‘মার্চ’, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জঘন্য, পৈশাচিক আর বর্বরোচিত হামলায় লাখো বাংলাদেশি মানুষের বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হওয়ার মাস। বীর বাঙালির স্বাধীনতার মাস।
Advertisement
জানেন কি! এ মাসেই একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হয়েছিল টাইগারদের। ৩৫ বছর আগে এই স্বাধীনতার মাসে ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ, শ্রীলঙ্কার মোরাতোয়ায় প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিল টিম বাংলাদেশ।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশ প্রথম প্রতিপক্ষও ছিল পাকিস্তান। এখনকার প্রজন্ম মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, রিয়াদ, লিটন, সৌম্য, মিরাজ, মোস্তাফিজদের ভক্ত। তাদের পছন্দর তারকা মূলত এরাই।
কিন্তু তিন যুগ আগে যারা ওয়ানডে জগতে প্রথম পা রেখেছিলেন, দেশের হয়ে সে সময়ের অন্যতম দুর্ধর্ষ দল পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়েছিলে, তাদের সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের ধারণা নেই বললেই চলে। অনেকের হয়তো নামও জানা নেই।
Advertisement
প্রথম ওয়ানডে খেলা সেই একাদশে ছিলেন কারা? গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর নেতৃত্বে যে ১১ বীর বাংলাদেশি ক্রিকেটার (রকিবুল হাসান, নুরুল আবেদিন নোবেল, শহিদুর রহমান, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, রফিকুল আলম, গোলাম ফারুক সুরু, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা, হাফিজুর রহমান সানি, গোলাম নওশের প্রিন্স ও সামিউর রহমান সামি) ব্যাট ও বল হাতে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন, তাদের সম্পর্কে ক’জনই বা জানেন?
সেই একাদশের ক্রিকেটাররা এখন কে কোথায়? তারা সবাই জীবিত তো? দেশে আছেন নাকি প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন কেউ কেউ? এসবের খোঁজ কেউ’ই রাখে না।
অথচ ভুলে গেলে চলবে না, দেশ স্বাধীন হওয়ার ১৫ বছর পার হওয়ার আগেই ওই ক্রিকেট সেনারা ইমরান খানের নেতৃত্বে জাভেদ মিয়াঁদাদ, মহসিন খান, মুদাসসার নজর, রমিজ রাজা, কাশিম ওমর, মঞ্জুর এলাহি, ওয়াসিম আকরাম আর আব্দুল কাদিরের মতো নামি ক্রিকেটারে সাজানো শক্তিশালী পাকিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নেমেছিলেন।
বর্তমান ক্রিকেট ভক্ত, অনুরাগী ও সমর্থকদের জন্য সুখবর, দেশের অন্যতম শীর্ষ ও জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কম সেই সব ক্রিকেট যোদ্ধার জীবন কাহিনি উপস্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। সেই ৩৫ বছর আগে দেশের হয়ে প্রথম ওয়ানডে খেলা ১১ ক্রিকেট যোদ্ধার ক্রিকেটীয় এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন নিয়ে ধারাবাহিকভাবে পাঠকদের সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে।
Advertisement
শুরুতেই আজ তুলে ধরা হলো সেই একাদশের ওপেনার নুরুল আবেদিন নোবেলের খোঁজ-খবর। এ ডান হাতি ওপেনার ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ শ্রীলঙ্কার মোরাতোয়ায় পাকিস্তানের বিপক্ষে সিনিয়র পার্টনার রকিবুল হাসানের সাথে ব্যাট হাতে ইনিংসের সূচনা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচের প্রথম বলটিও মোকাবিলা করেছিলেন তিনি।
ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বল মোকাবিলা করা নুরুল আবেদিন নোবেলের গল্প
দেশের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। যে ম্যাচের একাদশে ঠাঁই মিলেছে দুই সহোদরের। একসঙ্গে দেশের অভিষেকে দুই সহোদরের অভিষেক- এমন ঘটনা ক্রিকেট ইতিহাসে আছে কি না, সন্দেহ। ছোট ভাই মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর সঙ্গে অভিষেকের ক্যাপ উঠলো বড় ভাই নুরুল আবেদিন নান্নুর মাথায়ও।
তারকা খ্যাতি ও আন্তর্জাতিক এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে সুনাম-সুখ্যাতি ও সাফল্য বেশি। পরিসংখ্যানও সমৃদ্ধ। বিশেষ করে ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্সে ছোট ভাই নান্নুই এগিয়ে।
তাই বলে নোবেলকেও খাটো করে দেখার কিছু নেই। ঘরোয়া ক্রিকেটে নোবেলও অনেক সফল উইলোবাজ এবং নামি ব্যাটসম্যানদের কাতারের ওপরের দিকেই তার অবস্থান।
আসুন জেনে নেই কে এই নুরুল আবেদিন নোবেল? এখন কী করেন তিনি?
আপন সহোদর, ছোট ভাই মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর মতো নুরুল আবেদিন নোবেলও ‘লালমাটিয়ার’ হয়ে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে খেলোয়াড়ি জীবন শুরু করেছিলেন। ঠিক ৪০ বছর আগে, ১৯৮১ সালে প্রথম ঢাকায় ক্রিকেটে পা রাখেন চট্টগ্রামের বিখ্যাত ক্রীড়া পরিবার ও শহীদ পিতা শামসুল আবেদিনের জ্যৈষ্ঠ সন্তান নুরুল আবেদিন নোবেল।
দুই চাচা সুলতান ও সেলিম আবেদিন চট্টগ্রামের খেলাধুলা অঙ্গনের খুবই পরিচিত মুখ। বন্দর নগরীর খেলাধুলা বিশেষ করে ক্রিকেট অঙ্গনের নামি, বরেণ্য ও প্রসিদ্ধ সংগঠক। চট্টগ্রামের ক্রিকেট অগ্রযাত্রার প্রথমসারির নেপথ্য কারিগর।
নিজ শহর চট্টগ্রাম ছেড়ে রাজধানী ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে লালমাটিয়ার হয়ে দুই বছর খেলার তৃতীয় বছরে নোবেল পাড়ি জমান রেলওয়েতে। দেশের ক্রিকেটের সফলতম সেনাপতি ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়ী দলের অধিনায়ক আকরাম খান, ১৯৮৬ সালে টিম বাংলাদেশের হয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে খেলা শহিদুর রহমান শহিদ আর স্টাইলিশ উইলোবাজ জাহিদ রাজ্জাক মাসুমসহ আশি ও নব্বইর দশকে দেশের অনেক নামি ও শীর্ষ ক্রিকেটার এই রেলওয়ে দলের হয়েই ঢাকাই ক্রিকেটে পা রাখেন।
রেলওয়েতে খেলার এক বছর পরই নোবেল যোগ দেন আরেক প্রসিদ্ধ দল সূর্যতরুণে। আজকের নন্দিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার ও সাবেক জাতীয় দলের ক্রিকেটার আতহার আলী খান তখন সূর্যতরুণের অধিনায়ক এবং নোবেল যখন জাতীয় দলের হয়ে প্রথম ওয়ানডে খেলেন, তখন ক্লাব ক্রিকেটে তার দল সূর্যতরুণ।
এখন টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি ম্যাচের প্রতিটি বলের বর্ণনা দেয়া হয়। স্কোরকার্ডের পাশে ক্রিকেটের বিশ্বনন্দিত ওয়েবসাইট ক্রিকইনফো, ক্রিকবাজসহ অন্য ওয়েবসাইটে স্কোরকার্ডের পাশে ‘কমেন্ট্রি ’ অপশন থাকে। সেখানে ব্রাউজ করলেই প্রতিটি ডেলিভারির বর্ণনা পাওয়া যায়।
কিন্তু আশি ও নব্বই দশকের খেলার বল টু বল কমেন্ট্রি অপশন ছিল না। ১৯৮৬ সালে শ্রীলঙ্কার মোরাতোয়ায় পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বল কে মোকাবিলা করেছিলেন? তা জানতে নুরুল আবেদিন নোবেলের কাছেই দ্বারস্থ হতে হবে।
সে ম্যাচের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নোবেল এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার সঙ্গী ছিলেন রকিবুল ভাই (জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও ওপেনার)। আমিই প্রথম বল মোকাবিলা করি। যতদূর মনে পড়ে প্রথম বলটি করেছিলেন ওয়াসিম আকরাম। এখনো মনে আছে অনেক দ্রুত গতির এক্সপ্রেস ডেলিভারি ছিল। বলতে দ্বিধা নেই, যেহেতু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেটাই আমার তথা আমাদের প্রথম ম্যাচ, তাই তখন অত জোরে বল খেলার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। তারপরও মনে আছে, আমি অন্তত প্রথম বলটি আমার ব্যাট ফাঁকি দিতে পারেনি। ব্যাটে খেলে ফেলেছিলাম সেই ডেলিভারি।
ইতিহাস জানায়, দেশের হয়ে প্রথম ওয়ানডেতে রানের খাতা খোলা হয়নি নোবেলের। পাকিস্তানের তখনকার অধিনায়ক ও বিশ্বের সব সময়ের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার ইমরান খানের প্রচণ্ড গতি আর দারুণ সুইংয়ে পরাস্ত হয়ে রানে উইকেটের পিছনে কিপার জুলকারনাইনের গ্লাভসে ক্যাচ দিয়ে ফেরত এসেছিলেন নোবেল।
অনেক মেধাবী, প্রতিভাবান ক্রিকেটারই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। নোবেলকেও সেই দলে ফেলা যায়। ওয়ানডেতে পরিসংখ্যান জীর্ণশীর্ণ হলেও ব্যাটসম্যান নোবেল কিন্তু হেলাফেলার পাত্র নন। উইলোবাজ নোবেল একজন স্টাইলিশ উইলোবাজের প্রতিমূর্তি।
দ্রুতগতি আর আর স্পিন- দুই বোলিংয়ের বিপক্ষে সমান স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীল ছিল তার ব্যাট। উইকেটের সামনে ও দু’দিকে শটস খেলায় ছিলেন দারুণ পারদর্শী ও দক্ষ। গালি-পয়েন্ট আর থার্ডম্যানের আশপাশ দিয়ে ফ্ল্যাশ, কভার ড্রাইভ আর হাঁটু মুড়ে স্লগ সুইপ খেলতে পারতেন খুব ভালো। সাহসী আর ফ্রি স্ট্রোক প্লে’তে সিদ্ধহস্ত নোবেল ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে ড্যাশিং ওপেনার হিসেবেই ছিলেন সমাদৃত।
সূর্যতরুণের হয়ে দু’বছর খেলার পর ১৯৮৬-১৯৮৭ মৌসুমে ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় ক্লাব ঢাকা মোহামেডানে নাম লেখান নোবেল। মোহামেডান তখন তারার মেলা। নোবেল, শান্টু, রকিবুল, নান্নু, শহিদ, মাসুম, প্রিন্স, ওয়াহিদুল গনির মতো তারকারা খেলেন।
একটানা পাঁচ থেকে ছয় মৌসুম মোহামেডানে খেলার পর যোগ দেন ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের আরেক বড় দল ব্রাদার্স ইউনিয়নে। ব্রাদার্সের অধিনায়কত্বও করেন নোবেল। ব্রাদার্সে কয়েক বছর খেলার পর আবার ফিরে আসেন মোহামেডানে।
১৯৯৯-২০০০, বছর দুয়েক খেলার পর চলে যান আবার সূর্যতরুণে। দেড়যুগ পর সেখান থেকে আবার ‘ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন’- সেই লালমাটিয়ায় চলে আসেন নোবেল এবং সেই দলের হয়েই ২০০০ সালে শেষবারের মতো ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে অংশ নেন।
খেলা ছেড়ে নোবেল জড়িয়ে পড়েন কোচিংয়ে। ক্লাব ক্রিকেটের পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়েও কোচিং করান নোবেল। জাতীয় দলের এ সাবেক ওপেনার সময়ের প্রবাহমানতায় বিসিবি তালিকাভুক্ত কোচ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এখন তিনি চট্টগ্রাম বিভাগের হেড কোচ। তার হাত ধরে উঠে এসেছে বেশকিছু প্রতিভা। যুব বিশ্বকাপ জয়ী দলের অন্যতম সদস্য পারভেজ ইমন ও দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় উইলোবাজ ইয়াসির আলী রাব্বিও নোবেলের ছাত্র।
একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তেমন সুবিধা (৪ ম্যাচে ১৫ রান, সর্বোচ্চ ১৪) করতে না পারলেও আইসিসি ট্রফি, জাতীয় দলের হয়ে দেশ ও দেশের বাইরে বেশকিছু ভালো ইনিংস আছে নুরুল আবেদিন নোবেলের। নামি ব্যাটসম্যান ইউসুফ রহমান বাবু’র পর নোবেলই আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেঞ্চুরিয়ান।
১৯৯০ সালে হল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে কানাডার বিপক্ষে দারুণ সেঞ্চুরি আছে তার। এছাড়া ১৯৮৬-১৯৮৭ মৌসুমে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে পাকিস্তান সফরে হায়দরাবাদের বিপক্ষে বিগ হান্ড্রেড হাঁকিয়েছিলেন নোবেল।
জাতীয় দলের হয়ে ওই দুই সেঞ্চুরির বাইরে ঘরোয়া ক্রিকেটে নোবেলে ১৫-১৬ টি শতক আছে। যার ১২ থেকে ১৪টি ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে। সূর্যতরুণ, মোহামেডান আর ব্রাদার্স- তিন দলের পাশাপাশি জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ আর জাতীয় লিগে যথাক্রমে চট্টগ্রাম জেলা ও বিভাগের পক্ষে শতরানের রেকর্ড আছে তার।
এর মধ্যে ৭৫ ওভারের লিগে সূর্যতরুণের হয়ে ক্রীড়াকেন্দ্র বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে মোহামেডানের বিপক্ষে ১৬০ রানের বিগ হান্ড্রেডটি এখনো স্মরণীয় নোবেলের। ওই ম্যাচে মোহামেডানের অধিনায়ক ও তার ছোট ভাই মিনহাজুল আবেদিন নান্নুও সেঞ্চুরি করেছিলেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পিতা শামসুল আবেদিন যখন পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে শহীদ হন নোবেল তখন ৭ বছরের শিশু। ছোট ভাই নান্নুর তার এক বছরের ছোট। ব্যক্তি জীবনে দুই কন্যা সন্তানের জনক নোবেল এখন চট্টগ্রামেই থাকেন।
বড় মেয়ে নটিংহ্যাম ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। ছোট মেয়ে নিজ শহর চট্টগ্রামে ‘এ’ লেভেলে অধ্যায়নরত।
এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম