দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব কিংবা গুগলে সার্চ দিলেই অহরহ মেলে ‘সেক্স টয়’র বিজ্ঞাপন। বিকৃত যৌনরুচির কাজে ব্যবহৃত এসব পণ্য মিলছে খুব সহজেই। যে কেউ ঘরে বসেই অনলাইন অথবা ফোনকলের মাধ্যমেই মারাত্মক ক্ষতিকর এসব পণ্য হাতে পেয়ে যাচ্ছেন। এসব পণ্যের ভেতর রয়েছে যৌন উত্তেজক ভায়াগ্রা ট্যাবলেটও।
Advertisement
যদিও এসব পণ্য বিক্রিতে বিক্রেতাদের টার্গেট ত্রিশোর্ধ্ব বয়সীরা। তবে এগুলোর বেশিরভাগ ক্রেতা তরুণ-তরুণী। অনেকটা ফ্যান্টাসি বা কৌতূহল থেকেই তারা অনলাইনে অর্ডার করে এসব পণ্য কিনছেন। আর এসব পণ্যের ব্যবহারে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তরুণ-তরুণীরা।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়ার কুফল হিসেবে এ নৈতিক অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির যে সুফল সবাই পাচ্ছে, এর বিপরীতে কিছু নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও দেখতে হচ্ছে। এই অবক্ষয় থেকে প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে আমাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা ধরে রাখতে হবে। আধুনিকতার নামে সবকিছুতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে আপন সংস্কৃতিমুখী করতে হবে সবাইকে।
সম্প্রতি রাজধানীর কলাবাগানে কথিত প্রেমিক তানভীর ইফতেখার দিহানের বাসায় ধর্ষণের পর মৃত্যু হয় মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ‘ও’ লেভেলের এক ছাত্রীর। সূত্রের তথ্য, ওই ছাত্রীর শরীরে ফরেন বডি অর্থাৎ সেক্স টয় ব্যবহার করা হয়েছিল। যে কারণে যৌনাঙ্গ ও পায়ুদ্বার ফেটে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয় বলে ময়নাতদন্তে উঠে আসে।
Advertisement
ওই ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনার সূত্র ধরে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সেক্স টয় বিক্রি চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার মনিটরিং এবং সাইবার ইনভেস্টিগেশন টিম। গ্রেফতারদের মধ্যে মো. মেহেদী হাসান ভূইয়া ওরফে সানি (২৮) চক্রের মূলহোতা। তিনি বছর দশেক আগে অনলাইনে পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী ছিলেন। কয়েক বছর আগে চাকরি ছেড়ে বৈধ পণ্যের আড়ালে সেক্স টয় ও যৌন উত্তেজক পণ্য আমদানির ব্যবসা শুরু করেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সানি চীন থেকে সরাসরি সেক্স টয় আমদানি করতেন। আমদানির পর খুচরা ব্যবসায়ীদের হাত ধরে তা ছড়িয়ে যেত সারাদেশে।
সিআইডি জানায়, সহজেই একজন ক্রেতা অনলাইন থেকে অর্ডার করে সেক্স টয় কিনতে পারেন। ফেসবুক, ইউটিউব ও ওয়েবসাইটে সেক্স টয় কেনার জন্য থাকে বিকাশ নম্বর। বিকাশে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পরিশোধ করলে তাদের ডেলিভারিম্যান সেক্স টয় হোম ডেলিভারি দেন। হোম ডেলিভারির পর বাকি টাকা সরাসরি পরিশোধ করেন।
অনুসন্ধানে সিআইডি জানতে পারে, টিভিসি স্কাই শপ বিডি, স্কাই শপ বিডি, টিভিসি স্কাই শপ ও এশিয়ান স্কাই শপসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে নাম– পরিচয় গোপন রেখে কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র নিষিদ্ধ সেক্স টয় ও যৌন উদ্দীপক বিক্রির বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হরহামেশাই পপ-আপ বিজ্ঞাপনে উঠে আসছে এসব পণ্য। এগুলো পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে বৈধ হলেও বাংলাদেশে অবৈধ। তবু আড়ালে-অগোচরে এসব পণ্য কিনছেন বিভিন্ন বয়সী ক্রেতা।
সেক্স টয় বিক্রির অপরাধে সম্প্রতি ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি
Advertisement
কৌশলে কয়েকটি অনলাইন সেক্স টয় বিক্রির ফেসবুক পেজ ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলে বিক্রেতারা বিভিন্ন পণ্যের ছবি ও ভিডিও দেখিয়ে কেনার জন্য এসএমএস দিতে থাকেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন একজন বিক্রেতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটি অবৈধ ব্যবসা জানি। মানুষের চাহিদা রয়েছে বলেই বিক্রি করি।’
সিআইডির সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন্সের বিশেষ পুলিশ সুপার এস এম আশরাফুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ফেসবুক, ইউটিউব ও বিভিন্ন ওয়েবসাইটে সেক্স টয় বিক্রি হয়। সেখানেই থাকে বিকাশ নম্বর। বিকাশে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পরিশোধ করলে তাদের ডেলিভারিম্যান সেক্স টয় বাসায় পৌঁছে দেন। ডেলিভারির পর বাকি টাকা ক্যাশে নেন।
চীন থেকে এসব অবৈধ্য পণ্য কীভাবে বাংলাদেশে আসতো, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমানবন্দরের কাস্টমসের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কাস্টমস জানায়, এসব পণ্য সরাসরি দেশে প্রবেশ করে না। কাস্টমসের চোখ ফাঁকি দিয়ে চীন থেকে অন্য পণ্যের সঙ্গে সেক্স টয়গুলো আনা হতো। সম্প্রতি সিআইডির হাতে ধরা পড়েন সেক্স টয় বিক্রি চক্রের মূলহোতা মেহেদী হাসান সানি। তিনি চীন থেকে আমদানি করে দেশের বিভিন্ন খুচরা বিক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতেন এসব নিষিদ্ধ পণ্য।
মেহেদী হাসান সানির ব্যাপারে এস এম আশরাফুল আলম বলেন, এশিয়ান স্কাই শপ দোকানে সেলসম্যানের কাজ করতেন সানি। পরে ২০১৭ সালে নিজে ওয়েবসাইট খুলে বেশি টাকা আয়ের লোভে অবৈধ সেক্স টয় বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। তার নামেই ছিল ১০টি ওয়েবসাইট। এমনকি এই ব্যবসায় যারা নতুন, তাদের কাছে সানি মাসিক চুক্তিভিত্তিতে ওয়েবসাইট ভাড়া দিতেন। শুধু ওয়েবসাইট ভাড়া দিয়েই প্রতি মাসে সানির আয় হতো ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা।
সিআইডি তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অনুসন্ধানে জানতে পারে, খুলনা, চট্রগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী ও নারায়ণগঞ্জসহ সারাদেশে সানির সেক্স টয় বিক্রির নেটওয়ার্ক ছিল। এছাড়া সেক্স টয়ের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকার অবৈধ যৌন উত্তেজক ওষুধ বিক্রি করতো চক্রটি। এসব সেক্স টয় ত্রিশোর্ধ্ব বয়সীরা বেশি কিনতেন। এ বয়সীদের মধ্যে ছেলেদের চাহিদা বেশি। তারাই মূলত আর্টিফিশিয়াল সেক্স টয় কিনতেন। অনেক মেয়ে তাদের বয়ফ্রেন্ড বা বন্ধুর মাধ্যমে এ ধরনের পণ্যের অর্ডার দেয়।
সেক্স টয় সম্পর্কে সিআইডির সাইবার মনিটরিং এবং সাইবার ইনভেস্টিগেশন টিম ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু করেছে জানিয়ে বিভাগটির সাইবার ক্রাইম কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. কামরুল আহসান বলেন, কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে যৌন উদ্দীপক বিভিন্ন পণ্যের ছবি ও ভিডিওসহ বিক্রির বিজ্ঞাপন দিচ্ছিল, সাইবার মনিটরিং এবং সাইবার ইনভেস্টিগেশন টিম এ ধরনের কয়েকটি ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। এসব পণ্য বিক্রির আর্থিক লেনদেন হয় বিকাশ ও রকেটে।
তিনি বলেন, তারা বিদেশ থেকে বৈধ পণ্য আমদানির আড়ালে এগুলো বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। পরে ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লোভনীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে উচ্চমূল্যে বিক্রি করছে। ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে এসব পণ্য বিক্রির কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা। যেমন: লাইকি, টিকটক ব্যবহার করে একটি ক্লোজ গ্রুপ তৈরি করে হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও ডিজে পার্টির আড়ালে এ ধরনের কর্মকাণ্ড চলে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েদের যৌনতা সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হয় না। তাদের এ সম্পর্কে ধারণা থাকে খুবই কম। যে কারণে তারা না বুঝে বিভিন্ন সেক্স টয় ব্যবহার করতে গিয়ে নিজেদের ক্ষতি করছে। সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে এ ব্যাপারে ছেলেমেয়েদের সচেতন করতে হবে। তাদের যৌন শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে।
ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সাবেক প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অধ্যাপক মো. আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমরা যে কালচারের (সংস্কৃতি) মানুষ ছিলাম সেটা ধরে রাখতে হবে। যেখানে সামাজিক মূল্যবোধের মূল্যায়ন করা হয়, যেখানে নৈতিকতার মূল্যায়ন করা হয়, সেখানে স্বাভাবিকতার মূল্যায়ন করা হয়।
তিনি আরও বলেন, মাদক যেমন কৌতূহল থেকে শুরু হয়, তেমন সেক্স টয়ও অনেকটা কৌতূহল থেকেই শুরু। সেই কৌতূহলের বশে তরুণ-তরুণীরা এসব পণ্য ব্যবহার করছে, তাতে ঘটে যাচ্ছে সর্বনাশ। এই কৌতূহলটা আসতো না যদি অল্প বয়স থেকে আমরা ফেসবুক ব্যবহার না করতাম। প্রতিটি পরিবার, স্কুল-কলেজ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। পজিটিভ সেক্স এডুকেশন নিয়ে তরুণ-তরুণীদের বোঝাতে হবে। সেক্স টয়ের কুফল তুলে ধরতে হবে।
টিটি/এমএসএইচ/এইচএ/এমএস