এটা খুবই উদ্বেগের বিষয় যে, এক বছর অতিক্রম করার পরও করোনা মহামারিকাল শেষ হচ্ছে না। বরং প্রতিদিনই প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। শনাক্তের সংখ্যাও বাড়ছে। এমনকি গ্রীষ্মে মৃত্যু ও সংক্রমণ দুটোই বাড়তে পারে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে আরও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ডেঙ্গু। মশাবাহিত রোগ হলেও ডেঙ্গুও প্রাণঘাতী। কয়েক বছর ধরে বেশ ভোগাচ্ছে ডেঙ্গু। করোনার মধ্যেই ডেঙ্গুর হানা ‘যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা।’ বলা যায় মারি ও মড়ক আমাদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। কোথাও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। করোনাপ্রতিরোধী ভ্যাকসিন এলেও লোকজনের মধ্যে আগ্রহ কম। গত ২৭ জানুয়ারি ভারতে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন কোভিশিল্ডের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পর ৭ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে গণটিকাদান শুরু করা হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে মাত্র ৩৬.৮ লাখ লোক টিকা দিয়েছেন। যদিও এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
Advertisement
দুই.ডেঙ্গুর সমস্যা নতুন নয়। প্রতি বছরই হানা দেয় ডেঙ্গু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্তরা নাক ও দাঁত দিয়ে এবং কাশির সময় রক্তক্ষরণে ভুগে থাকে। এছাড়া আক্রান্তরা পিঠ, দাঁত, মাথা ও চোখের পেছনে ব্যথা অনুভব করে। চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে আক্রান্তদের অবস্থার উন্নতি না হলে তাদের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসকদের কাছে যাওয়ার আগে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ খাওয়ার দরকার নেই। চিকিৎসকরা এক্ষেত্রে সচেতনতার কথাও বলেন। বিশেষ করে রোগীকে বেশি মাত্রায় পানি কিংবা শরবত খাওয়ানো যেতে পারে। এডিস মশার হাত থেকে বাঁচার জন্য দিনের বেলায়ও ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা উচিত।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মতো ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় অনেকটা নিজের হাতেই। বাসায় খোলা পাত্রে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। এছাড়া ফুলের টবে জমে থাকা পানি, টায়ারের খোল, ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দা অথবা পানির চৌবাচ্চায় এ মশা নির্বিচারে বংশ বিস্তার করে। এসব জায়গায় যেন পানি জমতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে বাসাবাড়িতে এডিশ মশা যেন আবাস গড়তে না পারে সেজন্য থাকতে হবে সতর্ক।
রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। প্রাথমিক অবস্থায় ১০২ ডিগ্রি ও এর চেয়ে বেশি জ্বর, সঙ্গে তীব্র মাথা ও শরীর ব্যথা, বিশেষ করে হাড়ে, তীব্র পেট ব্যথা, স্কিন র্যাশ ইত্যাদির সঙ্গে বমিভাব ও ক্ষুদামন্দা থাকলে তার ডেঙ্গু হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। এ অবস্থায় অনেকে আতঙ্কিত হয়ে এন্টিবায়োটিকসহ নানা ধরনের ওষুধ খেয়ে থাকেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, প্রাথমিক অবস্থায় জ্বর প্রশমনে কেবল প্যারাসিটামল এবং প্রচুর পানি খেলেই চলে। অবস্থার অবনতি হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। বিশেষ করে বয়োবৃদ্ধ ও শিশুদের ক্ষেত্রে। চিকিৎসকরা এমনটিই বলছেন।
Advertisement
বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের প্রধান হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত এক দশকে প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে বলা হয়েছে। বিশ্ব জনসংখ্যার ৫ ভাগের ২ ভাগই অর্থাৎ ২৫০ কোটি লোক ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। এর ৭০ ভাগই এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে বাস করে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা হু সতর্ক করে দিয়েছে, এখনই সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এ ব্যাপারে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
তিন.
মারি ও মড়ক থেকে বাঁচতে হলে নিজেদেরই সচেতন হতে হবে। করোনা মহামারিতে প্রাণহানি বাড়ছে। গতকাল বুধবার দেয়া তথ্যমতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজন পুরুষ এবং তিনজন নারী। মৃতরা সবাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এনিয়ে দেশে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৮ হাজার ৪৯৬ জনে। এ সময় নতুন করে শনাক্ত হয়েছে এক হাজার ১৮ জন। মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৫৩ হাজার ১০৫ জন। এর আগে মঙ্গলবার (৯ মার্চ) ২৪ ঘণ্টায় মারা যান ১৩ জন। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত ও ১৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যু হয়। এ পর্যন্ত মৃতদের মধ্যে পুরুষ ৬ হাজার ৪২৪ (৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ) ও নারী দুই হাজার ৭২ জন (২৪ শূন্য ৩৯ শতাংশ)।
চার.আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে নতুন করে আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়ছেই। বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, এই গ্রীষ্মে ফের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে পারে। করোনা সংক্রমণ রোধে তিনটি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত মঙ্গলবার (৯ মার্চ) ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকে তিনি এসব নির্দেশনা দেন। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম প্রেস ব্রিফিংয়ে নির্দেশনার কথা জানান। মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সভাপতিত্ব করেন। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী ও সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মন্ত্রীরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠকে যোগ দেন।
Advertisement
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী অনুরোধ করেছেন...আমি সব জায়গায় বলছি আমরা খুব কমফোর্ট জোনে আছি এটা যেন চিন্তা না করি। হ্যাঁ, আমরা অনেক দেশ থেকে ভালো অবস্থায় আছি, কিন্তু এটা সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দেয় না যে আমরা একেবারে কমফোর্ট জোনে আছি।’
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘আমরা যে যেখানে থাকি, ভ্যাকসিন নিই বা না নিই, আমরা যেন অবশ্যই তিনটি জিনিস মেনে চলি। আমরা যেন অবশ্যই বাইরে মাস্ক ব্যবহার করি। যথাসম্ভব যাতে আমরা সতর্কতা অবলম্বন করি। তিন নম্বর হলো- পাবলিক গ্যাদারিং যেখানে হচ্ছে বিশেষ করে কক্সবাজার বা হিলট্র্যাকসে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় গ্যাদারিং হচ্ছে, সেখানে যেন একটা লিমিটেড সংখ্যায় থাকি। নিজেদের যেন একটা দায়িত্ববোধ থাকে, যেখানে বেশি সংখ্যক লোক আছে সেখানে যেন আমি না যাই। যারা যাবেন তারা যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি।’
খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে এত বেশি লোক হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, কেউ মাস্ক পরছে না। গত বছর মাস্ক না পরার জন্য মিয়ামি বিচে পুলিশ পিটুনি দিয়েছে, জলকামান ব্যবহার করেছে। সেজন্য আমরা প্রত্যেকে যেন একটা দায়িত্ব পালন করি, পাবলিক গ্যাদারিংয়ে আমি যেন অবস্থা বুঝে অংশ নিই।’তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে আমাদের বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করছেন, আমরা যেন খুব কমফোর্ট ফিল না করি, গত বছর আমাদের সংক্রমণ সর্বোচ্চ হয়েছিল গ্রীষ্মকালে। এটা নিশ্চিত নয় যে এটা এবার উঠবে না।’
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘আমরা মনে করেছিলাম শীতকালে বোধহয় পিকে (সর্বোচ্চ সংক্রমণ) চলে যাবে, কিন্তু আমাদের পিক ছিল হাই সামার। এপ্রিল, মে ও জুন আমাদের হাই সামার হবে। বিশেষজ্ঞরা যেটা বলেছেন সে বিষয়ে আমাদের সবাইকে দৃষ্টি দিতে বলা হয়েছে, যেন আমরা যারা যার জায়গা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তি বা দলীয় বা পারিবারিক লেভেল থেকে আমরা যাতে সতর্ক থাকি।’ (সূত্র : জাগো নিউজ ৯ মার্চ ২০২১)
পাঁচ.দুঃখজনক হচ্ছে, মৃত্যু এবং শনাক্তের সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না সচেতনতা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বালাই নেই। মাস্ক পরতেও অনীহা। বিশেষ করে শপিংমল, গণপরিবহন এবং জনবহুল স্থানে মাস্ক পরাটা অত্যন্ত জরুরি হলেও অনেকেই তা মানছেন না। এ অবস্থায় ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ স্লোগান জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। লোকজনকে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে প্রয়োজনে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের জন্য কম মাশুল দিতে হচ্ছে না। ব্যাপক প্রাণহানি তো আছেই বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব স্থবির। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য চাকরি- সবক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এখনো স্বাভাবিক হয়নি সবকিছু। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে অনেক দিন ধরে। এইচএসরি মতো গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি। অটোপাস দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায়ও অনেকটা অনিশ্চিত। বলা যায় শিক্ষাক্ষেত্রে হয়ে গেছে এক অপূরণীয় ক্ষতি। আগামী ৩০ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে। কিন্তু সবকিছু কবে স্বাভাবিক হবে কেউ বলতে পারছেন না। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে উদাসীনতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
অন্যদিকে প্রাণঘাতী ডেঙ্গুও মহা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে বাঁচতে হলে মশক নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে আরও সক্রিয় হতে হবে, যাতে এডিস মশার সংখ্যা বৃদ্ধি না পায়। এ লক্ষ্যে সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। মানুষজনকে সচেতন করে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। করোনা মহামারি এবং ডেঙ্গু- দুই ক্ষেত্রেই কথাটি প্রযোজ্য।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। harun_press@yahoo.com
এইচআর/ফারুক/এমকেএইচ