হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমার কাছে আবু সুফিয়ান ইবনে হারব রাদিয়াল্লাহু আনহু হিরাকলের হাদিসে বর্ণনা করেছেন। তাতে তিনি এ কথাও বলেছেন যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নামাজ, সত্যবাদিতা ও চারিত্রিক পবিত্রতার নির্দেশ দিয়েছেন।
Advertisement
কুরআনে বর্ণিত ইসরার ঘটনা তথা মেরাজে কীভাবে নামাজ ফরজ হলো?- এ সম্পর্কিত হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ বুখারিতে দীর্ঘ একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তাহলো-
হজরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আবু জার রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘আমি মক্কায় থাকা অবস্থায় আমার ঘরের ছাদ উন্মুক্ত করা হল। অতঃপর জিবরিল (আলাইহিস সালাম) এসে আমার সিনা (বুক) বিদীর্ণ করলেন। আর তা জমজমের পানি দ্বারা ধুয়ে দিলেন।
অতঃপর হিকমাত ও ঈমানে ভর্তি একটি সোনার পাত্র নিয়ে আসলেন এবং তা আমার বুকের মধ্যে ঢেলে দিয়ে বন্ধ করে দিলেন। অতঃপর আমাকে হাত ধরে দুনিয়ার আকাশের দিকে নিয়ে চললেন।
Advertisement
পরে যখন দুনিয়ার আকাশে আসলাম- জিবরিল (আলাইহিস সালাম) আকাশের রক্ষককে বললেন- দরজা খোল। আকাশের রক্ষক বললেন- কে আপনি?
জিবরিল (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি জিবরিল। (আকাশের রক্ষক) বললেন, আপনার সঙ্গে কেউ রয়েছেন কি?
জিবরিল বললেন, ‘হ্যাঁ’, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রয়েছেন। অতঃপর রক্ষক বললেন, তাকে কি ডাকা হয়েছে? জিবরিল বললেন, ‘হ্যাঁ’। অতঃপর যখন আমাদের জন্য দুনিয়ার আকাশ খুলে দেয়া হল আর আমরা দুনিয়ার আকাশে প্রবেশ করলাম তখন দেখি সেখানে এমন এক ব্যক্তি উপবিষ্ট রয়েছেন যার ডান পাশে অনেকগুলো মানুষের আকৃতি রয়েছে আর বাম পাশে রয়েছে অনেকগুলো মানুষের আকৃতি। যখন তিনি ডান দিকে তাকাচ্ছেন হেসে উঠছেন আর যখন বাম দিকে তাকাচ্ছেন কাঁদছেন।
অতঃপর তিনি বললেন, স্বাগতম ওহে সৎ নবী ও সৎ সন্তান!
Advertisement
আমি (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিবরিলকে বললাম, কে এই ব্যক্তি?
তিনি জবাব দিলেন, ইনি হচ্ছেন আদম (আলাইহিস সালাম)। আর তাঁর ডানে বামে রয়েছে তাঁর সন্তানদের রূহ। তার মধ্যে ডান দিকের লোকেরা জান্নাতি আর বাম দিকের লোকেরা জাহান্নামি। ফলে তিনি যখন ডান দিকে তাকান তখন হাসেন আর যখন বাম দিকে তাকান তখন কাঁদেন।
অতঃপর জিবরিল (আলাইহিস সালাম) আমাকে নিয়ে দ্বিতীয় আকাশে উঠলেন। অতঃপর তার রক্ষককে বললেন, দরজা খোল। তখন এর রক্ষক প্রথম রক্ষকের মতই প্রশ্ন করলেন। পরে দরজা খুলে দেয়া হল।
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আবু জার রাদিয়াল্লাহু আনহু উল্লেখ করেন যে, তিনি (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সব আকাশে আদম, ইদরিস, মুসা, ঈসা এবং ইবরাহিমকে (আলাইহিমুস সালাম) পান। কিন্তু আবু জার রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের (অবস্থানের) স্থানসমূহ নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেননি। তবে এতটুকু উল্লেখ করেছেন যে, তিনি আদমকে (আলাইহিস সালাম) দুনিয়ার আকাশে এবং ইবরাহিমকে (আলাইহিস সালাম) ষষ্ঠ আকাশে পান।
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, জিবরিল (আলাইহিস সালাম) যখন রাসুলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়ে ইদরিসের (আলাইহিস সালাম) কাছ দিয়ে অতিক্রম করেন তখন ইদরিস (আলাইহিস সালাম) বললেন, ‘মারহাবা! ওহে সৎ ভাই ও পুণ্যবান নবি।
আমি (রাসুলুল্লাহ) বললাম- ইনি কে?
জিবরিল বললেন, ইনি হচ্ছেন ইদরিস (আলাইহিস সালাম)।
অতঃপর আমি মুসাকে (আলাইহিস সালাম) অতিক্রম করার সময় তিনি বললেন, মারহাবা! হে সৎ নবি ও পুণ্যবান ভাই।
আমি বললাম- ইনি কে?
জিবরিল বললেন, ইনি মুসা (আলাইহিস সালাম)।
অতঃপর আমি ঈসাকে (আলাইহিস সালাম) অতিক্রম করার সময় তিনি বললেন, মারহাবা হে সৎ নবী ও পুণ্যবান ভাই।
আমি বললাম- ইনি কে?
জিবরিল বললেন, ইনি হচ্ছেন ঈসা (আলাইহিস সালাম)।
অতঃপর আমি ইবরাহিমকে (আলাইহিস সালাম) অতিক্রম করার সময় তিনি বললেন, মারহাবা! হে পুণ্যবান নবি ও নেক সন্তান।
আমি বললাম- ইনি কে?
জিবরিল (আলাইহিস সালাম) বললেন, ইনি হচ্ছেন ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম)।
ইবনু শিহাব বলেন, ইবনু হাযম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, ইব্নু আব্বাস ও আবু হাব্বা আল-আনসারি উভয়ে বলতেন- নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
‘অতঃপর আমাকে আরও উপরে উঠানো হল। তারপর এমন এক সমতল স্থানে এসে আমি উপনীত হই যেখানে আমি লেখার শব্দ শুনতে পাই।’
ইবনু হাযম ও আনাস ইব্নু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
‘অতঃপর আল্লাহ আমার উম্মাতের উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত (নামাজ) ফরজ করে দেন। অতঃপর তা নিয়ে আমি ফিরে আসি। অবশেষে যখন মুসাকে (আলাইহিস সালাম) অতিক্রম করি; তখন তিনি বললেন- আল্লাহ তাআলা আপনার উম্মাতের উপর কি ফরজ করেছেন?
আমি বললাম- পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত (নামাজ) ফরয করেছেন।
তিনি বললেন- আপনি আপনার পালনকর্তার কাছে ফিরে যান; কেননা আপনার উম্মাত তা পালন করতে পারবে না। আমি ফিরে গেলাম। আল্লাহ তাআলা কিছু অংশ কমিয়ে দিলেন।
আমি মুসাকে (আলাইহিস সালাম) পুনরায় অতিক্রম করাকালে তিনি আবার জানতে চাইলেন, আর আমি বললাম- কিছু অংশ কমিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বললেন- আপনি পুনরায় আপনার রবের কাছে ফিরে যান। কারণ আপনার উম্মাত এটিও আদায় করতে পারবে না। আমি ফিরে গেলাম। তখন আরো কিছু অংশ কমিয়ে দেয়া হল।
আবারও মুসাকে (আলাইহিস সালাম) অতিক্রম করাকালে তিনি আবার জানতে চাইলেন, আর বললাম- কিছু অংশ কমিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বললেন- আপনি পুনরায় আপনার প্রতিপালকের কাছে যান। কারণ আপনার উম্মত এটিও আদায় করতে সক্ষম হবে না। তখন আমি পুনরায় গেলাম, তখন আল্লাহ বললেন-
এই পাঁচই (নেকির দিক দিয়ে) পঞ্চাশ (বলে গণ্য হবে)। আমার কথার কোন রদবদল হয় না।’
আমি পুনরায় মুসাকে (আলাইহিস সালাম) অতিক্রম করার সময় তিনি আবারও আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন এবং প্রভুর কাছে ফিরে যেতে বললেন।
আমি বললাম- পুনরায় আমার প্রতিপালকের কাছে যেতে আমি লজ্জাবোধ করছি।
অতঃপর জিবরিল (আলাইহিস সালাম) আমাকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। আর তখন তা বিভিন্ন রঙে আবৃত ছিল, যার তাৎপর্য আমি অবগত ছিলাম না। অতঃপর আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হলে আমি দেখতে পেলাম যে, তাতে রয়েছে মুক্তোমালা আর তার মাটি হচ্ছে কস্তুরী।’ (বুখারি, মুসলিম, মুসনাদে আহামদ)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উর্ধ্ব জগতের সেই সফরে আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মতের জন্য উপহার স্বরূপ পেয়েছেন ৫ ওয়াক্ত নামাজ। যা প্রতিদিন আদায় করা মুমিন মুসলমানের জন্য আবশ্যক। মেরাজের প্রস্তুতি ও প্রাপ্তি নিয়ে এভাবে বিশদ বর্ণনা হাদিসের বর্ণনায় এভাবেই ওঠে এসেছে।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, ফরজ হওয়া ৫ ওয়াক্ত নামাজ যথাযথভাবে আদায় করা। ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার মাধ্যমেই ৫০ ওয়াক্ত নামাজের সাওয়াব পাওয়ার আমল অব্যাহত রাখা।
আল্লাহ তাআলা উম্মাতে মুহাম্মাদিকে হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। যথাসময়ে ফরজ হওয়া নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম