কৃষি ও প্রকৃতি

নাটোরে বিনাচাষে রসুনের বাম্পার ফলন

নাটোরে বিনাচাষে রসুনের বাম্পার ফলন

কম খরচে বেশি ফলন ও বছরব্যাপী চাহিদার কারণে নাটোরের বাড়ছে বিনাচাষে রসুনের আবাদ। সঠিক পরিচর্যা ও অনুকূল আবহাওয়া বরাবরের মতো এবারও রসুুনের বাম্পার ফলনের নেপথ্যে, জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। তবে উৎপাদিত রসুনের নায্য দাম নিয়ে শঙ্কা রয়েছে চাষিদের।

Advertisement

প্রতি বছর দেশে রসুনের মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশই উৎপাদিত হয় নাটোরে। নাটোর থেকে সরবরাহ করা রসুনের আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। চাষিরা বলছেন, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে রসুন আবাদ করলে নাটোরের রসুন কমাতে পারে মসলাজাতীয় ফসলের আঞ্চলিক ঘাটতি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, ২০২০-২১ মৌসুমে জেলায় ২৫ হাজার ১৩০ হেক্টর জমিতে রসুন উৎপাদন হয়েছ। গত ২০১৯-২০ মৌসুমে জেলায় ২০ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে রসুন উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এছাড়া গত ৮ বছরে জেলায় রসুন উৎপাদিত হয়েছে ১২ লাখ ৬২ হাজার ৫৫৪ মেট্রিক টন।

চলতি মৌসুমে নাটোর সদর উপজেলায় ৩৪৫০ হেক্টর, নলডাঙ্গায় ৬৫০ হেক্টর, সিংড়ায় ১৪৬০ হেক্টর, গুরুদাসপুরে ৬৩০০ হেক্টর, বড়াইগ্রামে ১০৭৪০, বাগাতিপাড়ায় ১১১০ হেক্টর এবং লালপুরে ১৫০ হেক্টর জমিতে রসুনের আবাদ হয়েছে। হেক্টর প্রতি গড়ে ৮ মেট্রিক টন করে প্রায় ২ লাখ মেট্রিক টন রসুন উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে জেলাজুড়ে।

Advertisement

কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১১-১২ মৌসুমে জেলায় ১৫ হাজার ১২৫ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন, ২০১২-১৩ মৌসুমে ১৮ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ১১ হাজার ৪৩ মেট্রিক টন, ২০১৩-১৪ মৌসুমে ১৫ হাজার ৩৬০ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮ মেট্রিক টন, ২০১৪-১৫ মৌসুমে ১৭ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৩ মেট্রিক টন, ২০১৫-১৬ মৌসুমে ১৮ হাজার ২৩০ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন, ২০১৬-১৭ মৌসুমে ২৫ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ১ হাজার ৯৪৬ মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ মৌসুমে ২৮ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৯০ হাজার ৯৭ মেট্রিক টন এবং ২০১৮-১৯ মৌসুমে ১ লাখ ৪১ হাজার ৪৫৭ মেট্রিক টন রসুন উৎপাদিত হয়।

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পূর্বের বছরের তুলনায় ২০১২-১৩ মৌসুমে চাষের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও আবাদ কমে যায় রসুনের। পরের বছর আবাদের পরিমাণ কমলেও উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ৫৪ হাজার মেট্রিক টন। পরবর্তী তিন মৌসুমে আবাদের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে রসুনের উৎপাদন বাড়তে থাকে। ২০১৬-১৭ উৎপাদন মৌসুমে ২ লাখ ১ হাজার ৯৪৬ মেট্রিক টন রসুন উৎপাদন হয় নাটোরে যা এখন পর্যন্ত জেলার সর্বোচ্চ রসুন উৎপাদন।

পরের বছর কৃষক উৎসাহিত হয়ে আবাদের পরিমাণ বাড়ালে কিছুটা কম রসুন উৎপাদিত হয়। হঠাৎ করে গত ২০১৮-১৯ মৌসুমে কৃষক আবাদের পরিমাণ কমিয়ে দিলে উৎপাদন কমে ১ লাখ ৪১ হাজার ৪৫৭ মেট্রিক টনে নেমে আসে। ২০১৯-২০ মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৬১ হাজার মেট্রিক টন রসুন উৎপাদন হয়েছে। চলতি মৌসুমে ফলন ভালো হলে ২ লাখ মেট্রিক টন রসুন উৎপাদিত হবে।

সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে ফসলের মাঠে রসুনের সমারোহ। শেষ মুহূর্তে রসুনের জমি পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছে চাষিরা।

Advertisement

চাষিরা জানান, বন্যার পানি নামার পর বা আমন ধান কাটার শেষে ভেজা জমিতে বীজ বপন করে খড় ছিটিয়ে রসুনের আবাদ হলো বিনাচাষের রসুন। গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রামের বিস্তীর্ণ ফসলি জমিতে বিনাচাষে রসুন আবাদই জেলায় বৃহদায়তন রসুন উৎপাদনের কারণ। অপরদিকে, বীজ বপনের পর পরিমাণমতো টিএসপি, মিউরেট অব পটাশসহ অনান্য উপাদান প্রয়োগ করে জমি প্রস্তুতের মাধ্যমে আবাদ হলো স্বাভাবিক আবাদ। এ পদ্ধতিতে নলডাঙ্গা, সিংড়া, লালপুর, বাগাতিপাড়া ও নাটোর সদরের বেশ কিছু এলাকায় রসুন আবাদ হয়।

বড়াইগ্রামের জোনাইলের রসুন চাষি আক্কাস আলী বলেন, ‘অন্য আবাদের চেয়ে রসুুন চাষে খরচ কম হয়। এক বিঘা জমিতে রসুুন চাষ করতে বীজ, শ্রমিক ও সারসহ ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়।’

গুরুদাসপুরের চাষি আবুল কালাম বলেন, ‘গত বছর রসুনের দাম ভালো থাকায় এবার ৪ বিঘা জমিতে রসুনের চাষ করেছি। শীতে কয়েক দফা কুয়াশার কারণে রসুনের কিছুটা ক্ষতি হয়েছিলো।'

নলডাঙ্গার রসুন চাষি রানা আহমেদ বলেন, 'বাজারে ভালো দাম পেলে এক বিঘা জমির রসুন বিক্রয় হবে ৬০-৭০ হাজার টাকা। কিন্ত বাজারে দামে স্থিতিশীলতা থাকে না অনেক সময়। লাভের আশায় কৃষক যে বছর রসুন আবাদে ঝোঁকে, সে বছরই দাম পড়ে যায় রসুনের।’

জাতীয় কৃষক সমিতির জেলা সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম বলেন, প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ কৃষকদের বিনামূল্যে সরবরাহ করা হলে রসুনের বৃহদায়তন উৎপাদন সম্ভব হবে। আঞ্চলিত উৎপাদনে গুরুত্ব দিলে আমদানি নির্ভরতা কমে যাবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সুব্রত কুমার সরকার বলেন, 'দেশে রসুনের উৎপাদন ঘাটতি মোকাবিলায় নাটোরে চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন ও চাষ পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ সহায়তার মাধ্যমে রসুন চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা হলে এখান থেকে দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ভবিষ্যতে রসুন রফতানিও করা যাবে। তবে এবার চাষিরা ভালো দাম পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এমএমএফ/জেআইএম