আমাদের দেশে যক্ষ্মা এখনো একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। একসময় একে বলা হতো রাজরোগ। ‘যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই’- এমন কথা সমাজে প্রচলিত ছিল। অতীতে যক্ষ্মার জন্য কার্যকর কোনো ওষুধ ছিল না। তাই যার যক্ষ্মা হতো, তার মৃত্যুও ছিল অনেকটাই নিশ্চিত।
Advertisement
মাইকোব্যাকটেরিয়াল টিউবারকিউলোসিস নামক একধরনের ব্যাকটেরিয়ার কারণে যক্ষ্মা হয়ে থাকে। দীর্ঘস্থায়ী, সংক্রামক ও প্রাচীন রোগটি যেকোনো বয়সে, যে কারো হতে পারে।
তবে যক্ষ্মা রোগীর কাছাকাছি থাকেন এমন ব্যক্তি, যেমন- পরিবারের সদস্য, চিকিৎসক, নার্স বা সেবাদানকারীর আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
পরিবেশ দূষণ, ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, মাদকাসক্তি, বার্ধক্য, অপুষ্টি ইত্যাদি যক্ষ্মার ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। যাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কম, যেমন- এইডস রোগী, দীর্ঘ মেয়াদে স্টেরয়েড বা ইমিউনোথেরাপি ওষুধসেবীরাও যক্ষ্মার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
Advertisement
বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৯৬ লাখ মানুষ সক্রিয় যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন; যাদের মধ্যে ১৫ লাখই মারা যান। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৩ লাখ মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন এবং এর মধ্যে ৭০ হাজার রোগী মারা যান।
নতুন রোগীদের ২.২ শতাংশ ও পুরোনো রোগীদের ১৫ শতাংশই মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট বা ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগী। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় প্রচলিত বিভিন্ন ওষুধই অকার্যকর হয়ে পড়ে।
শতকরা ৮৫ ভাগ যক্ষ্মা ফুসফুসেই হয়ে থাকে। তবে যক্ষ্মা হয় না, শরীরে এরকম অঙ্গ খুব কমই আছে। ফুসফুসের আবরণী, লসিকাগ্রন্থি, যকৃত, বৃক্ক, মস্তিষ্ক ও এর আবরণী, অন্ত্র, হাড় এমনকি ত্বকেও হতে পারে যক্ষ্মা। তবে ফুসফুসে যক্ষ্মা সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি।
এ কারণেই সরকারি সচেতনতামূলক প্রচারণায় একেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। শরীরের অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যক্ষ্মা আবার ফুসফুসের যক্ষ্মার মতো এতটা ছোঁয়াচে নয়। শুধু আক্রান্ত ব্যক্তি যদি একজন সুস্থ ব্যক্তির শরীরের কোনো কাটা স্থান স্পর্শ করেন; তাহলে এই রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে।
Advertisement
দেশের মোট জনসংখ্যার একটি অংশ জন্মগতভাবেই যক্ষ্মা রোগের জীবাণু বহন করে। তবে শরীরে জীবাণু থাকা মানেই কোনো ব্যক্তি যক্ষ্মা রোগী নন। তবে জীবাণুর ধারক নিজে রোগাক্রান্ত না হলেও তার মাধ্যমে অন্য ব্যক্তির শরীরে যক্ষ্মা ছড়াতে পারে। যক্ষ্মার জীবাণু আসলে রয়েছে আমাদের চারদিকেই।
চারপাশের পরিবেশে-বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে যক্ষ্মার জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া। বিশেষত শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ছড়ায় বলে আমরা সহজে যক্ষ্মার জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকি। অনেক সময় জীবাণু শরীরে সুপ্ত অবস্থায় থাকে; তখন এর উপসর্গ বোঝা যায় না। পরবর্তীতে কোনো একসময় উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হলে সুপ্ত যক্ষ্মা সক্রিয় যক্ষ্মায় রূপ নিতে পারে।
টানা তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাশি- শুকনো কিংবা কফযুক্ত, কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া, বুকে ব্যথা, ওজন হ্রাস, অবসাদ, অরুচি, সন্ধ্যায় বা রাতে হালকা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর (৯৯-১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইট) কিংবা রাতে ঘাম হলে অবশ্যই যক্ষ্মা সন্দেহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত।
লসিকাগ্রন্থির স্ফীতি, মলত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন, পেটব্যথা, বুকে বা পেটে পানি জমা, খিঁচুনি বা অজ্ঞান হয়ে পড়া ইত্যাদিও যক্ষ্মার ভিন্ন কিছু উপসর্গ। এরকম ক্ষেত্রে যক্ষ্মার জীবাণু ফুসফুস থেকে বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।
ফুসফুস ছাড়া শরীরের অন্য যে অংশে যক্ষ্মার জীবাণু সংক্রমিত হয়, সেই অংশটি ফুলে ওঠে। যেমন- গলায় লসিকাগ্রন্থি আক্রান্ত হলে গলার ওই অংশ ফুলে উঠতে পারে। কিংবা মেরুদণ্ড আক্রান্ত হলে মেরুদণ্ডের ওই অংশ ফুলে উঠতে পারে এরকম। এমন ফোলা অংশগুলো খুব শক্ত বা নরম হয় না- অনেকটা সেমি সলিড ধরনের হয়ে থাকে।
চিকিৎসায় যক্ষ্মা সম্পূর্ণরূপে ভালো হয়। দুই ধরনের ক্যাটাগরিতে যক্ষ্মার চিকিৎসা দেওয়া হয়। একটি ক্যাটাগরিতে ছয় মাস ধরে নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। অপর ক্যাটাগরির ক্ষেত্রে ৮-৯ মাস ধরে নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়।
তবে অনেক সময় দুই থেকে তিন মাস ওষুধ খাওয়ার পর আক্রান্ত রোগী একটু ভালো অনুভব করলে, ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দেন। এটি একদমই ঠিক নয়। যক্ষ্মার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ নিয়মিত পূর্ণ মেয়াদে সেবন করতে হয়।
না হলে আবার যক্ষ্মা হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং এরকম ক্ষেত্রে আগের ওষুধ কোনো কাজেও আসে না। তৈরি হয় মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি এবং এক্সট্রিম ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি, যার চিকিৎসা খুবই দুঃসাধ্য এবং ব্যয়বহুলও বটে।
যক্ষ্মা প্রতিরোধে জন্মের পরপরই প্রত্যেক শিশুকে বিসিজি টিকা দেওয়া উচিত। হাঁচি, কাশি ও কফের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। তাই রাস্তা-ঘাটে হাঁচি-কাশি এলে মুখে রুমাল চাপা দেওয়া উচিত এবং যত্রতত্র কফ-থুথু ফেলা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীকে যথাযথ পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। শ্লেষ্মায় জীবাণুবাহী যক্ষ্মার ক্ষেত্রে রোগীকে অন্তত ২ সপ্তাহ আলাদা রাখতে হবে এবং রোগীর মুখে সব সময় মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। চিকিৎসা চলাকালীন রোগীকে নিয়মিত ফলোআপে রাখা জরুরি।
সাধারণত চিকিৎসার দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে জ্বর কমে যায়, খাবারে রুচি আসে এবং ওজনও বাড়তে থাকে। এ ধরনের উন্নতি দিয়ে বোঝা যায়, রোগী চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন।
যক্ষ্মার ওষুধে কোনো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে, যেমন- জন্ডিস, চোখে ঝাপসা দেখা, মাথা ঘোরা, পায়ে শিরশির করা ও অবশতা দেখা দিলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
জেএমএস/এসইউ/এমকেএইচ