শিক্ষা

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে কুরআন শিক্ষা দিচ্ছে কামরাঙ্গীরচরের মাদরাসা

ঢাকার কামরাঙ্গীচরের লোহার ব্রিজ পার হয়ে কিছুদূর এগোতেই চোখে পড়বে তিনতলা একটি ভবন। ভবনের সামনেই বড় ব্যানারে ‘দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদরাসা’ লেখা থাকায় চিনতে অসুবিধা হয় না নন্দিত প্রতিষ্ঠানটি।

Advertisement

ভবনের নিচতলায় একটি খাবার হোটেলের দোকান। দোকানের পাশেই ভবনে ঢোকার ফটক। এই ফটকের কাছেও ছোট দুটি ব্যানারে মাদরাসার পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই জানা গেল, ভবনটির তিনতলায় এ মাদরাসার কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

তিনতলায় উঠতেই মাদরাসার নাম লেখা বড় ব্যানার, তার সঙ্গে দরজা। ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইতেই মাদরাসার সহকারী প্রধান শিক্ষক মাওলানা মাহমুদ আল হাসান দরজায় চলে এলেন। মাদরাসা কক্ষে ঢুকে দেখা গেল সাজানো-গোছানো পড়ার ব্যবস্থা। সামনে বড় হোয়াইট বোর্ড। কক্ষের এক কোনায় রয়েছে ইসলামী বইয়ের বড় দুটি শেল্ফ, যেখানে শত শত ধর্মীয় বই রয়েছে। এর পাশেই শতাধিক রেহেলও (বই রাখার জন্য) রয়েছে। সেই কক্ষে প্রবেশের বাঁ পাশে রয়েছে অজুখানা ও ওয়াশরুম।

দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদরাসার পড়ার কক্ষ

Advertisement

দেশের তৃতীয় লিঙ্গ তথা হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য প্রথম গড়ে ওঠা এই মাদরাসার ব্যবস্থাপনা যে কাউকেই সন্তুষ্ট করবে। সেই তৃপ্তি দেখা যায় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের চোখেমুখেও।

সরকারের সমাজসেবা অধিদফতরের জরিপ বলছে, দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের হিসাবে এ সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি।

গত বছরের ৬ নভেম্বর মাদরাসাটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। তখন থেকেই মাদরাসাটির কার্যক্রম চলমান। চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি নতুন বর্ষের সবক প্রদান অনুষ্ঠান হয়। এ অনুষ্ঠানে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধিরা (টিম লিডার) উপস্থিত ছিলেন। আগামী ২৬ মার্চ এ মাদরাসা থেকে গত কয়েক মাসে তৃতীয় লিঙ্গের এই শিক্ষার্থীরা কী শিখলেন বা কেমন শিখছেন সে বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এই মাদরাসার কয়েকটি শাখা রয়েছে। প্রতিদিন ঢাকার এ মাদরাসাগুলোতে প্রায় ২০০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কুরআন শিক্ষা গ্রহণ করেন। ঢাকার মধ্যে জুরাইন, মতিঝিল, কমলাপুর, গোপীবাগ, মান্ডাসহ ১৪টি এলাকায় মাদরাসাটির কার্যক্রম চলছে। এছাড়া ঢাকার বাইরে সিলেট এবং ময়মনসিংহেও এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। খুলনা এবং গোপালগঞ্জেও প্রতিষ্ঠানটির শাখা চালুর চেষ্টা চলছে। এমনকি দেশের প্রতিটি জেলায় তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য মাদরাসা শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি।

Advertisement

গত ৮ জানুয়ারি মাদরাসার নতুন বর্ষের সবক প্রদান অনুষ্ঠান হয়

এই মাদরাসা মরহুম আহমেদ ফেরদৌস বারী চৌধুরী ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। এখানে কুরআন শিক্ষাগ্রহণের জন্য আসা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে কোনো অর্থ দিতে হয় না। মাদরাসার শিক্ষকদের ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকেই সম্মানী দেয়া হয়। এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে হাফেজ মাওলানা মুফতি আবদুর রহমান আজাদ দায়িত্ব পালন করছেন। কামরাঙ্গীরচরের এই মাদরাসায় এখন প্রতিদিন ২০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নিয়মিত কুরআন শিক্ষা নিচ্ছেন।

তাদের কীভাবে কুরআন শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করলেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষক মাহমুদ আল হাসান বলেন, শুরুতে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এরপর ঢাকার বিভিন্ন এলাকার তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধির সঙ্গে আমাদের কথা হয়। তাদের আমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে জানালে তারা আগ্রহী হন। প্রতিনিধিদের নিদের্শনায় তারা সুশৃঙ্খল থাকেন। এতে করে প্রতিনিধিদের মাধ্যমে আমরা তৃতীয় লিঙ্গের এই শিক্ষার্থীদের পেয়েছি। যিনি প্রতিনিধি থাকেন তিনিও আমাদের কুরআন শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়মিত আসেন।

শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে কথা বলছেন মাদরাসার শিক্ষক মাহমুদ আল হাসান

আল হাসান আরও বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের যে কেউ আমাদের মাদরাসায় আসতে পারেন। আমরা চাই, সারাদেশের এই গোষ্ঠীর মানুষ কুরআন শিক্ষা গ্রহণ করুক। ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহ ও সিলেটে আমাদের কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। আল্লাহর রহমতে সারাদেশেই আমাদের মাদরাসার কার্যক্রম পৌঁছে যাবে। পাশাপাশি তাদের আমরা কারিগরি শিক্ষাও দিতে চাই।

মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতি মুহাম্মাদ আবদুর রহমান আজাদের বরাত দিয়ে এই শিক্ষক আরও বলেন, তাদের (তৃতীয় লিঙ্গের) মধ্য থেকে আমাদের হাফেজ, মাওলানা, মুফতি, মুহাদ্দিস বের করার লক্ষ্য রয়েছে। এখন তো পড়ানোর মতো তাদের মধ্য থেকে কেউ নেই। যদি তাদের মধ্য থেকে কেউ শিক্ষক হন, তাহলে মাদরাসার শিক্ষাগ্রহণে তারা আরও আগ্রহী হবেন।

এওয়াইএইচ/এমআরআর/এইচএ/এএসএম