নিজের হাত নিজের গালে চড় বসিয়ে দিলে আপনি কাকে বিচার দিতে যাবেন? নিশ্চয়ই করার কিছু থাকবে না। নিশ্চুপ থাকতে হবে। বাংলাদেশের প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক লোকদের অবস্থাও তাই হয়েছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে পছন্দ না কিংবা সরকারের আমলানির্ভরতা এবং ব্যাংকখাতের দুর্নীতিতে হতাশ- তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এদেশের বামরা গণমুখী দল না হয়ে তত্ত্ব নিয়ে ভাঙনের পর ভাঙন দিয়ে দশকের পর দশক পার করে দিয়েছে।
Advertisement
বিএনপি-জামায়াত মার্কা দলে এসব লোকদের যাওয়া এবং গেলেও মানসিক সংঘাতে টিকে থাকা সম্ভব নয়। আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে, অসাম্প্রদায়িক এমন বড় কোনো রাজনৈতিক দল তাদের সামনে নেই যাকে দিয়ে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ দেবে। আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি-জামায়াত বা অন্য কোনো মৌলবাদী শক্তি কোনোকালেই হবে না। কারণ মুক্তিযুদ্ধকে এড়িয়ে বাংলাদেশে কোনো দলই ক্ষমতায় গিয়ে টিকে থাকতে পারবে না।
সঙ্কটে পড়া, ক্ষমতার স্বাদ নিতে আগ্রহী এমন প্রগতিশীল নেতাদের জন্য ২৮ বছর আগে আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছিল ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম। কিন্তু গণফোরাম নিয়ে চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন ড. কামাল। সিপিবির বড় একটা অংশ, আওয়ামী লীগের কাউন্ট করার মতো নেতাকর্মী, জাসদ-বাসদের কিছু নেতাকে তিনি দলে ভিড়িয়েছেন সত্য কিন্তু না পেরেছেন দলটিকে গণমুখী করতে, না পেরেছেন তাদের সবাইকে ধরে রাখতে। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, আবুল মাল আবদুল মুহিত, শাহজাহান সিরাজ, সাইফুদ্দিন মানিক, নুরুল ইসলাম নাহিদ, মতিউর রহমান, শেখ আবদুল আজিজ, মোস্তফা মোহসীন মন্টু, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, রেজা কিবরিয়াসহ অনেক নেতা তার ছায়াতলে এসে হতাশ হয়েছেন। অনেকে চলে গেছেন।
একটি দল করতে হলে দলের এবং দলের নেতাদের গণমুখী চরিত্র দরকার। সেটা না আছে ড. কামালের, না ছিল তার দলের। এই দল জনগণের দাবিতে রাজপথে তুমুল আন্দোলনে ছিল এমন একটা ঘটনা মানুষ স্মরণ করতে পারবে না। শুরুতেই ছাত্র সংগঠন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা। একটি দলের ছাত্র সংগঠন না থাকলে সেই দলের ভবিষ্যৎ নেতা কারা হবেন! ড. কামালরা কি চিরস্থায়ী নেতা? নাকি তারা আশা করেছিলেন নতুন নতুন নেতা আসবেন অন্য দল থেকে, যেভাবে গণফোরাম গঠিত হয়েছে?
Advertisement
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, ২৮ বছর আগে আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে ড. কামাল যেভাবে নতুন দল করেছেন ঠিক সেভাবে আজ তার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে। চ্যালেঞ্জের মুখে তার দল। গণফোরামের উদ্যোক্তাদের মধ্যে মোস্তফা মোহসীন মন্টু, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীসহ কয়েকজন ড. কামালকে বাদ দিয়ে আগামী মে মাসের শেষ সপ্তাহে গণফোরামের নতুন কমিটি ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন। সরাসরি বললে দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে ভাঙতে যাচ্ছে। গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়া দলীয় পদ ও সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। যারা আছেন তাদের জাতীয়ভাবে পরিচিতি। আবার পরিচিতরা একে একে তার সঙ্গ ত্যাগ করছেন।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিকল্প আরেকটি প্রগতিশীল দল গড়ে না ওঠা বা মুক্তিযুদ্ধের শক্তির বিকল্প হিসেবে মৌলবাদী দল সামনে চলে আসার ব্যর্থতার দায় ড. কামালের মতো নেতাদের নিতে হবে। ড. কামাল ব্যাখ্যাতীত, দুর্বোধ্য একটা চরিত্র। বরাবরই তিনি তাই ছিলেন। এমন চরিত্র দিয়ে রাজনীতি হয় না। দলের নাম দিয়েছেন গণফোরাম কিন্তু জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন সেমিনারনির্ভর দল বানিয়ে তিনি ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার আশা করছেন।
ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ করে বড় নেতা হয়েছেন সত্য কিন্তু আগেও এই জাতির জন্য স্মরণীয় কোনো ত্যাগ স্বীকার করেননি তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে (২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে) পাকিস্তানি সেনারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে ড. কামাল হোসেনকেও পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মিয়ানওয়ালি কারাগারে আর বলা হয় ড. কামাল হোসেন ছিলেন তার শ্বশুরবাড়িতে। অবশ্য এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন তিনি ছিলেন পৃথক আরেকটি জেলে। শুনেছি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কখনো যদি পাকিস্তানিরা কোনো আলোচনা করতে চায় তখন তার সাহায্য নেয়ার চিন্তা করেই ড. কামালকে তুলে নিয়েছিল তারা। ড. কামাল নিজেও কথাবার্তায় অনেকটা পাকিস্তানিদের মতো। অবশ্য ভাঙা ভাঙা বাংলা বললেও উর্দু আর ইংরেজি ভালো বলতে পারেন।
নিজের স্বার্থ ছাড়া জনস্বার্থে ড. কামাল রাস্তায় নেমেছেন এমন নজির হাতেগোনা বরং আইনজীবী পেশার দোহাই দিয়ে দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে বিদেশি তেল-গ্যাস কোম্পানির হয়ে লড়েছেন। তার উদ্দেশ্য মনে হয় জনগণের সরকার গঠন করার চেয়ে শেখ হাসিনার রাজনীতিকে শেষ করা। শেখ হাসিনার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে তার বিরুদ্ধে বহু বছর থেকে নেপথ্য নায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখছেন তিনি। এমনকি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সময়ও তার ভূমিকা স্বচ্ছ ছিল না। এই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য নিজ কন্যার জামাতা ডেভিড বার্গম্যান সারাবিশ্বে প্রোপাগান্ডা চালানোর সময়ও তিনি চুপ ছিলেন।
Advertisement
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতেন, ‘তিক্ত বড়িকে মিষ্টি আকারে গেলানোই রাজনৈতিক নৈপুণ্য’। দীর্ঘদিনব্যাপী সঙ্কটে থাকা, সুযোগ পেলেই সন্ত্রাসে লিপ্ত হওয়া বিএনপিকে তিনি গত সাধারণ নির্বাচনে হাজির করেছিলেন। অনেকে বলেন, জনগণের কাছে না গিয়ে, দলকে বিকশিত না করে ‘বুড়ো কাপালিক’ ড. কামাল হোসেন দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছিলেন কোনো সুযোগ আসে কিনা আওয়ামী লীগের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার। সেই সুযোগের সৎ ব্যবহারের জন্য সন্ন্যাসী সেজে তিনি এক বাজনা বাজালেন, ‘আমি জনগণকে রাষ্ট্রের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে এসেছি।’ কিন্তু জনগণ ঠিকই টের পেয়েছে যে জনগণকে রাষ্ট্রের মালিকানা বুঝিয়ে দেয়ার নামে তারেক রহমানের খাস তালুকের দখলদারিত্বের লাঠিয়ালগিরি করতে চেয়েছিলেন তিনি। তিনি জনগণের ক্ষমতা জনগণকে ফেরত দেয়ার নামে নিজেকে সাধু দাবি করে চোরের বাড়ি পাহারায় লিপ্ত হয়েছিলেন। শিয়ালের কাছে মুরগি পাহারা দেয়ার জন্য জনগণকে বিভ্রান্ত করে সফল হননি।
মানুষ পাল্টা প্রশ্ন তুলেছিল, ড. কামাল নির্বাচনও করছেন না, তিনি পার্লামেন্টেও থাকবেন না, তবে কেন তিনি বড় বড় কথা বলে মাঠে নামলেন? কেন তিনি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে হটাতে চান? তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর জন্য? নাকি তার রাজনৈতিক ভূমিকা আমেরিকার লবিস্ট ফার্মের মতো- টাকার বিনিময়ে সার্ভিস প্রদান করা। জামায়াতকে বৈধতা দেয়ার জন্য ঐক্যফ্রন্টের নেতারা যখন দেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী নেই এবং জামায়াত বলতে এখন আর কিছু নেই বলেছেন, তিনি তার নেতাদের এই নির্লজ্জ মিথ্যাচার, নিকৃষ্ট রাজনীতি দেখেও চুপ মেরে ছিলেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না বিএনপি একা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলে পলাতক অবস্থা থেকে তারেক রহমান বীরদর্পে দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী হতেন। নির্বাচনের আগে সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকের সময় এক সম্পাদক জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনারা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? তখন ড. কামাল বলেছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য যাকে নেতা নির্বাচিত করে তিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা তো তারেককে নেতা নির্বাচিত করবেন, ওনাকে নয়। ড. কামাল নিজে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় বিষয়টা তখন আরও সুস্পষ্ট, আরও সুনির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
পরিশেষে বলব, যেকোনো দলের ভাঙন আমার কাছে সুখের নয়। এই ভাঙনে জড়িত নেতারা পরে একে অন্যের মুখ দেখেন না। এমনকি মরণের পরও ফুল দিতে যান না, একটি শোকবার্তা দেন না- এমন নজিরও আমি দেখেছি। অথচ বছরের পর বছর তারা হাতে হাত মিলিয়ে রাজনীতি করেছেন। ড. কামাল একটি হতাশার নাম। এই হাতাশাকে শেষ করার জন্য মোস্তফা মোহসীন মন্টু, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদসহ যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আওয়ামী লীগের বিকল্প দল গড়তে চান- জানি না তারা কতটা সফল হবেন কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মজবুত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাইলে এমন সব রাজনৈতিক উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। anisalamgir@gmail.com
এইচআর/বিএ/এমকেএইচ