করোনা মহামারির কারণে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বেশ পরিবর্তন এসেছে। দাঁতের যত্নেও উদাসীন হয়েছেন মানুষ। কোয়ারেন্টাইন আর লকডাউনের সময় যেমন দাঁত ব্রাশ কম হয়েছে বড়দের, তেমনি শিশুদের দাঁতের যত্নেও অভিভাবকরা উদাসীন হয়েছেন।
Advertisement
এরই মধ্যে শনিবার (২০ মার্চ) পালিত হয়েছে বিশ্ব মুখগহ্বর স্বাস্থ্য দিবস বা ওয়ার্ল্ড ওরাল হেলথ ডে ২০২১। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য, ‘বি প্রাউড অব ইওর মাউথ’।
সম্প্রতি বিশ্ব মুখগহ্বর স্বাস্থ্য দিবস বা ওয়ার্ল্ড ওরাল হেলথ ডে ২০২১ উপলক্ষে পেপসোডেন্টের পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৩১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক দিনে দু’বার দাঁত ব্রাশ করেননি। ৩৩ শতাংশ বাবা-মা দিনে দু’বার দাঁত ব্রাশ করেননি। ৩৫ শতাংশ শিশুরা দিনে দু’বার দাঁত ব্রাশ করেনি।
প্রাপ্তবয়স্করা স্বীকার করেছেন, করোনাকালে ঘরে থেকে থেকে তাদের অভ্যাস বাজে হয়েছে। এছাড়া শিশুদের দৈনন্দিন রুটিনে শিথিলতা চলে এসেছে। দাঁত ব্রাশ করার বিষয়ে অবজ্ঞার কথা তারা স্বীকার করেছেন।
Advertisement
প্রতি ২ জনের মধ্যে ১ জন (৫৪ শতাংশ) প্রাপ্তবয়স্ক বলেছেন এমনও দিন গেছে তারা একবারও দাঁত ব্রাশ করেননি। প্রতি ২ জনের মধ্যে ১ জন (৫৪ শতাংশ) অলসতার কারণে তারা তাদের দাঁত ব্রাশ করেননি। চাকরিজীবী অর্ধেকের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক (৫৯ শতাংশ) বলেছেন দাঁত ব্রাশ না করেই তারা কাজে গেছেন।
এছাড়া অধিকাংশ বাবা-মা স্বীকার করেছেন তারা শিশুদের মুখগহ্বরের যত্নের ব্যাপারেও উদাসীন। প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭ জন (৬৯ শতাংশ) বাবা-মা বলেছেন, ঘুমানোর আগে তারা সন্তানকে মিষ্টিজাতীয় খাবার খেতে দিয়েছেন।
মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য নিয়ে সমস্যা সত্ত্বেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না বলে জরিপে তথ্য উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ও শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যা গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রতি ১০ জনের ৬ জন (৬৪ শতাংশ) জানিয়েছেন মহামারির শুরুর পর থেকে তারা মুখগহ্বরের স্বাস্থ্যের সমস্যায় পড়েছেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারীরা করোনাকালে সবচেয়ে বেশি যে ৫টি মুখের সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছেন, দাঁত, মাড়ি, মুখে ব্যথার কথা জানিয়েছেন ৩০ শতাংশ, দাঁত ও মাড়িতে রক্তপাতের কথা জানিয়েছেন ২৭ শতাংশ, মুখে ব্যথার কারণে খেতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন ২৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী, দাঁতের ব্যথার কারণে মাথা ব্যথার কথা জানিয়েছেন ২৭ শতাংশ এবং চোয়াল ব্যথার কথা জানিয়েছেন ২৫ শতাংশ।
Advertisement
প্রতি দু’জনের মধ্যে একজন (৫০ শতাংশ) প্রাপ্তবয়স্ককে মহামারির সময় দাঁত-ব্যথার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তাদের মধ্যে, ২১ শতাংশ মৃদু দাঁত-ব্যথা উপলব্ধি করেছেন। ২২ শতাংশের দাঁত ব্যথা ছিল। ৮ শতাংশকে প্রবল দাঁত ব্যথার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
প্রাপ্তবয়স্করা অন্যান্য স্বাস্থ্য পরিচর্যার চেয়ে মুখগহ্বর স্বাস্থ্যের প্রতি কম মনোযোগী ছিলেন, অন্যান্য শারীরিক সমস্যার যত্ন নিয়েছেন ৭২ শতাংশ। মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার প্রতি যত্নশীল ছিলেন ৭৯ শতাংশ। ওরাল বা মুখগহ্বরের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল ছিলেন ৬২ শতাংশ।
৮টি দেশের (ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, ফ্রান্স, বাংলাদেশ, মিশর, ঘানা, ভারত) ৬ হাজার ৭০০ জন ৩০ মিনিটব্যাপী হওয়া এই অনলাইন জরিপে অংশ নেন। একইসঙ্গে আরো একটি কোয়ালিটিটিভ রিসার্চ বা গুণগত গবেষণা চালানো হয় দাঁতের চিকিৎসকদের নিয়ে। চিকিৎসকরা জানান, করোনায় তাদের চিকিৎসাসেবা ও রোগীদের দাঁতের যত্নে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
এমনকি মারাত্মক ব্যথা অনুভবের পরও অনেকে ডেন্টিস্টের কাছে যাননি। প্রতি ৫ জনের ২ জন (৪২ শতাংশ) বলেছেন মহামারির সময় তারা দাঁতের চিকিৎসকের কাছে গেছেন। দাঁতের ব্যথা অনুভব করেছেন এমন প্রতি ২ জনের ১ জন (৫১ শতাংশ) ডেন্টিস্টের কাছে গিয়েছিলেন।
গবেষণায় আরো দেখা যায়, ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য এখন সবাই প্রস্তুত। এখনই মুখগহ্বরের যত্ন নেয়ার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। জরিপে অংশ নেয়া ৬৬ শতাংশ বলেছেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ-খাওয়াতে তাদের নতুন অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। জরিপে অংশ নেয়া ৫২ শতাংশ বলেছেন অবসর সময় কাটানোর মতো বিষয়ে করোনার ইতিবাচক প্রভাব ছিল।
পেপসোডেন্টের এই জরিপে আরো দেখা যায়, বাবা-মা যদি দিনে দু’বার ব্রাশ না করে সন্তানের ব্রাশ না করার হার ৭ গুণ বেড়ে যায়। যখন বাবা-মা দিনে দু’বার ব্রাশ করে, সন্তানের ব্রাশ করা এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা মাত্র ১১ শতাংশ। যখন বাবা-মা ব্রাশ করা এড়িয়ে যায়, সন্তানের ব্রাশ করা এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ৭৭ শতাংশ।
জরিপে ইতিবাচক বিষয় হিসেবে দেখা যায়, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭ জন (৬৮ শতাংশ) জানিয়েছেন করোনায় তারা স্বাস্থ্য সম্পর্কে আরো সচেতন হয়েছেন। প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭ জন (৬৯ শতাংশ) জানিয়েছেন মহামারির পর থেকে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে।
প্রতি ১০ জনের ৬ জন (৬২ শতাংশ) বলেছেন করোনা মহামারি বুঝিয়ে দিয়েছে তারা নিজের স্বাস্থ্যকে দায়সারাভাবে নিয়েছিলেন। প্রায় ১০ জনের ৬ জন (৫৮ শতাংশ) বলেছেন করোনাকালে বুঝতে পেরেছেন তারা স্বাস্থ্যের প্রতি পর্যাপ্ত যত্ন নিচ্ছেন না। দেখা গেছে, হাত ধোয়ার মতো ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা বেড়েছে, মহামারির পর থেকে, অধিকাংশই হাত ধোয়ার ব্যাপারে সচেতন (৭১ শতাংশ), দাঁত ব্রাশ করার চেয়ে (৪৫ শতাংশ)। মহামারির পর থেকে অধিকাংশই হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করছেন (৬৮ শতাংশ), মাউথওয়াশ (৪০ শতাংশ) ব্যবহারে চেয়ে।
ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের বিউটি অ্যান্ড পার্সোনাল কেয়ারের মার্কেটিং ডিরেক্টর আফজাল হাসান খান বলেন, মহামারি বা অন্য সাধারণ সময়েও সবাইকে দাঁত ও মুখের যত্ন নিতে হবে। এখানে সচেতনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে সন্তানদের জন্য বাবা-মায়েদের সচেতনতা। যখন ছোটবেলা থেকেই ভালো অভ্যাস গড়ে উঠে, শিশুরা বড় হলেও তাদের মধ্যে সে প্রভাব থেকে যায়।
তিনি বলেন, শিশুদের মাঝে ওরাল স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে বাবা-মা ও শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দাঁতের যত্ন নিয়ে শিশুদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে ইউনিলিভারও কাজ করে। এ কারণেই আমরা স্কুলে স্কুলে যাই অথবা দাঁতের চিকিৎসকদের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচির আয়োজন করি।
বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটি'র সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবির বুলবুল বলেন, করোনা মহামারিকালে দেশের মানুষের মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, দুই বেলা দাঁত ব্রাশ করা, ব্রাশ ও মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করা ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিপালিত হচ্ছে না। অর্থাৎ, দাঁত ও মুখগহ্বরের সাধারণ যত্ন উপেক্ষিত হয়েছে। মহামারির পুরোটা সময় চিকিৎসা না-করায় দেশের মানুষের দাঁত ও মুখের রোগ বেড়েছে।
আইএইচআর/এমআরএম/জিকেএস