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি রাতে মা আনোয়ারা বেগম মেয়ে লায়লা পারভীনের কর্মস্থল গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের কোয়ার্টারে বিছানায় শুয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলেন, “সংসারের কাজের ব্যস্ততায় তোর ’৭১-এর যুদ্ধের কথা শোনা হয়নি, আর আমার কথাও বলা হয়নি তোকে। ১৪ এপ্রিলে তোর আব্বা শহীদ হন। এপ্রিল মাসের ১৪ দিনের বেতন; নাবালক ছয় সন্তান; সংসার কীভাবে চালাবো কেউ কোনো খোঁজ নেয়নি। কোথাও কেউ নেই।”

স্বাধীনতা অর্জনের পঁচিশ বছর পূর্তি পর্যন্ত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো স্বীকৃতি ছিল না; কোনো আলোচনাও ছিল না তাঁদের নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া কবীর শাহবাগে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গোবরা ক্যাম্প, বাংলাদেশ হাসপাতাল ও অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো প্রকার রাষ্ট্রীয় সনদ নেই ডা. লায়লা বানুর। তবে মুক্তিবার্তায় ০৩০১০২০১৮৮ নম্বরে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এসব কিছুর ঊর্ধ্বে মনে হয়, যে স্বাধীনতার জন্য দেশ ছেড়েছিলেন সে দেশ আজ স্বাধীন যদিও সামগ্রিক অর্থে এখনো স্বাধীনতা আসেনি।

পরিচয় : ডা. লায়লা পারভীন বানু, অধ্যক্ষ, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ

প্রশিক্ষক ও চিকিৎসক : গোবরা ক্যাম্প কলকাতা, ২৪ মে থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ : ১৯ আগস্ট ২০১৬ সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান : বাসস্থান, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ, নয়ারহাট, সাভার, ঢাকা।

তথ্যসূত্র :‘একাত্তর মুক্তিযোদ্ধার মা’, মার্জিয়া লিপি, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ৪৬/১ হেমেন্দ্র দাস রোড, সূত্রাপুর, ঢাকা-১১০০।

এইচআর/ফারুক/এমএস