বিশেষ প্রতিবেদন

পাতে ফিরেছে বিলুপ্তপ্রায় দেশি মাছ

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির অনেক মাছ। বিলুপ্তপ্রায় এসব মাছ পাতে ফেরাতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। এ কাজে সফলও হয়েছে সংস্থাটি। ইতোমধ্যে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ পদ্ধতি আবিষ্কার করে ২৪ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় দেশি মাছ ফিরিয়ে এনেছেন সংস্থাটির বিজ্ঞানীরা। এছাড়া আরও ১০ প্রজাতির মাছ নিয়ে চলছে গবেষণা। এর মধ্যে পাঁচটির গবেষণা চূড়ান্ত সফলতার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।

Advertisement

ময়মনসিংহে অবস্থিত বিএফআরআইয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে দেশি প্রজাতির ছোট মাছ। দেশে মিঠা পানির মাছের মোট প্রজাতি ২৬০টি। এর মধ্যে ১৪৩ প্রজাতির ছোট মাছ রয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) ২০১৫ সালের তথ্যমতে, এর মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতি ৬৪টি।

বিএফআরআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ধারাবাহিকভাবে গবেষণার মাধ্যমে এসব মাছের মধ্যে পাবদা, টেংরা, শিং, মাগুর, গুলশা, গুজি আইর, চিতল, ফলি, মহাশোল, বৈরালি, জাত পুঁটি, মেনি, বালাচাটা, গুতুম, কুচিয়া, বাগনা, খলিশা, বাটা, দেশি সরপুঁটি, কালবাউশ, দেশি কৈ, গজার, গনিয়া এবং আঙ্গুস বা আগুনমুখা- এই ২৪টি প্রজাতির দেশীয় মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। এখন এই মাছগুলো চাষ হচ্ছে।

এছাড়া ইনস্টিটিউট বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় মাছ ঢেলা, শাল বাইম, রাণী, কাজলি, পিয়ালি, বাতাসি, কাকিলা, ভোল, বাইক্যা ও মিঠা পানির পোয়া- এই ১০টি মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করছে। এর মধ্যে অন্তত ৪-৫টি মাছের ক্ষেত্রে আগামী জুন মাসের মধ্যে সফলতা আসবে বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা।

Advertisement

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (ডিজি) ইয়াহিয়া মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রাচীনকাল থেকে দেশীয় প্রজাতির মাছ আমাদের সহজলভ্য পুষ্টির অন্যতম উৎস্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এসব মাছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ রয়েছে। এসব উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে এবং রক্তশূন্যতা, অন্ধত্ব প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলাশয় সংকোচন, অতিআহরণসহ নানাবিধ কারণে মাছের প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র বিনষ্ট হওয়ায় প্রাকৃতিক জলাশয়ে ছোট মাছের প্রাপ্যতা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে।’

বিএফআরআই বিলুপ্তপ্রায় ও দেশীয় মাছের ওপর গবেষণা করে ইতোমধ্যে ২৪ প্রজাতির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, ‘এসব প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারিত হওয়ায় বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছের প্রাপ্যতা সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মাছের মূল্য সাধারণ ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে এসেছে।’

ইয়াহিয়া মাহমুদ আরও বলেন, ‘ইতোপূর্বে শুধুমাত্র ময়মনসিংহের স্বাদুপানির মাছ গবেষণা কেন্দ্র থেকে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে গবেষণা পরিচালনা করা হতো। এখন ময়মনসিংহের কেন্দ্র ছাড়াও বগুড়ার সান্তাহার, নীলফামারীর সৈয়দপুর এবং যশোর উপকেন্দ্রেও বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণে গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে।’

বিএফআরআইয়ের ডিজি বলেন, ‘যে মাছ যে পরিবেশে থাকে, প্রজনন করার জন্য সেটি তৈরি করতে হয়। প্রজাতিটি কোন পরিস্থিতিতে ডিম দেয় সেটা বের করতে হয়। পেটে ডিম কোন মাসে কত শতাংশ আসছে সেটা স্টাডি করতে হয়। মে মাস ডিম দেয়ার উপযুক্ত সময়, সে সময়টা টার্গেট করে আমরা পরিবেশ তৈরি করি। তবে সব মাছ একই সময়ে ডিম দেয় না।’

Advertisement

এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এরপর হরমোন ইনজেকশন দেয়া হয়। এক মাছের ডোজ একেক রকম। এটি অপটিমাইজ করতে সময় লাগে। এমনও আছে যে আমরা একটি মাছের জন্য ১৫ বছর ধরে চেষ্টা করছি, কিন্তু হচ্ছে না। আগামী জুন-জুলাইয়ের মধ্যে আরও ৪-৫টি প্রজাতি আসতে পারে। সেগুলো অনেকটাই প্রস্তত হয়ে আছে।’

গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিএফআরআইয়ের কর্মকর্তারা জানান, আইইউসিএনের তথ্য অনুযায়ী টেংরা বর্তমানে একটি বিপন্ন প্রজাতির মাছ। প্রজাতিটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষায় এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিতে ইনস্টিটিউটের সৈয়দপুরের স্বাদুপানি উপকেন্দ্রে কৃত্রিম প্রজনন, পোনা প্রতিপালন এবং চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়। উদ্ভাবিত প্রযুক্তি মৎস্য অধিদফতরে ইতোমধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে এর চাষাবাদ শুরু হয়েছে ।

বিপন্নের হাত থেকে রক্ষায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সৈয়দপুর স্বাদুপানি উপকেন্দ্র রংপুরের চিকলি নদী ও দিনাজপুরের আত্রাই নদী থেকে বরালি মাছ সংগ্রহ করে উপকেন্দ্রের পুকুরে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে প্রতিপালন করে। ২০২০ সালে দেশে প্রথমবারের মতো বরালি মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফলতা আসে। ফলে এর পোনা সহজলভ্য হয়েছে এবং ইতোমধ্যে উত্তরবঙ্গে এর চাষাবাদ শুরু হয়েছে।

বালাচাটা মাছ বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ইনস্টিটিউট থেকে ২০১৯ সালে দেশে প্রথমবারের মতো এর কৃত্রিম প্রজনন, নার্সারী ব্যবস্থাপনা ও চাষ কৌশল উদ্ভাবন করা হয়।

খলিশা মাছকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এবং চাষের জন্য পোনা প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা পরিচালনা করে। ২০১৮ সালে মাছটির কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন কলাকৌশল উদ্ভাবনে সাফল্য আসে বলে জানান বিজ্ঞানীরা।

তারা আরও জানান, কুচিয়াও বর্তমানে একটি বিপন্নপ্রায় প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত। কুচিয়া অন্যতম পুষ্টি সমৃদ্ধ ও ঔষধি গুণসম্পন্ন একটি মাছ। আন্তর্জাতিক বাজারে এর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে কুচিয়ার পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জিত হয়েছে। কুচিয়ার পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জিত হওয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে কুচিয়ার নির্বিচারে আহরণ হ্রাস পাচ্ছে এবং এর চাষাবাদ সহজ হয়েছে।

ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি কেন্দ্রে ২০২০ সালে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে জাত পুঁটি মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জিত হয়েছে। বর্তমানে পোনার নার্সারী গবেষণা চলমান রয়েছে বলেও জানিয়েছেন বিএফআরআইয়ের মহাপরিচালক।

দেশীয় ছোট মাছ সুরক্ষাসহ গবেষণায় গৌরবজনক ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে গত বছর (২০২০) একুশে পদক অর্জন করে বিএফআরআই।

আরএমএম/এমএইচআর/এসএইচএস/জেআইএম