টেস্ট অভিষেক ঘরের মাঠে, দেশের ক্রীড়াকেন্দ্র বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। ২০-২৫ হাজার ভক্ত-সমর্থকে চোখের সামনে। টিভির পর্দায় কোটি ক্রিকেট অনুরাগী যা সরাসরি দেখেছেন। তাই ২০০০ সালের ১০-১৪ নভেম্বর ভারতের বিপক্ষে টাইগারদের টেস্ট যাত্রা শুরুর ম্যাচে কোন কিছুই অজানা নয় কারো। ওই ম্যাচের প্রতিটি ঘটনা, মুহুর্ত, দৃশ্যপট সবার দেখা ও জানা। যে কারণে কোন প্রশ্ন, বিতর্ক আর গুঞ্জনের অবকাশ নেই।
Advertisement
কিন্তু ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ শ্রীলঙ্কার মোরাতোয়ায় বাংলাদেশের ওয়ানডে অভিষেক তথা প্রথম ওয়ানডের শুধু টস নিয়েই আছে নানা ঘটনা, রটনা। জল্পনা-কল্পনা। এমন কথাও চাওর আছে যে, বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে প্রতিপক্ষ পাকিস্তান অধিনায়ক ইমরান খান টসই করতে চাননি। টস ছাড়াই খেলতে চেয়েছিলেন।
সেটা অন্য কোন কারণে নয়, ভাবটা এমন ছিল যে, ‘বাংলাদেশ ওয়ানডেতে সদ্যজাত শিশু। আর আমরা ক্রিকেটের প্রতিষ্ঠিত শক্তি। পরাশক্তি। তাদের সাথে খেলতে আবার টস করতে হবে নাকি? টস ছাড়া খেললেই বা কি হয়?’
আরেক পক্ষ বলেন, ‘ইমরান মাঠের মাঝখানে অর্থ্যাৎ যে পিচে খেলা হয় এবং বর্তমান সময়ে যে জায়গায় অনেক আনুষ্ঠানিকতা করে টস পর্ব সারা হয়, সেখানে না গিয়ে মাঠের বাইরেই টস পর্বটা সেরে ফেলতে চেয়েছিলেন।’
Advertisement
এখন যারা টিভিতে কিংবা মাঠে গিয়ে খেলা দেখেন, তারা নিশ্চয়ই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাবেন! ভাবছেন এ আবার কেমন কথা? টস ছাড়া খেলা হয় নাকি? আর এখন তো টস পর্ব অনেক আনুষ্ঠানিকতার পরে হয়। ম্যাচ রেফারি থাকেন। টিভির ধারাভাষ্যকার সঞ্চালনা করেন। দুই অধিনায়ক মুদ্রা নিক্ষেপ পর্বে অংশ নেন। এরপর কেতাদুরস্ত হয়ে ক্যামেরার সামনে আসেন। টিভিতে তা সরাসরি দেখানোও হয়।
কাজেই এখনকার প্রজন্ম ও দর্শকদের কাছে ওই টস করতে না চাওয়া, মাঠের মধ্যে ২২ গজে গিয়ে টস না করার কথা বা ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। হবার কথাও নয়। তারা ভাববেন, মনে করবেন - এ আবার কেমন আজগুবি কথা?
সেদিন কী ঘটেছিল? প্রকৃত ঘটনাই বা কী? তার জবাব ভালো বলতে পারেন কেবল দু’জনই। একজন পাকিস্তানের সে সময়ের অধিনায়ক ইমরান খান আর বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু।
বাংলাদেশের ওয়ানডে যাত্রা শুরুর গল্প করতে গিয়ে গাজী আশরাফ লিপুই জাগো নিউজকে জানিয়েছেন প্রকৃত ঘটনা। লিপুর বক্তব্য, ‘আমি খুব মুখিয়েছিলাম। বিশ্ব ক্রিকেটের সুপার স্টার, সময়ের অন্যতম সেরা ফাস্টবোলার এবং তুখোড় অধিনায়ক ইমরান খানের সাথে টস করবো। আমার ওয়ানডে ক্যাপ্টেন্সির শুরুই হবে ইমরান খানের সাথে টস করে। ভাবতেই অন্যরকম পুলক অনুভব করেছিলাম। এখনো মনে আছে খুব সেজেগুজেই টস করতে গিয়েছিলাম।
Advertisement
বেসিক্যালি আমরা দু’জন যার যার ড্রেসিং রুম থেকে বেড় হলাম। কয়েক পা পাশাপাশি হাঁটলাম। ইমরান খান বললেন, পিচ এত দুরে। এই গরমের মধ্যে হেঁটে যাওয়ার কী দরকার। চলো আমরা তো এখানেই টসটা সেরে ফেলতে পারি। ওই সময়ে আমি টস করতে যাব ভেবে খুব উত্তেজিত ছিলাম। একটা অন্যরকম রোমাঞ্চ কাজ করছিল ভিতরে। আমার জামা কাপড় ছিল খুব পরিপাটি। অথচ ইমরান খানের পড়নে একটা ট্র্যাকস্যুটের ট্রাউজার্স আর একটা রাউন্ড গলার টি-শার্টই পরা ছিল। একদম ক্যাজ্যুয়াল ড্রেস। ওই অবস্থাতেই টস করলেন। আমার তখন তাকে না করার মত অবস্থা ছিল না। হি ইজ সাচ এ বিগ ক্রিকেট পারসোনালিটি, আর আমি তখন সবে জন্ম নেয়া এক দলের অধিনায়ক। এমন কোন ম্যাচ রেফারিও ছিল না। তা যাচাই বাছাই করার জন্য। টিভির ক্যামেরাও ছিল না। সে কারণেই ইমরান খানের কথা মেনে টসটা মাঠের বাইরেই সেরে ফেললাম।’
টস নিয়ে নানা গুঞ্জন, গুজব প্রপাগান্ডর সত্যিকার উত্তর দেয়াই শুধু নয়। বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে ক্যাপ্টেন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু আরও একটি ঐতিহাসিক সত্যও উপস্থাপন করেছেন। তাহলো, মাঠের বাইরে টস করা শুনে যেন মনে না হয় পাকিস্তানীরা অনেক ক্যাজ্যুয়াল বা ‘পিকনিক’ ম্যুডে ছিল।
লিপুর ধারনা, তাই যদি থাকতো তাহলে আর ইমরান খান টস জিতে আমাদের ব্যাটিংয়ে পাঠাতেন না। নিজেরাই ব্যাট করতে নেমে পড়তেন।
তিনি বলেন, টসে ওরা জিতেছিল। তখনকার দিনে উইকেট এখনকার মত কভার করা ছিল না। পিচ কিছুটা ড্যাম্প ছিল। ওই পিচে আগে বোলিং করতে পারলে ভাল হবে, এমন চিন্তাই ছিল আমাদের। আমরা ভেবেছিলাম পাকিস্তান আগে ব্যাট করলে আমরা উইকেটের গতি প্রকৃতি জেনে বুঝে খেলতে পারবো।
কিন্তু ইমরান খান কোন সুযোগই দিলেন না। একটা নতুন দল সবে তাদের ওয়ানডে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। তাদের বিপক্ষে আমরা আগে ব্যাট করি। তাতে খেলার দৈর্ঘ্য বাড়বে। নাহ ওসব কোন চিন্তাই ছিল না তার। আমাদের এতটুকু সুযোগ না দিয়ে উল্টো তেড়ে ফুঁড়ে নিজেরা বোলিংয়ে নামলেন।
ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম আর জাকির খানের মত ফাস্ট বোলার এবং আব্দুল কাদিরের মত লেগস্পিন গুগলি বোলারে সাজানো বিশ্বমানের বোলিং শক্তির সামনে প্রথম ম্যাচেই আগে ব্যাটিংয়ে নামতে বাধ্য হলাম আমরা। বোঝাই গেল কোনোরকম ছাড় না দিয়ে আমাদের ইনিংসকে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে গুটিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খেলা শেষ করতেই বেশি আগ্রহি ছিলেন ইমরান। তাই টস জিতে আমাদের আগে ব্যাটিংয়ে পাঠালেন।
কাজেই টসটা মাঠের বাইরে হলেও ইমরান খান তথা পাকিস্তানীদের অ্যাপ্রোচ কিন্তু মোটেই ক্যাজ্যুয়াল ছিল না। তারা যত শিগগিরই সম্ভব কম সময়ে আমাদের অলআউট করে খেলা শেষ করতে চেয়েছে। হয়েছেও তাই। আমরা ১০০’র নিচে (৯৪ রানে) অলআউট হয়ে হেরে যাই ৭ উইকেটের ব্যবধানে।
এআরবি/আইএইচএস/জিকেএস