অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে নরসিংদীর মৃৎশিল্পীরা। কালের বিবর্তন আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। মাটির তৈরি তৈজসপত্র হাড়ি-পাতিল ও থালা-বাসনের স্থান দখল করেছে প্লাস্টিক, মেলামাইন ও স্টিলের তৈরি বিভিন্ন পণ্য। তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য ও বিকল্প পণ্যের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে মাটির তৈরি এসব গৃহস্থালি সামগ্রী। ফলে চাহিদা কমেছে মৃৎশিল্পের।
Advertisement
জীবন বাঁচাতে পেটের তাগিদে পেশা বদল করছেন কুমারপল্লীর লোকজন। গত এক দশকে নতুন প্রজন্মসহ প্রায় ৫০ শতাংশ লোক পেশা বদল করেছেন বলে জানিয়েছেন মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা।
সরেজমিন মৃৎশিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় নরসিংদী জেলার মৃৎশিল্পের খ্যাতি ছিল দেশব্যাপী। বংশ পরম্পরায় কুমার সম্প্রদায়ের লোকজন পৈত্রিক এই ব্যাবসা করে আসছেন। জেলার শিবপুর, পলাশ ও বেলাবো উপজেলার শতশত পাল বা কুমার পরিবার জড়িত ছিল এ শিল্পের সঙ্গে। এ জেলার মৃৎশিল্পীদের হাতে তৈরি মাটির হাঁড়ি, থালা, গ্লাস, মসলা বাটার পাত্র, মাটির ব্যাংক ও খেলনাসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নদীপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হতো। কিন্তু দিনের পর দিন আধুনিকতার ছোঁয়া আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিলীন হতে চলেছে ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প। কমদামে বেশি টেকসই প্লাস্টিক, মেলামাইন, স্টিল, লোহা বা সিলভারের তৈরি সামগ্রীর দাপটে কমে গেছে মাটির তৈরি এসব জিনিসপত্রের চাহিদা। ফলে অনেকটা মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে মৃৎশিল্পীদের।
মাটি দিয়ে তৈরি এসব গৃহসামগ্রী রোদে শুকিয়ে চুল্লিতে পোড়ানো হয়। তার পর রঙ করে বিক্রির উপযোগী করা হয়। পারিবারিক ব্যবসার কারণে বাড়ির ছেলেমেয়ে, বুড়োসহ গৃহিণীরাও সহযোগিতা করেন এসব কাজে।
Advertisement
মৃৎশিল্পীরা বলছেন, পরিশ্রম ও বিনিয়োগ অনুপাতে পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না তারা। এ কারণে পুরনো পেশার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকেই। খুঁজছেন বিকল্প পেশা। জেলার বেলাবো, পলাশ ও শিবপুর উপজেলার প্রায় পাঁচ শতাধিক পাল পরিবার মৃৎশিল্পের পেশা থাকলেও এখন মাত্র শতাধিক পরিবার ধরে রেখেছেন পূর্বপুরুষের এ পেশা। পাল পরিবারের নতুন প্রজন্মের কেউ শিখছেন না মৃৎশিল্পের কাজ। পলাশ উপজেলার পারুলিয়া মধ্যপাড়া কুমার পল্লীর সুকুমার পাল জাগো নিউজকে বলেন, তৈজসপত্র তৈরির জন্য এখন মাটি কিনে আনতে হয়। কেনা মাটি দিয়ে তৈরি জিনিসপত্রের খরচও বেশি পড়ে। এ যুগে বেশি মূল্যে এসব জিনিস কিনতে আগ্রহ দেখান না ক্রেতারা। এতে আমাদের লোকসান গুনতে হয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সন্তানরা মাটির কাজ শিখতে চায় না। তারা অন্য পেশায় নিযুক্ত হচ্ছে। আমরা যারা আছি অন্য কোনো কাজ না জানার কারণে লেগে আছি।
সুকুমার পালের সহধর্মিণী মায়া রানী পাল বলেন, ‘মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল এখন আর চলে না। এখন শুধুমাত্র মিষ্টির দোকানে দইয়ের পাতিলের চাহিদা রয়েছে। প্রতি পাতিল ৯ টাকা করে বিক্রি করি। এই দিয়েই এখন আমাদের সংসার চলে।’ শিবপুরের যোশর গ্রামের মৃৎশিল্পী তপন পাল বলেন, একসময় সারা বছরই মাটির জিনিসপত্র তৈরি ও বিভিন্ন মেলাসহ দোকানে দোকানে বিক্রিতে আমাদের ব্যস্ত সময় কাটত। এখন সময় বদলেছে। মাটির জিনিসের চাহিদা কমেছে। এসব করে সংসার চালানো দায় হয়ে যায়। তাই অন্য পেশায় চলে এসেছি। তপন পাল আরও বলেন, আমাদের এটাকে শিল্প বলা হলেও সরকারিভাবে কম সুদে কোনো ঋণ সুবিধা আমরা পাই না। পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশিক্ষণ পাওয়া গেলে খেলনা, শোপিসসহ অন্যান্য শৌখিন জিনিস তৈরি করে মৃৎশিল্পীরা বেঁচে থাকতে পারতেন। এই শিল্পের ঐতিহ্যও রক্ষা করা যেত।
পলাশ পারুলিয়া মধ্যপাড়া কুমারপল্লীর বয়োবৃদ্ধ পাঁচ বোন এই পেশায় জড়িত। স্বামীর মৃত্যুর পর তারা সবাই বাবার বাড়ি এসে এই পেশায় যুক্ত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কিন্তু করোনায় বেচা-বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। তাই এক মুঠো ভাতের জন্য বিত্তশালীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়।
Advertisement
রাধা রানি পাল নামের একজন বললেন, ‘বৃদ্ধ বয়সে মাটির জিনিসপত্র বানিয়ে এবং বিক্রি করে কোনোরকম বেঁচে আছি। কিন্তু করোনায় আমাদের পথে বসিয়ে দিয়েছে। বেচা-বিক্রি বন্ধ থাকলেও পেটতো আর বন্ধ থাকে না। করোনার সময় মানুষের কাছে হাত পেতে একটু চাল বা আটা সাহায্য এনে জীবন কাটিয়েছি। সরকারি-বেসরকারি কোনো সহযোগিতা পাইনি।’
জিনারদী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. কামরুল ইসলাম গাজী বলেন, ‘মৃৎশিল্পীদের জন্য পরিষদ থেকে সরকারি আলাদা কোনো বরাদ্দ নেই। তাছাড়া কুমারপল্লীর লোকজন কোনো সমস্যার জন্য আসেনি। তবে এই শিল্পের ওপর সরকার ঋণ দেয়। তারা ইচ্ছে করলে সেটা নিতে পারে।
সঞ্জিত সাহা/এসআর/এএসএম