একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচারকাজ চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
Advertisement
২০১০ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস) ট্রাইব্যুনাল (অভ্যন্তরীণ আদালত) গঠন করা হয়। এর চেয়ারম্যান হন বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। তিন সদস্যের এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি আমির হোসেন ও বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার।
ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর বিচার চললেও ২০১৩ সাল থেকে রায় ঘোষণার কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর থেকে পর্যায়ক্রমে মোট ৪২টি মামলার রায় আসে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরও ৩৫টি মামলা বিচারাধীন। ইতোমধ্যে ৭৮টি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে।
Advertisement
এদিকে ৯টি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা হয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। আরও দুটি মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
ট্রাইব্যুনালের এক দশক পূর্ণ ২৫ মার্চ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার এক দশক পূর্ণ হচ্ছে আগামী ২৫ মার্চ। এই ১০ বছরে ট্রাইব্যুনাল থেকে মোট ৪২টি মামলার রায় এসেছে।
এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ১০৪ জন। যার মধ্যে ৭০ জনেরই মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয়। বাকিদের যাবজ্জীবন ও আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়া গত ১০ বছরে মারা যান ২০ সাজাপ্রাপ্ত আসামি।
Advertisement
রায়হীন এক বছর
মহামারি শুরুর আগে ট্রাইব্যুনালের এক বিচারক অসুস্থতাজনিত কারণে চিকিৎসার জন্য ছুটিতে বিদেশ ছিলেন। তিনি এখন দেশে এসেছেন। মহামারি এবং বিচারক না থাকায় গত বছর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলার রায় দিতে পারেননি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
প্রসিকিউটর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে গড়ে প্রতি বছর ছয়টি রায় এসেছে। ২০২০ সালে এসে কোনো মামলায় রায় দেয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সারা বিশ্বে একই সমস্যা। মহামারির সময় ট্রাইব্যুনালের বিচারে গতি ছিল ধীর। এখন আবার গতি ফিরে আসছে। মোটামুটি নিয়মিত মামলায় আসামি আসছে, সাক্ষী হচ্ছে। এছাড়া জাজমেন্টও হলো একটা। যে সব মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে এগুলো চলবে। নতুন মামলা এলে সেসব বিষয়ে শুনানি হবে। মূলত এক কথায় ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম আবারও আগের মতোই চলবে।’
ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্ত জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে মামলার স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটেছিল। একটি রায় ঘোষণার জন্য থাকলেও সেটি দিতে পারেননি ট্রাইব্যুনাল। কারণ ট্রাইব্যুনালের বেশ কয়েকজন প্রসিকিউটর ও তাদের পরিবারের সদস্য কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিলেন। ট্রাইব্যুনালের বহু কর্মীও আক্রান্ত হয়েছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সম্প্রতি ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের এক মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে যাচ্ছে।’
জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্ত জাগো নিউজকে আরও বলেন, ‘গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত করোনা পরিস্থিতির কারণে যেমন এজলাস বসেনি, তেমনি প্রসিকিউটররা ও তদন্ত সংস্থা ধীরে ধীরে কাজ করেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আবার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বলা যেতে পারে অনেকটাই সচল হয়েছে। আশা করছি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আরও রায় হয়ে যেতে পরে।’
তিনি বলেন, ‘আব্দুল হান্নান, পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তাসহ আরও বেশকিছু মামলায় আর্গুমেন্ট (যুক্তিতর্ক) শেষ পর্যায়ে। এসব মামলায় রায় ঘোষণা করা হতে পারে।’
ট্রাইব্যুনালে মোট ৪২ রায়
২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি ফরিদপুরের বোয়ালমারীর আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে প্রথম মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ট্রাইব্যুনালের রায় দেয়া শুরু হয়।
এরপর একই বছরের ৪ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি, ৯ মে, ১৫ জুলাই, ১৭ জুলাই, ১ অক্টোবর, ৯ অক্টোবর ও ৩ নভেম্বর ৯টি মামলার রায় দেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর একই বছরের ২, ১৩, ২৪ নভেম্বর, ২৩ ও ৩১ ডিসেম্বর মোট ছয়টি মামলার রায় দেয়া হয়।
পরের বছর ২০১৫ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা আব্দুস সোবহানকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর একই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০ মে, ৯ জুন, ১৬ জুলাই, ১১ আগস্ট পর্যন্ত আরও ছয়টি মামলার রায় আসে।
২০১৬ সালে রায় দেয়া শুরু হয় ২ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনার দুই রাজাকারের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে। পরে একই বছরের ৩ মে, ১ জুন, ১৮ জুলাই, ১০ আগস্ট ও ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও ছয়টি মামলার রায় আসে।
এর পরের বছর ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল কিশোরগঞ্জের নিকলী থানার দুই রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ওই বছরের প্রথম রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর একই বছরের ২২ নভেম্বর দ্বিতীয় রায় হয়।
২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি মৌলভীবাজারের রাজনগরের পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে দণ্ড ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ১৩ মার্চ, ১০ মে, ১৭ জুলাই, ১৩ আগস্ট, ৫ নভেম্বর পর্যন্ত ছয় মামলার রায় আসে।
পরের বছর ২০১৯ সালে ছয়টি মামলার রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। এ বছরের ২৮ মার্চ, ২৪ এপ্রিল, ২৭ জুন, ২৭ আগস্ট, ১৫ অক্টোবর, ১১ ডিসেম্বর রায় দেয়া হয়। ২০২০ সালে এসে বৈশ্বিক মহামারির কারণে আর কোনো রায় ঘোষণা করা হয়নি।
সবশেষ ২০২১ সালে এসে ১১ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার তিনজনের যাবজ্জীবন, পাঁচজনের ২০ বছর করে কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আব্দুল লতিফ নামে একজনকে খালাস দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই প্রথম কেউ বেকসুর খালাস পান।
বিচারাধীন ৩৫টি মামলা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩৬টি মামলা বিচারাধীন। এসব মামলার বেশকিছু বিচারের গুরুত্বপূর্ণ স্তরে আটকে রয়েছে বলে প্রসিকিউটররা জানিয়েছেন। সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে কক্সবাজারের মহেশখালীর সালামত উল্লাহ খানসহ ২১ আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা।
এছাড়া ময়মনসিংহের এম এ হান্নানসহ আট আসামি, একই জেলার মো. রেজাউল করিম ওরফে এ এস এম রেজাউল হক ওরফে আক্কাস মৌলভীসহ আট আসামির মামলাটিও সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
নড়াইলের আবদুল ওয়াহাবসহ ১২ আসামির বিরুদ্ধে মামলা, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ ও কচুয়ার খান আশরাফ আলীসহ ১৪ আসামির মামলা, শেরপুরের নকলার এস এম আমিনুজ্জামান ফারুকসহ চার আসামির বিরুদ্ধে করা মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
এছাড়া কুমিল্লার দাউদকান্দির মোহাম্মদ শহিদুল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা, নেত্রকোনার মো. খলিলুর রহমানসহ পাঁচ আসামির মামলা, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার আব্দুস সালামসহ ৯ আসামির বিরুদ্ধে মামলা, মৌলভীবাজারের বড়লেখার আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুলসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মামলা, যশোরের মনিরামপুরের সিদ্দিকুর রহমান গাজীসহ চার আসামির বিরুদ্ধে মামলা, ময়মনসিংহের ত্রিশালের আনিসুর রহমান মানিকসহ ৯ আসামির বিরুদ্ধে মামলা, নওগাঁর বদলগাছির রেজাউল করিম মন্টুসহ চার আসামির বিরুদ্ধে মামলা, খুলনার আমজাদ হোসেন হাওলাদারসহ আট আসামির বিরুদ্ধে মামলার বিচার চলছে ট্রাইব্যুনালে।
অন্যদিকে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ এলাকার আবুল খায়ের গোলাপ ওরফে গোলাপ মিয়াসহ দুই আসামির মামলা, খুলনার ডুমুরিয়ার শেখ আব্দুর রহিমসহ ১১ আসামির মামলা, যশোরের আজমত হোসাইন মোল্লাসহ পাঁচ আসামির মামলা, বগুড়ার বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল মোমিন তালুকদারের বিরুদ্ধে মামলা, সাতক্ষীরার জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল খালেক মণ্ডলসহ চার আসামির বিরুদ্ধে মামলার বিচারও চলছে।
এছাড়া হবিগঞ্জের লাখাইয়ের সাফিউদ্দিন মাওলানার বিরুদ্ধে মামলা, মাদারীপুরের মোহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের বিরুদ্ধে মামলা, পিরোজপুরের বন্দরবাড়ির আব্দুল মান্নান হাওলাদারসহ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে মামলা, হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের মধু মিয়া তালুকদার ওরফে মধু মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা, ময়মনসিংহের কিতাব আলী ফকিরসহ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে মামলা, সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লার মুক্তি মনির ওরফে মুক্তি মিয়াসহ ১১ আসামির মামলা, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের মোফাজ্জল হক প্রধানসহ ৯ আসামির মামলার বিচারকাজ চলমান।
ময়মনসিংহের ফুলপুরের গিয়াস উদ্দিন খানসহ ১৫ আসামির মামলা, ফেনী সদরের মোফাজ্জল হোসাইন ওরফে তাজুসহ তিন আসামির মামলা, ঠাকুরগাঁওয়ের আবেদ হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা, নীলফামারীর একরামুল হকসহ ছয় আসামির মামলা, ঝিনাইদহের আব্দুর রশিদসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মামলা, গোপালগঞ্জের নিজামুল হক মিয়া ওরফে লুৎফর রহমান ওরফে লুতু মোল্লাসহ চার আসামির বিরুদ্ধে মামলার বিচার চলছে ট্রাইব্যুনালে।
এছাড়া সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের আকবর আলী শেখের বিরুদ্ধে মামলা, বরগুনার আব্দুল মান্নান হাওলাদারসহ পাঁচ আসামি বিরুদ্ধে মামলা এবং কুড়িগ্রামের নজরুল ইসলামসহ ১৩ আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার চলছে।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে পর্যায়ক্রমে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার মোবারক হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আফসার হোসেন চুটু ও মাহিদুর রহমান, পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিক, বাগেরহাটের সিরাজুল হক ও খান আকরাম হোসেন, নেত্রকোনার আতাউর রহমান ননী ও ওবায়দুল হক খান তাহের, কিশোরগঞ্জের শামসুদ্দিন আহমেদ, হবিগঞ্জের মহিবুর রহমান বড় মিয়া, মুজিবুর রহমান আঙ্গুর মিয়া ও আবদুর রাজ্জাক, জামালপুরের সামসুল হক ওরফে বদর ভাই ও এসএম ইউসুফ আলী এবং যশোরের সাবেক এমপি জামায়াত নেতা সাখাওয়াত হোসেন ও বিল্লাল হোসেন, নোয়াখালীর সুধারামের আমীর আলী ও জয়নাল আবেদীন, মৌলভীবাজারের উজের আহমেদ ও ইউনুছ আহমেদ, ফুলবাড়িয়ার রিয়াজউদ্দিন ফকিরসহ আরও অনেকের আপিল।
ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সরকার। এরপর ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ট্রাইব্যুনাল-২ নামে দুটি ট্রাইব্যুনালে বিচার চলে। ২০১৫ সালে ট্রাইব্যুনাল-২ নিষ্ক্রিয় করে ট্রাইব্যুনাল-১ বিচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
এফএইচ/জেডএইচ/এসএইচএস/জেআইএম