অপরাধ দমন ও অপরাধীদের ধরতে সোর্সের সহযোগিতা নিয়ে থাকে পুলিশ। কিন্তু রাজধানীর গাবতলী এলাকায় এ যেন হিতে বিপরীত। পুলিশের ছত্রছায়ায় এই সোর্সরাই দাপট ও ক্ষমতার চর্চা বেশি করেন। প্রবাদ আছে অসির চেয়ে মসি বড়। গাবতলীতে যেন এরই নামান্তর। চাঁদাবাজিতে যেন সোর্স-পুলিশ মাসতুতো ভাই! ভুক্তভোগী পথচারী দোকানদার, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাসিন্দা এবং সাধারণ যাত্রীরা অভিযোগ করে বলেন, রাজধানী ঢাকার প্রবেশপথ গাবতলী। রাজধানীর বড় পশুর হাট, বড় বাস টার্মিনালও এখানে। স্থলপথ উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের চলাচল এই বাস টার্মিনালেই বেশি। এমন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি, অপরাধ কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে নানামুখি তৎপরতা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানেই সাধারণ জনগণ নানাভাবে হয়রানি হচ্ছেন। এখানে পুলিশের যোগসাজশেই অবৈধভাবে দোকান বাণিজ্য, যাত্রী ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাঁদাবাজি ও তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। গাবতলীর ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অভিযোগ- সোর্সদের নিত্য নৈমিত্তিক চাঁদাবাজি ও হয়রানির পিছনে রয়েছে পুলিশের হাত। তারা নিজেরা সরাসরি চাঁদাবাজি না করে সোর্সের মাধ্যমে এসব করছে। যারা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানায় তাদের অনেককেই তল্লাশির নামে ইয়াবা ও গাঁজা ধরিয়ে দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এরকম ঘটনা অহরহ। তবে পুলিশের মিরপুর বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলছেন, গাবতলীতে পুলিশ কিংবা পুলিশের ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজি হয় না। তবে এ ধরণের অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে। গত বুধবার সন্ধ্যায় সাকুরা বাস থেকে নামেন বরিশাল থেকে আসা নবিরুল ইসলাম নামে এক যাত্রী। কাঁধে ও হাতে দুটি ব্যাগ নিয়ে টেকনিক্যালের কাছে পেট্রল পাম্পের মোড়ে আসলে কয়েকজনের বাধার মুখে পড়েন তিনি। পড়ে ইয়াবা আছে বলে পুলিশের সোর্স পরিচয় দিয়ে ঝটপট পকেটে হাত দিয়ে বসে তারা। পরে প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে ইয়াবা ট্যাবলেট পেয়েছেন বলে চেচিয়ে বলে, ‘স্যার পাওয়া গেছে’। এবার বিপদ বুঝে নবিরুল পুলিশ সদস্যদের হাতে পায়ে ধরেন। কাছে থাকা ৩ হাজার টাকা ও হাত ঘড়ি দিয়ে নিস্তার পান তিনি। গত শুক্রবার ভোরে রাজশাহী থেকে হানিফ বাসে করে গাবতলীতে নামেন সিল্ক শাড়ির ব্যবসায়ী মজিবর রহমান। গাঁজা আছে বলে তার কাছে থাকা ব্যাগে তল্লাশি শুরু করে কয়েকজন। পরিচয় জানতে চাইলেই চড় মেরে একজন বলে, আমার নাম বাবুল। আমি পুলিশের সোর্স। পরে ব্যাগ থেকে গাঁজার প্যাকেট পাওয়া গেছে অভিযোগ করে সে বলে, ‘গাঁজা বিক্রি করতে ঢাকা আসছো’? এই ভুক্তভোগী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি জীবনে গাঁজা খাইনি। তবে আমার কাছে ছিল সিগারেট। তারা আমাকে গাঁজা আছে বলে পেট্রল পাম্পের পেছনে নিয়ে গিয়ে বলে ৩০ হাজার টাকা না দিলে থানায় সোপর্দ করার হুমকি দেয়। হয়রানির ভয়ে ২৩ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পাই।’ শুধু হয়রানির মাধ্যমে চাঁদাবাজি নয় গাবতলীতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অনুমতির বাইরে অবৈধভাবে বসা কমপক্ষে ২শ’ দোকানপাট থেকেও চাঁদাবাজি করছে পুলিশ। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পুলিশ এসব অবৈধ দোকান থেকে বাণিজ্য করে আসছে পুলিশ। এসব অবৈধ দোকানের বাইরেও বৈধ দোকান থেকেও সোর্সের মাধ্যমে চাঁদাবাজি করছে পুলিশ। হারাধন নেত্র নামে একজন জানান, আগে গাবতলীতে জুতার পলিশ ও সেলাইয়ের (মুচি) কাজ করতাম। এখন ওই দোকানে আর বসি না। এখন রিকশা চালাই। পুলিশ আর পুলিশের সোর্সের জ্বালায় আর বসা হয় না। ওরা প্রতিদিন আমার কাছ থেকে ২০০ টাকা করে নিতো। রেজাউল নামে এক সোর্স প্রতি সন্ধ্যায় এসে টাকা নিয়ে যেতো। দোকান ও নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাজার রোডের এক ফাস্ট ফুড ব্যবসায়ী জানান, প্রতিদিন পুলিশ পরিচয়ে সাদেক ও ওসমান নামে দুই সোর্স এসে ৪০০ টাকা করে নিয়ে যায়। পুলিশের সঙ্গে তারা এখানে খেতে আসলেও কখনো বিল দেয় না। পুলিশের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করায় সাহস করে কিছু বলতে পারিনি। এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে দারুস সালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেলিমু্জ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘গাবতলীতে দোকানপাট বসবে কি বসবে না, বৈধ না অবৈধ তা দেখার জন্য আমি বা থানা পুলিশ বসে নেই। তা দেখার দায়িত্ব কিন্তু ওই সিটি কর্পোরেশনের’। ‘পুলিশই টাকার বিনিময়ে অবৈধ দোকানপাট বসতে দিচ্ছে। আর সোর্স পরিচয়ে সাধারণ যাত্রীদের হয়রানি করা হচ্ছে। এমন অভিযোগ স্বয়ং আপনার বিরুদ্ধেও রযেছে’ বলে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মানে! আমাকে সরকার কি টাকা কম দেয়? আমি টাকার বিনিময়ে অবৈধ দোকানপাট বসাতে যাবো কেন’? এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. কাইয়ুমুজ্জামান খান জাগো নিউজকে বলেন, গাবতলীতে পুলিশের চেয়ে সোর্স বেশি না। আর সোর্স তো পুলিশের সহযোগিতার জন্য মাত্র। তার মানে এই নয় যে সোর্স তল্লাশি করতে পারবে, হয়রানি তো দূরের কথা। পুলিশি ছত্রছায়ায় কথিত সোর্স পরিচয়ে চাঁদাবাজির বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।জেইউ/একে/পিআর
Advertisement