বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী
Advertisement
এক ভোরে সোয়ারিঘাটে ভিড়িয়ে রাখা লঞ্চে গিয়ে বসলাম। উদ্দেশ্য খোলামোড়া বাজারে দই-মিষ্টি খাওয়া আর গ্রাম ঘুরে দেখা। আধা ঘণ্টায় খোলামোড়া ঘাটে পৌঁছলাম। লঞ্চ থেকে নামতেই ঘাটের সামনের ব্রিজের পাশে বয়স্ক দাড়িওয়ালা একজন মানুষকে উদাস হয়ে বসে থাকতে দেখলাম। তার সামনে রাখা গ্যালনে কিছু তরল পদার্থ দেখা যাচ্ছে। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম তিনি একজন দুধ বিক্রেতা।
এক-দুই কথায় কুশলাদী বিনিময়ের পর দেখি মানুষটার চোখ ছল ছল করছে। কিছুক্ষণ পর নিজেকে নদীর সামনে উন্মুক্ত করে দিলেন। খুলে বসলেন এক বিষাদমাখা গল্পের ঝাঁপি। তার নাম বাবুল। তিনি খোলামোড়া ঘাটের কাছেই ছোট্ট একটি টিনের ছাপড়ায় অন্য একজনের সঙ্গে শেয়ার করে থাকেন। জীবিকা নির্বাহ থেকে শুরু করে নিজের সব কাজ একাই করেন।
প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে হেঁটে আটিবাজারে গিয়ে নিজেই দুধ কিনে এনে খোলামোড়া ঘাটে বিক্রি করেন। সব সময় চেষ্টা করেন ক্রেতাদের ভেজালহীন ভালো দুধ খাওয়াতে। তাই কাউকে ঠকিয়ে অতিরিক্ত লাভ করেন না। তার দৈনিক ইনকাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা! এ দিয়েই জীবন কোনোভাবে চালিয়ে নিচ্ছেন।
Advertisement
কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, পরিবারে কে কে আছেন? এ কথা শুনতেই বাবুল চাচা হু-হু করে কেঁদে ফেললেন। আমি তার হাত শক্ত করে ধরলাম। কান্না থামিয়ে বললেন, ‘বাজান, কষ্টের কথা আর কী কমু, তিনডা পোলা মইরা গেছে, একটা বাঁইচা আছে। সেইডা বিয়া কইরা অনেক আগেই আমারে তাড়ায়া দিছে। আমি না-কি তাগো লাইগা ভ্যাজাল। আপনের চাচিও মইরা গ্যাছে।’
‘একলা আমি দুধ বেইচা কোনমতে পেট চালাইতাছি। আর আল্লারে ডাকতাছি, যেন এই কঠিন দুনিয়া থেইক্কা আমারেও তাড়াতাড়ি তুইল্লা নেয়।’ তখনো বাবুল চাচা আমার হাত শক্ত করে ধরে আছেন। চোখে জলের ধারা বইছে সমানে।
একপর্যায়ে কান্না থামিয়ে বললেন, ‘অনেক কষ্টের কথা কইয়া আপনের মনডাই খারাপ কইরা দিলাম, যান আপনে গেরাম ঘুইরা আহেন। খুব খুশি হমু আহোনের পথে যদি আমার লগে চাইড্ডা ডাইল-ভাত খান। আমি আমার ঘরডা দেখাইয়া দিতাছি। আমি কিন্তু নিজেই রান্দি। খুব একটা খারাপ রান্দি না। আপনের অপেক্ষায় থাকুম কইলাম।’
আমি বললাম, ‘আমি তো আপনার ছেলের মতোই, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আজ দুপুরের রান্নার জন্য বাজারটা আমি করে গ্রাম ঘুরতে যাব। রান্না শেষ হলে দুপুরে এসে আপনার সঙ্গে খাব।’ কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। শেষে শর্ত দিলেন, যদি আমি এর বিনিময়ে দুধ নিই, তাহলে তিনি আমার টাকায় বাজার করতে দেবেন।
Advertisement
বাজারে গিয়ে চাচার পছন্দের শোলমাছ, ফুলকপি, শিমের বিচি, গোলআলু, মুগডাল কিনে দিয়ে এবং বাসাটা চিনে গ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বাবুরগাও নামক জায়গাটা পার হয়ে গ্রামের ভেতরে যতো প্রবেশ করছি; ততই বাবুল চাচার জীবনটা ভীষণভাবে নাড়া দিচ্ছে। সবুজ ধান, সবজির ক্ষেত এবং হলুদ সরিষা ফুলের ক্ষেতও কেন যেন মনে দাগ কাটতে পারছে না।
বয়সের চক্রে আমরা শৈশব, কৈশোর, যৌবন কাটিয়ে বৃদ্ধ দশায় উপনীত হই। আমরা অনেকেই হয়তো ভুলে যাই এ চক্রে সবাইকেই প্রবেশ করতে হবে। তাই অবলীলায় নিজের জন্মদাতা বাবা-মাকে একা ফেলে চলে যাই। অথবা বৃদ্ধাশ্রমের আস্তাকুঁড়ে ফেলে রেখে আসি। এসব ভাবতে ভাবতে গ্রামের মেঠোপথে ঘোরাঘুরি আর ভালো লাগছিল না। এদিকে দুপুরও হয়ে আসছিল।
দই ও মিষ্টি কিনে বাবুল চাচার বাসায় হাজির হলাম। গিয়ে দেখি রান্না প্রায় শেষ। কিছুক্ষণ পর চাচা গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত বেড়ে নিয়ে এলেন। সঙ্গে নতুন আলু, শিমের বিচি, ফুলকপি দিয়ে শোলমাছ রান্না। এক লোকমা মুখে দিতেই মনে হলো যেন অমৃত খাচ্ছি। এক ফাঁকে তাকিয়ে দেখি চাচা নিজে না খেয়ে আমার খাওয়া দেখছেন।
আপনি খাচ্ছেন না কেন চাচা? প্রশ্ন করতেই ভারি গলায় বাবুল চাচা বললেন, ‘পোলাডারে ক্যান জানি মনে পইড়া গেল। তাই আপনের খাওন দ্যাহনের মদ্দ্যে পোলাডারে মনে করতাছি।’ খেয়ে দেয়ে বিদায় নেওয়ার সময় চাচা মাথায় হাত বুলিয়ে চার বা পাঁচ লিটার দুধ দিয়ে দিলেন।
সোয়ারিঘাটের উদ্দেশ্যে ছাড়তে যাওয়া লঞ্চে বসে আছি। কাকের বিষণ্ন ডাকাডাকি মনে করিয়ে দিচ্ছে সন্তান হিসেবে কতটুকু সত্যিকারের ভালোবাসা নিয়ে বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে, খোলামোড়া ঘাটে তখনও একাকী দাঁড়িয়ে আছেন বাবুল চাচা।
লেখক: ফার্মাসিস্ট ও সমাজকর্মী।
জেএমএস/এসইউ/এএসএম