মতামত

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে কাদেরকে প্রতিরোধ গড়তে বললেন মা

দেশমাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য টাঙ্গাইল অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল কাদেরিয়া বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কাদেরিয়া বাহিনী এক বিস্ময়। একাত্তরের এই গেরিলা বাহিনী টাঙ্গাইল অঞ্চলে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আবদুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে এই সশস্ত্র সদস্যের ১৮ হাজার বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী।

Advertisement

আবদুল কাদের সিদ্দিকীর পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি উপজেলার ছাতিহাটি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আবদুল আলী সিদ্দিকী, মায়ের নাম লতিফা সিদ্দিকী। ১৯৭১ সালে তিনি শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৯৬৭ সালে সামরিক প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। অধ্যয়নকালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে সেনাবাহিনীতে কিছুদিন চাকরি করে ১৯৬৭ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার শিক্ষাজীবনে ফিরে যান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।

১৯৬৭ সালের পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আসার পর একটানা এতদিন মাকে ছাড়া থাকেননি কাদের সিদ্দিকী। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীও যুদ্ধে যোগদান করেন। কাদের সিদ্দিকী জনতার পক্ষ থেকে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীকে অনুরোধ করেন এবং শপথ পাঠ করানোর সময় বলেন যে, ‘সর্বাধিনায়ক গণপরিষদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী হাতের কোরআন ও পতাকা স্পর্শ মুক্তিযোদ্ধা করে শপথ নিন—আপনার জীবন পণ করে এই পতাকা সমুন্নত রাখবেন’।

আবদুল লতিফ সিদ্দিকী শপথ বাক্য উচ্চারণ করলেন, ‘আমি আজ বাঙালি জাতির নামে দেশমাতৃকার নামে পবিত্র কোরআন শরিফ ও বাংলার পতাকা স্পর্শ করে শপথ করছি—গত ২৫ বছর যে মর্যাদায় পাকিস্তানের পতাকাকে সমুন্নত রেখেছি, বাংলাদেশের পতাকাকে তার চাইতে অধিক মর্যাদা দেব। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে এ মর্যাদা রক্ষা করবো। ন্যায়ের সংগ্রামে আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী। আল্লাহ আমাদের ইয়াজিদের মোকাবিলা করার তৌফিক দিন, আমিন।’

Advertisement

টাঙ্গাইল পতনের পর আর কাদের সিদ্দিকী এবং লতিফ সিদ্দিকীর বাড়িতে থাকা সম্ভব হয়নি। এমনকি পরিচিত-আত্মীয়স্বজন সবার কাছে তাঁরা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন—পাকিস্তানিদের ত্রাসের শিকার হবেন ভেবে। বাড়ির লোকজন এবং গ্রামের কেউ কেউ বলাবলি শুরু করলো—‘লতিফ সিদ্দিকী করে রাজনীতি, তাঁর ছোট ভাই কাদের সিদ্দিকী হয়েছে পাকিস্তানিদের দুশমন। পাকিস্তানিরা ওদের সম্পর্কে লোকের কাছে জিজ্ঞেস করছে, খোঁজাখুঁজি করছে। নিজেরাও খুঁজছে। পাকিস্তানি বাহিনী যদি জানতে পারে যে, লতিফ সিদ্দিকী-কাদের সিদ্দিকীর মা-বাবা, ভাই-বোন এই গ্রামে থাকে তাহলে আর কারও রক্ষা নেই।

ওদের খুঁজতে এসে আমাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেবে; মা-বোনদের অপমান করবে। আমাদের ধরে ধরে জবাই করবে। ওদের জন্য আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারি না। দিনেও স্বস্তি নেই রাতেও ঘুমাতে পারছি না। আরজু আর বজ্র (যথাক্রমে লতিফ সিদ্দিকী ও কাদের সিদ্দিকীর পারিবারিক নাম) আমাদের পরিবারের কলঙ্ক অভিশাপ। তাঁরা যুদ্ধ করবে? পাকবাহিনীর সঙ্গে? কত এমপি, এমএলএ, নেতা উপনেতা, মন্ত্রী-মিনিস্টার, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট—সবাই গেল পালিয়ে আর বজ্র করবে যুদ্ধ? তার মতো আমরা তো পাগল না? ওদের ধরিয়ে দেয়া উচিত। খতম হয়ে যাক। নইলে আমরা বাঁচবো না। তাড়াতাড়ি গ্রাম ছাড়।’

এ পরিস্থিতিতে আত্মীয়-পরিজন এমনকি আপন চাচার কাছেও আশ্রয় সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। তাঁদের ছোট অসহায় দুই বোনকে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়রা তাঁদের বাড়িতে এক ঘণ্টার জন্যও থাকতে দিতে রাজি হয়নি। অথচ যার মাথার মূল্য এক লাখ টাকা তাঁকে পাশের গ্রামের এক অনাত্মীয় পরিবার হাজারো বিপদ ও ঝুঁকি মাথায় নিয়ে পরম যত্ন সহকারে রেখেছেন।

দীর্ঘদিন পর যোগাযোগহীন বিচ্ছিন্ন থাকার পর আবারো বাবা-মা, ভাই-বোনদের কাছে যাওয়ার জন্য কাদের সিদ্দিকী মনের ভেতরে একধরনের অস্থিরতা কাজ করছিল। আশ্রয়দাতার নিষেধ অমান্য করেও মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন দূর সম্পর্কের এক ফুফুর বাড়িতে। সেখানে তাঁর পরিবার সাময়িক সময়ের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি সেদিনের কথা বলছিলেন—“দরজার সামনে মা মা বলে ডাক দিতেই দরজা খুলে গেল। ছোট ভাই-বোনেরাও লাফালাফি করে ঘুম থেকে জেগে উঠলো। সে যে কী আনন্দ, যা শুধু অনুভবের। বাবা অসুস্থ ছিলেন; তিনিও ঘুম থেকে জেগে গেলেন। দুই ছেলেকে অনেক দিন না দেখে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। তাঁর দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার কারণেই শরীর অনেকটা ভেঙে পড়েছে।

Advertisement

সেই ২৭ মার্চ থেকে আমি ঘরছাড়া-নিরুদ্দেশ। মা ছেলের জন্য সব সময় খাবার তৈরি করেই রাখতেন। তাই যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে ও সঙ্গী ফারুককে পেট ভরে খাওয়ালেন। খাওয়া শেষে মায়ের পাশেই শুয়ে পড়লাম। মা বারবার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর কথা জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু বড় ভাইয়ের কোনো খোঁজ আমি দিতে পারলাম না। শুধু মাকে আশ্বস্ত করার জন্যই বললাম ‘ভালো আছেন।’ ছোট ভাই-বোনেরা আমাকে চারপাশ থেকে একঝাঁক মৌমাছির মতো ঘিরে রাখলো।

বিকেলে দু হাজার টাকা (একশত টাকার নোট) মায়ের হাতে দিয়ে বললাম, ‘মা এ টাকাগুলো শিগগিরই ভাঙেয়ে নিও; কিছুদিন পর হয়তো আর একশ টাকার নোটের ভাঙতি পাওয়া যাবে না; অচল হয়ে যেতে পারে।’ মায়ের সঙ্গে আমার যখন কথাবার্তা হচ্ছিল তখন ছোট বোন রহিমা, শুশমা, সাহানা জড়িয়ে ধরে বায়না ধরে সেদিনের রাতটুকু থেকে যেতে বললো। সেদিনও বাধ্য হয়ে সেখানে থাকতে হলো। সেদিন ছিল ১৮ এপ্রিল। সবার সঙ্গে দেখা হওয়ায় নতুন এক জীবনের স্বাদ পেলাম, যা প্রকাশের নয়।”

কাদের সিদ্দিকী কোনো সেক্টর- কমান্ডার ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধের আগে তাঁর কোনো সামরিক পরিচয়ও ছিল না; তবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। সেই কাদের সিদ্দিকী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন লক্ষাধিক যোদ্ধা নিয়ে একাত্তরে ১৮ হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা আর ৭২ হাজার স্বেচ্ছাসেবী দিয়ে তৈরি হয় তাঁর বাহিনী, নাম কাদেরিয়া বাহিনী। প্রকৃতপক্ষে কাদেরিয়া বাহিনী পৃথিবীর গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাসে এক বিস্ময় অসংখ্য গেরিলা যুদ্ধসহ বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অনেক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হন এই বাহিনীর অনেক মুক্তিযোদ্ধাও।

ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় ৭০টি যুদ্ধে অংশ নেয় কাদেরিয়া বাহিনী। অধিকাংশ যুদ্ধেই তাঁরা সফল হন। সম্মুখযুদ্ধগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—মাকড়াই, ধলাপাড়া কামুটিয়া, বল্লা , ফুলতলা, বাথুলি, পাথরঘাটা ও ঘাটাইলের যুদ্ধ। টাঙ্গাইলের ভুঞাপুর থানার মাটিকাটার যুদ্ধ—কাদেরিয়া বাহিনীর সবচেয়ে বড় ও সফল যুদ্ধ। ‘জাহাজমারা’ যুদ্ধ নামে এর খ্যাতি রয়েছে। এ যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি অবিস্মরণীয় সাফল্যের ঘটনা। এটি ছিল মূলত হানাদারদের অস্ত্রবাহী জাহাজবহরের ওপর কাদেরিয়া বাহিনীর অভিযান। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের উদ্দেশে হানাদার বাহিনীর অস্ত্রবোঝাই সাতটি জাহাজের একটি বহর ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট টাঙ্গাইলে ধলেশ্বরী নদীর সিরাজকান্দি ঘাটে নোঙর করে। এ খবরে কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার হাবিবুর রহমান ও তাঁর দল ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

জাহাজগুলো আবার যাত্রা শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি সুযোগ খুঁজতে থাকে। হাবিবুরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি অবস্থান নেয় মাটিকাটায় যমুনা নদীর তীরে। ১২ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে সেখান দিয়ে যাওয়ার পথে তিনটি ছোট জাহাজ বেশ কিছুদূর সামনে চলে যাওয়ার পর অস্ত্রবোঝাই দুটি জাহাজ কাছাকাছি এলেই গর্জে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের এলএমজি। এতে জাহাজ দুটির ওপর বসে থাকা পাকিস্তানি সেনারা গুলিবিদ্ধ হয়ে জাহাজের ওপরই মারা যায়; কেউ বা গুলিবিদ্ধ হয়ে নদীতে পড়ে যায়।

আর সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া জাহাজের হানাদার বাহিনীরা ভীত হয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধজয়ের পর মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা অস্ত্রবোঝাই জাহাজে উঠে বিপুল অস্ত্রের সম্ভার দ্রুত নামাতে শুরু করে। এগিয়ে আসেন মুক্তিকামী গ্রামবাসী। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা জাহাজ দুটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে উদ্ধারকৃত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিরাপদে সরে যান। জাহাজের লগবুক ও মুভমেন্ট অর্ডারের হিসাব অনযুায়ী, দখল করা জাহাজ দুটিতে তৎকালীন ২১ কোটি টাকা মূল্যের নানা ধরনের চায়নিজ, ব্রিটিশ ও মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র ছিল। এই অভিযানে সংগৃহীত অস্ত্রশস্ত্র টাঙ্গাইল মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী যুদ্ধগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে।

টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনী গড়ে ওঠার আগে টাঙ্গাইলের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের ২৬ মার্চের সভায় সশস্ত্র গণবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সে সিদ্ধান্ত অনুসারে শুরু হয়েছিল মুক্তিবাহিনী সংগঠনের কাজ ও সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম। ১৬ আগস্ট অকুতোভয় সেনা কাদের সিদ্দিকী ভূঞাপুরের কাছে মাকড়াইর যুদ্ধে আহত হন। হাতে ও পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। ১৮ নভেম্বর ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুরসহ সব সড়কের সেতু ভেঙে হানাদার বাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ১১ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় টাঙ্গাইল।

এরপর কাদেরিয়া বাহিনী সাভার হয়ে ঢাকার পথে রওনা হয়। এখনও সে সময়ের কথা পরিষ্কার মনে করতে পারেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ওই যুদ্ধে একদিকে পাকিস্তানিরা ছিল, অন্যদিকে আমরা। তিন দিন ধরে যুদ্ধ হয়েছে আমার গায়ে গুলি লাগে ১৬ আগস্ট। আমার হাতে এবং পায়ে গুলি লাগে এবং আমি গৌরববোধ করি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমি জীবন দিতে না পারলেও শরীরের রক্ত দিতে পেরেছি।’

কাদেরিয়া বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে বহু গেরিলা যুদ্ধে জয়লাভ করে। রণক্ষেত্রের সাফল্য দিয়েই সাধারণ মানুষের মন জয় করে নেয় এই বাহিনী। মানুষের আস্থা বাড়ে। কাদের সিদ্দিকী এই জনসমর্থনকেই গুরুত্ব দেন সবচেয়ে বেশি। একাত্তরের ডিসেম্বরে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমপর্ণে ঢাকা জয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখে কাদেরিয়া বাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে এক বিরল মুহূর্তে উপস্থিত ছিলেন কাদের সিদ্দিকী।

২৪ জানুয়ারি, ১৯৭২ টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে অস্ত্র জমা নিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেই প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশ বেতারের আর্কাইভে জাতির পিতার প্রতিশ্রুতিগুলো এখনো বাণীবদ্ধ আছে। নেতার আদেশে সে সমাবেশে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছিলেন, ‘আমরা আজ গবির্ত । যে নেতার আহ্বানে অস্ত্র ধরেছিলাম, দেশ স্বাধীন করে সেই মহান নেতার হাতেই আমরা অস্ত্র দিলাম। আমরা আশা করব, দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনে আমাদের এই অস্ত্র, এই পবিত্র আমানত কাজে লাগবে।

প্রিয় মুক্তিযোদ্ধারা, যুদ্ধের ময়দানে তোমাদের সামনে দিয়ে পেছনে থাকিনি। প্রতিটি যুদ্ধে তোমাদের আগে থেকেছি, আগে থাকার চেষ্টা করেছি।’ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বক্তৃতার সময় বঙ্গবন্ধু অঝোরে কাঁদছিলেন। তিনি বারবার রুমালে চোখ মুছছিলেন। সমবেত হাজার হাজার মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ ও বেদনায় বারবার অশ্রুসিক্ত হচ্ছিল।

বঙ্গবন্ধুর সামনে মাইক্রোফোন এগিয়ে দেওয়া হলে চোখে অশ্রু, কণ্ঠে আবেগ, দেহ-মনে আবেশ। যিনি ঘণ্টাখানেক আগে শিবনাথ স্কুল মাঠে সমবেত মুক্তিযোদ্ধাদের ‘আপনি’ সম্বোধনে বক্তৃতা করেছেন। তিনি এখানে নেতা, পিতা ও ভাইয়ের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের ‘তুমি’ সম্বোধন করে কান্নাজড়িত দরদভরা কণ্ঠে এক অবিস্মরণীয় বক্তব্য রাখেন—“আমি তোমাদের সালাম জানাই। ত্রিশ লক্ষ মা, ভাই-বোন শহীদ হয়েছে। আমি তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আমি তোমাদের অস্ত্র দিয়ে যেতে পারিনি। শুধু হুকুম দিয়ে গিয়েছিলাম। তোমরা হানাদারদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছ। তোমাদের তুলনা হয় না। বিশ্বে খুব কম জাতির এমন গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। তোমাদের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক, রক্তের বন্ধন। তোমাদের নেতা কাদেরকে আমি মায়ের পেট থেকে পড়ার পরই দেখছি। লতিফকে দেখেছি। তোমাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তোমরাই সত্যিকারের দেশ গঠনের উপযুক্ত সৈনিক। তোমরাই দেশ গঠন করবে।’’

অস্ত্র নেওয়ার পর বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে হাজার হাজার বীর জনতা ও কাদেরিয়া বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্যের সামনে যখন বক্তৃতা করছিলেন তখন তারা করতালি এবং স্লোগানে সব এলাকা মুখরিত করে তুলছিল। বঙ্গবন্ধু একপর্যায়ে বললেন, “আমার সন্তানেরা, প্রিয় মুক্তিযোদ্ধারা, তিন বছর আমি তোমাদের কিছু দিতে পারব না। আরও তিন বছর যুদ্ধ চললে তোমরা যুদ্ধ করতা না?” সারা মাঠ গর্জে ওঠে, “করতাম, করতাম।” বঙ্গবন্ধু আবার বললেন, “মনে কর যুদ্ধ চলছে। তিন বছর যুদ্ধ চলবে। আর সে যুদ্ধ হবে দেশ গড়ার যুদ্ধ। অস্ত্র হবে লাঙল-কোদাল-গাঁইতি-শাবল।”

বঙ্গবন্ধু মাইক্রোফোনের সামনে আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, ‘আমি আপনাদের সালাম জানাই। আমি প্রতিটি শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। সালাম জানাচ্ছি আপনাদের, টাঙ্গাইলবাসীদের, যারা কাদেরের মতো সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। টাঙ্গাইলের মানুষ যা করেছে তার তুলনা হয় না। আমি তাই আপনাদের সম্মান জানাতে সবার আগে টাঙ্গাইল এসেছি। আমার ৩০ বছরের পুরোনো বাড়ি হানাদাররা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে, আমি সেই বাড়ি দেখতে যাইনি।

টাঙ্গাইলে এসেছি। আপনারা যা করেছেন, টাঙ্গাইলের মুক্তিযোদ্ধারা, স্বেচ্ছাসেবকরা যা করেছেন, সে জন্যই তাদের এই সম্মান পাওয়া উচিত। এই সম্মান না দেখানো হলে অন্যায় করা হবে। আমি তাই আপনাদের মাঝে আপনাদের সালাম জানাতে এসেছি, শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। আমার দেশে এমন কোনো গ্রাম নেই, যেখানে পাকিস্তানি নরপশুরা অন্তত ১০ জন লোককে হত্যা করেনি। আপনাদের এখানে অসংখ্য লোক মারা গেছেন। টাঙ্গাইল নিয়ে আমার গর্ব হয়। সারাদেশে প্রতিটি জেলায় যদি একজন করে কাদেরের জন্ম হতো তাহলে আমাদের ৯ মাস যুদ্ধ করতে হতো না। আমাকে সাড়ে ৯ মাস ফেরাউনের জিন্দানখানায় বন্দি থাকতে হতো না। অনেক আগেই আমার দেশ স্বাধীন হতো। ১০টা কাদেরও যদি থাকত তাহলে হয়তো ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যের প্রয়োজন হতো না।

[...] তোমরা এই দেশেরই সন্তান। তোমরা সম্মানের সঙ্গে চিরকাল থাকবে। তোমরাই নতুন ইতিহাসের স্রষ্টা।’’১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হলে এর প্রতিবাদে কাদের সিদ্দিকী ভারত গমন করেন। ১৯৯০ সালে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। আত্মীয় তো কতই ছিল, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকরা খুন করলে কোনো আত্মীয় ধরা দেয়নি, কারও বাড়িতে জায়গা দেয়নি।”১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হওয়ার পরের কথা বলছিলেন, “তখন মৃত্যুপুরী ঢাকায় আট দিন ছিলাম। এই আট দিনের চার দিনই ছিলাম আর এ গণির বাড়িতে। যেদিন নিরুদ্দেশের পথে যাচ্ছিলাম সেদিন মাকে দেখার বড় সাধ জেগেছিল। মুরাদ কিংবা আজাদকে নিয়ে মা এসেছিলেন আর এ গণির বাড়িতে। মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলাম। মা বলেছিলেন, ‘বজ্র, তুই ঘরে থাকিস না। তোকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে মেরে ফেললে আমি বুক ভরে কাঁদতে পারব না। মা হিসেবে তুই আমায় কাঁদার অধিকার কেড়ে নিস না। আর সময় নিস না, বেরিয়ে পড়।

রাস্তায় গিয়ে মরলে আমি বলতে পারব, আমার সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছে। মনে রাখিস, খোদার বিচারে সময় লাগতে পারে। দেরি হতে পারে কিন্তু অবিচার অন্ধকারের কোনো জায়গা নেই।’ এর আগে মনে হয় কখনো মাকে অমন আকুল করে অনুভব করিনি। ১৬ বা ১৭ আগস্ট জিগাতলার মোহনের বাড়ি থেকে লিফলেট ছেড়েছিলাম, ‘খুনিরা কামাল, জামাল, রাসেলকে হত্যা করতে পারলেও বঙ্গবন্ধুকে নির্বংশ করতে পারেনি। আমি কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ সন্তান। যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ যুদ্ধ হবে বাংলায়। পিতৃ হত্যার বদলা আমরা নেবই নেব।’

প্রত্যেক মায়ের কাছেই তাঁর সন্তান আকাশের চাঁদ। মানবমুক্তির জন্য সত্যিকার অর্থেই এরকম মাও ছিলেন যাঁরা সন্তানকে জীবনদানের মন্ত্রও দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার অমৃত ফল অর্জনের জন্য প্রণতি জানাই সে মায়েদের।মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদানের জন্য বীর উত্তম উপাধি লাভ করেন কাদের সিদ্দিকী। ‘বঙ্গবীর’ নামেও বিশেষ পরিচিতি এই বীর মুক্তিযোদ্ধার।

পরিচয় : মুক্তিযোদ্ধা ও কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীবীর উত্তম।

মুক্তিযোদ্ধা : ১১ নং সেক্টর সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ : ১১ এপ্রিল, ২০১১ এবং ২০ আগস্ট ২০১৬ সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান : ৩০, বাবর রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

১.তথ্যসূত্র:

মার্জিয়া লিপি, ২০১৯, ‘ একাত্তর মুক্তিযোদ্ধার মা’ ; অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ৪৬/১ হেমেন্দ্র দাস রোড, সূত্রাপুর, ঢাকা-১১০০।

এইচআর/ফারুক/এএসএম