মতামত

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার সোনালি মওকা

স্নাতকে ভর্তির আবেদন নিতে শুরু করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস-বিইউপি আবেদন নিয়েছে। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার তারিখ স্থগিত করেছে অনিবার্য কারণে। আশা করা যায় শিগগিরই বিইউপিতে ভর্তি পরীক্ষার নতুন তারিখ দেয়া হবে। ভর্তির এই আয়োজন শুরু হবে অন্যান্য পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে এবার ভর্তিযজ্ঞটা কেমন হবে? কোথায় ভর্তি হবে সাড়ে ১৩ লাখের বেশি শিক্ষার্থী? উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে আছে এতো আসন?

Advertisement

করোনার তোড়ে এবার এক নজিরবিহীন নিদারুণ পরিস্থিতি হয়েছে এইচএসসি নামের পাবলিক পরীক্ষা ও ফলাফল নিয়ে। পরীক্ষা হয়নি, কিন্তু ফলাফল দিতে হয়েছে। তাদের পরীক্ষা শুরুর রুটিন ছিল ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে। কিন্তু করোনাভাইসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ করে দেয়া হয় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপর গত ৭ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন ডেকে পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনীর মতো এইচএসসি পরীক্ষাও বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। পরে জানানো হয়, দেয়া হবে অটোপাস এবং পাস নির্ধারণের মার্কিং পদ্ধতিও। কাজটির আইনি ভিত্তি দেয়া হয়েছে পোক্তভাবে। নানান আনুষ্ঠানিকতা শেষে ২৫ জানুয়ারি রাতে পরীক্ষা ছাড়াই এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে সংসদে পাস হওয়া তিনটি সংশোধিত আইনের গেজেট জারি করা হয়। সেদিন সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তিনটি বিলে সম্মতি দেন। বিল তিনটিতে রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর সেগুলো আইনে পরিণত হয়। এরপর গেজেট প্রকাশ শেষে শনিবার ঘোষণা হলো ফলাফল। এর মধ্য দিয়ে ফলাফলটিই কেবল আইনসিদ্ধ হলো না, ভবিষ্যতেও কোনো দুর্বিপাকে পড়লে এ আইন অনুসরণ করা যাবে।

সচরাচর প্রতি বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে প্রকাশ হয় এই পরীক্ষার ফল। কিন্তু করোনার কারণে গত বছরের মার্চ মাস থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার জেরে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাই হয়নি। নানা উৎকণ্ঠা, আলোচনা-সমালোচনার পর জেএসসির ২৫ শতাংশ এবং এসএসসির ৭৫ শতাংশ গড় নম্বর মিলিয়ে ৩০ জানুয়ারি এইচএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশ হয়। সমালোচনা থাকলেও এর বিকwল্প কেউ দেখাতে পারেনি সরকারকে। পরিস্থিতির অনিবার্যতায় ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ জন পরীক্ষার্থীর সবাই পাস। বিশ্বের কোনো কোনো দেশের মোট জনসংখ্যাও এতো নয়। ভ্যাটিকান সিটি বা তুভালোর জনসংখ্যা ১২ হাজারের বেশি নয়। বাংলাদেশের এবারের এইচএসসি পাসের সংখ্যাই গ্রিনল্যান্ডের জনসংখ্যার ২৪ গুণ বেশি। দেশটিতে হালনাগাদ জনসংখ্যা ৫৬৮২৭। মোনাকোর জনসংখ্যা আরো কম, মাত্র ৩৭ হাজার। জিব্রাইলটায় ৩২ হাজার। আর ফকল্যান্ডের জনসংখ্যা সর্বসাকুল্যে ৩ হাজারের বেশি নয়। এসব দেশের সঙ্গে তুলনা না করলেও বাংলাদেশের এবারের এইচএসসি উত্তীর্ণের সংখ্যাটি বিশাল। জনশক্তি বিচারে গুরুত্বপূর্ণ।

১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ শিক্ষার্থীর মধ্যে ‘জিপিএ-৫’ পেয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন। গেলবার জিপিএ-৫ ছিল ৪৭ হাজার ২৮৬। জিপিএ-৫ গত বছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেশি। পরীক্ষার্থীদের সবাইকে পাস করানো হবে-এ আভাস আগেই ছিল। পদ্ধতি মতো কার কী রেজাল্ট হবে সেটা আগাম জেনেছেন পরীক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা। তাদের সামনে এখন ভর্তির প্রশ্ন।

Advertisement

বিদ্যমান অবস্থায় সরকারি-বেসরকারিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে উচ্চশিক্ষাস্তরে আসন এর চেয়ে বেশি। দেশের ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন আছে ৬ লাখ। ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ লাখ ৩ হাজার ৬৭৫টি। এর বাইরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ লাখ ৭২ হাজার ৮১৫টি, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০ হাজার, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৭ হাজার ৭৫৬টি আসন রয়েছে। দেশের দুটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন আছে ৪৪০টি। মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ১০ হাজার ৫০০টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত সাত কলেজে আসন ২৩ হাজার ৩৩০টি। ৪টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ৭ হাজার ২০৬টি, টেক্সটাইল কলেজে ৭২০টি, সরকারি ও বেসরকারি নার্সিং ও মিডওয়াইফরি প্রতিষ্ঠানে আসন ৫ হাজার ৬০০টি। ১৪টি মেরিন অ্যান্ড অ্যারোনটিক্যাল কলেজে ৬৫৪টি, ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩ হাজার ৫০০টি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরও ২৯০টি আসন রয়েছে। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষায় মোট আসন ১৮ লাখ ৬৬ হাজার ৪’শ ৮৬টি। সংখ্যাই বলে দিচ্ছে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সংকোচন পদ্ধতি কার্যকর হয়ে যাচ্ছে। উত্তীর্নদের সবাই ভর্তি হতে পারবে। তবে, সরকারি বা পাবলিকে নয়। টাকা থাকলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড় ভরসা।

অভিভাবকেরা নিশ্চয়ই করোনা প্রকোপের মধ্যে সন্তানদের ঠেলে দিতে চাইবেন না। আবার যতোই বলা হোক-আগে জীবন, পরে শিক্ষা; সন্তানের পড়াশোনা বেশিদিন বন্ধ থাকাও কষ্টের। দুই ধরনের ঘটনার দৃষ্টান্তই রয়েছে। উন্নত অনেক দেশে এখনো স্কুল-কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। পরীক্ষা দেওয়া-নেওয়া আরম্ভ হয়নি। কোথাও কোথাও চালু হলেও আবার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর মানে এই নয় যে, তাদেরকে ওদেরকে আমাদের অনুসরণ করতে হবে। তারা কোন যুক্তিতে বন্ধ রেখেছে, অথবা খুলে আবার বন্ধ করেছে- দুটাই বিবেচনায় নিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতি গোটা বিশ্বের জন্য নতুন ও প্রায় অভিন্ন। তবে বিচ্ছিন্নভাবে ব্রেক অব স্টাডি, পরীক্ষা স্থগিত, ফলাফল বাতিল, সেশন জট ইত্যাদির সঙ্গে এ অঞ্চল বেশ পরিচিত। তা কেবল পরাধীন দেশে নয়। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশেও। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় যারা ডিগ্রি পরীক্ষার্থী ছিলেন, তাদের বিনা পরীক্ষায় সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছিল।

পরবর্তীতে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। লোকে তাদের ‘পার্টিশন গ্র্যাজুয়েট’ বলে বিব্রত করত। ১৯৬০ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৬১ সালের জুন পর্যন্ত ১৮ মাস এ অঞ্চলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তে হয়েছিল শরিফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী জানুয়ারি-ডিসেম্বরের পরিবর্তে জুলাই-জুন সেশন পরিবর্তনের কারণে।

৬১-তে আইয়ুব খানের মত পাল্টালে জানুয়ারি-ডিসেম্বর সেশনে ফিরতে তাদের সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়তে হয়েছিল মাত্র নয় মাস করে। ১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক দিয়ে আবার ফিরতে হয় আগের নিয়মে। ওই সময়টায় মাঝখান থেকে একটি ব্যাচের ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষকে ‘অটো পাস’ দেয়া হয়। বিএ, বিএসসি ও বিকম হয়ে পরে তাদের গঞ্জনা সইতে হয়। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের বছরের ক্যারিকেচারও এ দেশের শিক্ষাজগতের ইতিহাসের অংশ। সত্তরের নির্বাচনের আগে-পরের ঘটনাও অনেক। একাত্তরের কাহিনী ঊল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। বাহাত্তরের ঘটনা চরম কলঙ্কের। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে অটো পাস দেওয়া হয়। একাত্তরের প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষা হয় বাহাত্তরে।

Advertisement

আজও অবজ্ঞা-তাচ্ছিল্যের নাম বাহাত্তরের পাস। এছাড়া সেশনজট এড়াতে ১৯৭৫ ও ১৯৭৬ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দুটি ব্যাচকে একত্রিত করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের গ্রিডলক থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লেগেছে দীর্ঘ দুই যুগ। আগের নজির আমলে রেখে বলতে হয়, উচ্চমাধ্যমিকে যা হবার হয়ে গেছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারলে করোনার কলঙ্ক অবশ্যই কেটে যাবে। উচ্চশিক্ষার প্রবেশদ্বারে এসে ভালো স্বপ্ন দেখুক তারা। সেই স্বপ্নটা নিশ্চিত করতে ভর্তি এবং উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে বাড়তি কিছু পদক্ষেপ জরুরি।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/এমএস