বিনোদন

ঢাকাই সিনেমায় যৌবনে নারী নায়িকা, অভিজ্ঞ হলেই গুরুত্বহীন

বাংলাদেশের সিনেমায় নারীরা এসেছে কখনো নামের উপমা হয়ে, কখনো এসেছে গল্পের সৌন্দর্যে। হাজার হাজার সিনেমার ভিড়ে নারীপ্রধান গল্পের ছবি হাতেগোনা। ছবিতে নারীর উপস্থাপনাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক। সংসার, স্বামী কিংবা কাছের পুরুষটি যতই ত্রুটিতে পূর্ণ থাকুক, তাকে আগলে রাখতে, তার পায়ের নিচে শান্তি খুঁজতে, তার করুণায় বেঁচে থাকার শিক্ষা ষাট ও সত্তর দশকের অনেক সিনেমাই দিয়েছে আমাদের নারীদের।

Advertisement

সেখানে প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন শবনম, সুচন্দা, আনোয়ারা, সুজাতা, শাবানা, ববিতা, কবরী, রোজিনা, অঞ্জনারা।

আবার তাদের অনেকেই ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’, ‘ভাত দে’, ‘সারেং বউ’-র মতো সিনেমায় সংগ্রামী নারীকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সেটা অনিয়মিত হলেও।

যুগের সাথে সাথে নারীর উপস্থাপনে পরবর্তী দশকগুলোতেও খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। অঞ্জু ঘোষ, চম্পা, দিতি, মৌসুমী, শাবনূরেরাও গুরুত্বহীন নারীর চরিত্র নিয়ে হাজির হয়েছেন বারবার।

Advertisement

বিশ্ব চলচ্চিত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের নারীরা সিনেমায় খুব একটা আকাশে উড়েনি, ব্যাংকে বসেনি, পুলিশ-আর্মিতে যায়নি। দেখা যায়নি কোনো নারী চরিত্র ডাক্তার হয়ে সিনেমায় এসে দেশবাসীকে কোনো আদর্শ চরিত্র বা সংলাপ উপহার দিয়েছে। এসব হিরোইজম এখানকার নায়কদের দখলেই ছিল বরাবর। নারীরা কেবলই নায়িকা হয়ে, সিনেমার বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েছে প্রেম কিংবা সংসারের আশ্রয়ে। বালিশে এঁকেছে ‘ভুলো না আমায়’।

বড়জোর, প্রতিবাদী নারীর রূপ দেখাতে অস্ত্র-গোলাবারুদ হাতে নিয়ে গল্পের গরু আকাশে উড়ানোর মতোই আমাদের নারী চরিত্ররা রোমাঞ্চ ছড়িয়েছে সিনেমার পর্দায়। সেখানেও গ্রামীণ নারীদের সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ ও লড়াইয়ের গল্পগুলো যতোটা গুরুত্ব পেয়েছে সে তুলনায় শহুরে নারীদের গল্প সিনেমায় এসেছে খুব কম।

স্বাধীনতার পর থেকেই এই দেশের নারীদের উন্নতি হয়েছে সবখানে। তারা আকাশে বিমান নিয়ে উড়ে বেরিয়েছে, পুলিশ-আর্মিতে ঢুকে জাতিকে সেবা করেছে, ব্যবসা-ব্যাংকে প্রবেশ করে করপোরেট দুনিয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছে। সিনেমায় সেসব চরিত্র খুব একটা দেখা যায়নি।

সিনেমায় নারীর উপস্থাপনা সবচেয়ে নাজুক বর্তমান সময়ের সিনেমায়। নারী এখন শুধু যেন প্রেমিকাই; যার জন্য রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটানো যায়। আর কিছু নয়। আজকাল আর আমজাদ হোসেনের মতো কোনো নির্মাতার ছবিতে গোলাপির দেখা মেলে না, কোনো সুন্দরী প্রতিবাদী হয় না সমাজের লোলুপ-রিক্ত চিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে। এখন ‘অগ্নি’ নাম নিয়ে চলে দর্শক মাতানোর গল্প, সমাজ বা চেতনাকে মাতাতে পারে না।

Advertisement

সব ছবিতেই নারী চরিত্রগুলো কেমন যেন ফ্যাকাশে। নায়িকারা হাজির হচ্ছেন সিনেমার গ্ল্যামার আর কাটতি বাড়াতে। এখন নারীপ্রধান সিনেমা বলতে নায়িকাকেন্দ্রিক নাম। কিন্তু গল্পের পরতে পরতে সেই পুরুষতান্ত্রিকতা, কৌশলে নারীর যোগ্যতাকে এড়িয়ে যাওয়া।

বেশিরভাগ সিনেমায়ই নায়িকা পর্দায় নায়কের কোমর ধরে নাচেন, হাঁটেন, ঘুরে বেড়ান, নাকি কাঁদেন। বাকি যা করার একাই একশ নায়করা করছেন। অনেক নায়িকার ক্যারিয়ারই গড়ে উঠছে নায়কদের নামের ওপর ভর করে। নিজস্ব আলো বা সাফল্য বলতে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, যা দেখে মনে হয়, নারীই যেন নারী উন্নয়নের অন্তরায়।

তারচেয়েও করুণ হলো বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞ নারীশিল্পীরা চলচ্চিত্রে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেন ঢাকাই সিনেমায়। মেধা ও অভিজ্ঞতার মূল্যায়ণের চেয়ে এখানে নারীর যৌবনবতী হওয়া, গ্ল্যামারের ছটাই যেন মূল যোগ্যতা। আমাদের সিনেমায় এককালে অভিনয় দিয়ে বাজিমাত করা ববিতা, কবরী, রোজিনা, সুচন্দা, সুচরিতা, শাবনূর, পপিরা অনিয়মিত। অভিজ্ঞতা অনুযায়ী যোগ্য চরিত্র ও মূল্যায়ণের অভাবেই এসব সফল অভিনেত্রীরা প্রায় কাজই করেন না আর।

অথচ প্রত্যেকেই যার যার সময়ে সেরাদের তালিকায় রয়েছেন। অভিনয় বলা চলে গিলে খেয়েছেন। মানুষকে নাড়া দেয়ার মতো চরিত্র পেলে, সমাজে প্রভাব ফেলার মতো চরিত্র পেলে এনারা বাজিমাত করবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, ক্যামেরা হেসে উঠে এইসব অভিনেত্রীদের দেখলেই।

কিন্তু ‘তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না’ কিংবা ‘তোর বাবার প্রতিশোধ নে বাবা’ টাইপের সংলাপ ছাড়া তেমন কোনো চরিত্র এদের হাতে পৌঁছায় না। স্বভাবতই চরিত্রের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে, নিজেদের সুনামের ওজন কমিয়ে সিনেমার ওজন বাড়ানোর চেষ্টা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন তারা।

হলিউডে ষাট বছর বয়স পেরিয়েও অভিনেত্রীরা সেরা অভিনেত্রী হয়ে অস্কার পাচ্ছেন। আর আমাদের দেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতা মনের মতো চ্যালেঞ্জিং চরিত্র না পেয়ে চলচ্চিত্র থেকে দূরে থাকছেন। পার্থক্যটা এখানেই স্পষ্ট।

এই ইন্ডাস্ট্রিতে নিয়ম মেনে বয়স হয়ে গেলে নায়িকারা বোন-ভাবী-মায়ের চরিত্র নিয়ে চরিত্রের প্রমোশন পান ঠিকই, গল্পে গুরুত্বের অভাবে অভিজ্ঞতার প্রমোশনটা হয় না। ফলে অনেক অভিনেত্রীই নিজেকে ইমেজ সংকটের কথা ভেবেই সরিয়ে রাখেন। এজন্য অভিজ্ঞরা এখানে নিরব। কারো কারো ভাষ্যে, ‘বেকার’! সেই তালিকায় আগামীর নামগুলো হয়তো অপু বিশ্বাস, মাহিয়া মাহি, বুবলী প্রমুখ। কেউ কেউ হয়তো টিকে থাকবেন যদি ঘটের টাকা ব্যায় করে প্রযোজনায় থাকতে পারেন। নইলে অতীত ও বর্তমান চিৎকার করে বলছে, আজকে যাদের ঘিরে ইন্ডাস্ট্রিতে কোটি কোটি টাকার লগ্নি, একটা সময় তারাই এখানে ঘুরে বেড়াবেন গুরুত্বের অভাবে। 

এর উত্তরণে প্রয়োজন গল্প ভাবনায় পরিবর্তন। নারীকে মানুষ হিসেবে যথাযোগ্য মূল্যায়ণ। প্রয়োজন নারীর মেধা ও অধিকার-ক্ষমতার উপর শ্রদ্ধাবোধ।

ভাবী, মা-দাদীর চরিত্র করতে দোষ নেই। সেটাতে যেন সম্মান ও যত্ন থাকে। এক্ষেত্রে ‘আম্মাজান’ ছবিটি হতে পারে একটি দারুণ উদাহরণ। মান্নার পাগলাটে অভিনয় ছবিটিকে অনন্যতা দিয়েছে। কিন্তু সেই ছবিতে প্রায় নির্বাক চরিত্রে অভিনয় করেও দেশের দর্শকদের কাছে ‘আম্মাজান’ খ্যাতি পেয়েছিলেন নন্দিত অভিনেত্রী শবনম। কারণ তার চরিত্রটিকে যত্ন দিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে তৈরি করেছিলেন ছবির গল্পকার ও পরিচালক কাজী হায়াৎ। এরপর..... কোথায় সেই চরিত্র যেখানে অভিনয় কিংবা গল্পের গুরুত্বে নায়িকা না হয়েও নারী প্রাধান্য পেয়েছে?

প্রচলিত ভুল ধারনা ও পরিবার, সমাজ এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে জিম্মি করে রাখার দেয়াল টপকে সংগ্রাম ও উত্থানের বিকাশে আরেকটা ‘মোল্লা বাড়ির বউ’-এর জন্য কতদিন অপেক্ষা করতে হবে ইন্ডাস্ট্রিকে কে জানে!

হালের সর্বশেষ জনপ্রিয় কিছু সিনেমার নাম ‘আয়নাবাজি’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘শিকারী’, ‘নবাব’, ‘বসগিরি’, ‘দেবী’, ‘বীর’, ‘পাসওয়ার্ড’। মনে দাগ কেটেছে কোন সিনেমার কোন নারী চরিত্রটি? বুকে হাত দিয়ে এর সদুত্তর হয়তো ছবিগুলোর নির্মাতরাও দিতে পারবেন না। নায়িকারা এইসব ছবিতে এসেছেন নায়ককে বিকশিত করতে, গল্পকে উপভোগ্য করতে।

কিন্তু ধুমধাম ব্যবসা ব্যবসা না করলেও তৌকীর আহমেদের ‘হালদা’, গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘স্বপ্নজাল’ ছবিগুলো নারীর প্রতি বেশ যত্ন নিয়েছে। এই ছবিগুলো প্রমাণ দেয়, চরিত্র নিয়ে ভাবলেই নারীদের গুরুত্ব বাড়ানো যায় সিনেমায়। এটুকু মাথায় রাখলেই হয়, সংগ্রামী জীবন তো কেবল পুরুষের নয়, নারীরও অনেক সংগ্রাম থাকে জীবনের প্রতি পদক্ষেপে।

সিনেমা সবচেয়ে বড় গণমাধ্যম। সিনেমা সমাজ বদলায়। কিন্তু আমাদের ষাট বছরের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলার মতো নারী চরিত্র খুব বেশি জন্ম নেয়নি। নারীর সৌন্দর্য ও গ্ল্যামারকেই বিক্রি করা হয়েছে যুগে যুগে।

চলচ্চিত্রে উপস্থাপনের পাশাপাশি নারীরা এখানে পিছিয়ে আছে চলচ্চিত্র নির্মাণ, চিত্রগ্রহণ, শব্দগ্রহণ, রুফসজ্জাকারীসহ অন্যান্য পেশাগুলোতেও। খুব বেশি নারী প্রযোজকও নেই আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে। যে ক’জন আছেন নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয় তাদের। দুহাত ভরে অর্থযোগ হয় বলে নায়িকা হওয়া নিয়ে হয়তো আগের মতো আমাদের পরিবারগুলো আর অনীহা দেখায় না। তবে ক্যামেরার পেছনে কাজ করতে আসা নারীদের এখনো অনুমতি মেলে না পরিবার থেকে। সেখানে ঝুঁকির চেয়ে অর্থযোগ যে অনেক কম!

তবে প্রশংসনীয় একটি বিষয় হলো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি পরিচালন বা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছে নারী। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) এমডি পদে আসীন হয়েছেন নারী। বর্তমানে এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নুজহাত ইয়াসমিন। সেন্সরবোর্ডেও নারীদের অংশ গ্রহণ দেখা গেছে বারবার।

এটাকে অনুপ্রেরণা হোক। নায়িকার যৌবনের জৌলুস হারালেও পর্দায় যেন না হারায় তার অভিনয়ের অভিজ্ঞ জৌলুস।

এলএ/এমএস