যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করায় সরকারের অধিকাংশ প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে বেড়েই চলছে প্রকল্পের ব্যয়ও। ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ, একাধিক প্রকল্পের দায়িত্বে একজন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) থাকা।
Advertisement
এর অবসান ঘটিয়ে একটি প্রকল্পের জন্য একজন পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করতে গত ২০ জানুয়ারি একটি অফিস আদেশ জারি করেছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সেই আদেশ বাস্তবায়নের জন্য এ সংক্রান্ত নথি সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। তাদের সময় দেয়া হয়েছিল এক মাস।
প্রত্যেক প্রকল্পে একজন পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে তা অবহিত করার জন্য সচিব ও সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছিল। ২২ ফেব্রুয়ারি সেই নির্ধারিত সময় শেষ হয়েছে। কিন্তু এক প্রকল্পে একজন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে পারেনি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি অর্থবছর বরিশাল বিভাগে ১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ)। ১৪টির মধ্যে ছয়টি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সওজের বরিশাল জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবু হেনা মো. তারেক ইকবাল।
Advertisement
গত ৩ মার্চ (বুধবার) জাগো নিউজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে মো. তারেক ইকবাল ছয় প্রকল্পের দায়িত্বে থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি তো পিডি হই নাই। আমি তো পিডি হতে চাইও না। আমি কেন ছয় প্রকল্পের পিডি, যারা আমাকে বানিয়েছেন তারা বলতে পারবেন।’
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশনা সম্পর্কে অবহিত আছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাকে ছয়টা প্রকল্পের দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে। যারা আমাকে পিডি নিয়োগ করেছেন, এটা তার জন্য নির্দেশনা। এটা আমার জন্য নয়। পিডি তো আমি নিজে হতে পারি না।’
সওজ বরিশাল জোনের এই অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর প্রশ্ন, ‘এখানে আমি ছয়টা প্রকল্পের পিডি, আমি না হলে কে হবে বলেন তো? বরিশালে একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী। এখানে যে কাজ হবে তা আমি পাস না করলে কে করবে? এখানে যত কর্মকাণ্ড হোক না কেন, তা বরিশাল জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর মাধ্যমে প্রধান প্রকৌশলীর কাছে যাবে। সে দায়িত্ব তো আমাকেই পালন করতে হবে, আমি যদি পিডি নাও থাকি। আমার নিচের কোনো কর্মকর্তা যদি পিডি থেকে থাকে, তাকে কে সুপারভাইজ করবে? আমিই তো করবো।’
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, প্রকল্প কর্মকর্তাদের বদলি সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি হচ্ছেন পরিকল্পনামন্ত্রী। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের সচিবরা এর সদস্য।
Advertisement
বর্তমানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এক মাসের পারিবারিক সফরে বিদেশে থাকায় এক প্রকল্পে একজন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এদিকে সওজের বরিশাল জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবু হেনা মো. তারেক ইকবালের বক্তব্য সরকারি নির্দেশের বরখেলাপ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যে অনুশাসন এসেছে, সেটাকে চ্যালেঞ্জ করা বা এটা যদি কেউ বলে, তাহলে আমি মনে করি এটা সরকারি নির্দেশের বরখেলাপ। আমার এই চেয়ার চালানোর জন্য আমিই সক্ষম, আর কেউ সক্ষম না, এরকম প্রকল্প পরিচালক বা হাইলি টেকনিক্যাল ছাড়া এরকম প্রকল্প আছে বলে আমি জানি না যে, উনাকে ছাড়া চলবে না।’
তিনি বলেন, ‘বরিশালে (সম্প্রতি বরিশাল বিভাগে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের সব পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করেন পরিকল্পনামন্ত্রী ও আইএমইডি সচিব) আমরা বিশ্লেষণে কয়েকজনকে একাধিক প্রকল্পের দায়িত্বে পেয়েছিলাম। তাদের প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করে বলেছিলাম যে, আপনাদের অগ্রগতি ভালো না অন্যদের তুলনায়। একটি প্রকল্পের একজন দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের তুলনায় তারা পিছিয়ে আছেন। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, একজন মানুষ ১২টা বা ১৩টা প্রকল্পের দায়িত্বে থাকলে তার পক্ষে তো সম্ভব নয়। এটাই প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরাও এখন যে পরিবীক্ষণগুলো করি, এত টাকার ওপর প্রকল্প হলে পূর্ণকালীন একজন প্রকল্প পরিচালক থাকতে হবে, এটা আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণে রাখছি।’
আইএমইডি সচিব বলেন, ‘এটা আগে থেকেই ছিল যে, একজন একাধিক প্রকল্পের দায়িত্বে থাকতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে এবং একনেকে বহুবার বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এ রকম অনুশাসনও আছে যে, প্রকল্প এলাকায় প্রকল্প পরিচালককে থাকতে হবে। আমরা বরিশাল বিভাগে যখন গেলাম প্রধানমন্ত্রীর এই বার্তা পরিকল্পনামন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছেন, প্রকল্প এলাকায় প্রকল্প পরিচালক না থাকলে কাজ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আরও বেশি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।’
এক প্রকল্পে একজন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে আপনাদের দফতর থেকে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কি-না, জানতে চাইলে আইএমইডি সচিব বলেন, ‘আমাদের যে প্রকল্প পরিবীক্ষণ ছক, সেখানে একটা কলামই আছে যে, প্রকল্প পরিচালক সংক্রান্ত তথ্য। কে কত দিন ছিলেন, পূর্ণকালীন ছিলেন নাকি খণ্ডকালীন ছিলেন। আমাদের ছকটাই এরকম। সেটা লিখতে হয়। সেগুলো তো আমরা আগে থেকেই করে আসছি।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা নির্দেশনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকদের নিয়ে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলামকে ফোন করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।
যা বলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নথিতে‘একজন কর্মকর্তার একাধিক প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন সংক্রান্ত’ বিষয়ক পত্রটি গত ২০ জানুয়ারি জারি করেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পরিচালক-৬ শামীম আহম্মেদ।
সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের দেয়া পত্রে বলা হয়েছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চলমান প্রকল্পগুলোর তালিকা পর্যালোচনায় দেখা যায়, একজন কর্মকর্তা একইসঙ্গে একাধিক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পর্যালোচনার কয়েকটি তথ্য তুলে ধরে তাতে বলা হয়, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের একজন কর্মকর্তা একইসঙ্গে সর্বোচ্চ ১৪টি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দুজন কর্মকর্তা ১৩টি প্রকল্পের এবং পাঁচজন কর্মকর্তা ১০ বা ততোধিক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
স্থানীয় সরকার বিভাগের ৩৮ জন কর্মকর্তা দুই বা ততোধিক প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। তার মধ্যে ১৪ জন কর্মকর্তা তিন থেকে ছয়টি প্রকল্পে একইসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে সংগৃহীত তথ্যেও অনুরূপ চিত্র পাওয়া যায়। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী ‘ভয়াবহ’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন বলেও পত্রে উল্লেখ করা হয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন পদ্ধতি সংক্রান্ত পরিপত্রের ১৬.৩৬ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, কোনো প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি হলে পূর্ণকালীন অভিজ্ঞ ও যোগ্য প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের বিষয়টি অবশ্যই পরিপালন করতে হবে।
পত্রের ১৬.৩৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, একটি প্রকল্পে একজন প্রকল্প পরিচালক থাকবেন। একজন কর্মকর্তাকে একাধিক প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ করা যাবে না। তাছাড়া প্রতিটি প্রকল্পে একজন স্বতন্ত্র প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের জন্য ইতোপূর্বে প্রধানমন্ত্রী অনুশাসন দিয়েছেন। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিটি প্রকল্পে একজন পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করে এ কার্যালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। প্রাপ্ত ফলোআপ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বর্ণিত বিষয়ে সভা আয়োজন করা হবে।
পিডি/এমআরআর/এইচএ/এমকেএইচ