ঠাকুরগাঁওয়ে উৎপাদিত পরচুলা এখন বিদেশে রফতানি হচ্ছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এ ক্ষুদ্র শিল্প গ্রামীণ নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
Advertisement
বিশ্বের নামিদামি তারকাসহ অনেকের কাছেই এ পরচুলার ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ঠাকুরগাঁওয়ের নারী উদ্যোক্তা কনিকা বেগম বলেন, স্বল্প সুদে ঋণ পেলে বড় আকারে নারীদের কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখবেন তিনি।
উদ্যোক্তা কনিকা তার জীবনের গল্প তুলে ধরে বলেন, বয়স যখন ১১ বছর তখন হঠাৎ করেই বাবা মারা যান। কোনো কাজ জোটাতে না পেরে (আমার মা) কনিকার মা ফাতেমা বেগম দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকার টঙ্গীর একটি ভাড়াবাসায় ওঠেন। সেখানে একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেন তিনি।
কনিকার ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা পূরণ করানোর জন্য ভর্তি করা হয় একটি স্কুলে। সেখানে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া হয় তার। সামান্য আয়ে সংসার চলছিল না। মায়ের কষ্ট দেখে স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়ে টঙ্গীর একটি হেয়ার ফ্যাশন কারখানায় কাজ নেন তিনি। মা-মেয়ের আয়ে সংসার বেশ ভালোই চলছিল। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তাকে বিয়ে দেন মা।
Advertisement
এক অভাব থেকে আরেক অভাবের পথে সঙ্গী হন তিনি। স্বামীর সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। বিয়ের কিছুদিন পরই দুই কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। সংসারে সদস্য বাড়ে কিন্তু রোজগার বাড়েনি। অভাব মোচনের জন্য ঢাকায় স্বামীকে রেখে নিজ এলাকায় ফিরে আসেন।
এরপর ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেন কনিকা। তার স্বপ্নপূরণে সহযোগিতা করেন ‘আরডিআরএস-বাংলাদেশ’ নামের স্থানীয় একটি এনজিও। সামান্য পুঁজি, সঞ্চিত অভিজ্ঞতা এবং এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শুরু হয় কনিকার পথচলা।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা জগন্নাথপুর ভালুকা গ্রামে স্বামীর বাড়ির উঠানে স্থাপন করেন চুলের টুপি (পরচুলা) তৈরির কারখানা। বিভিন্ন বিউটিপার্লার থেকে সংগ্রহ করেন নারীদের মাথার চুল। ওই চুল দিয়ে তৈরি করা হয় টুপি বা ক্যাপ।
সাড়ে তিন বছর আগে শুরু করা ক্ষুদ্র এ শিল্পটি বর্তমানে বৃহৎ আকার ধারণ করেছে। তার উৎপাদিত চুলের টুপি রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে ভারতসহ চলে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে।
Advertisement
কনিকা গত তিন বছরে ভারত, দুবাই, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জাপান, নেপালসহ প্রায় ১০টি দেশে পরচুলা রফতানি করেছেন। এতে করে গত ৩ বছরে ৬০ লক্ষাধিকের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছেন তিনি।
এছাড়া চুলের টুপি তৈরি করে নিজে যেমন স্বাবলম্বী হয়েছেন, স্বাবলম্বী করেছেন অন্যদেরও। সাধারণ থেকে এখন তিনি হয়ে উঠেছেন অসাধারণ। তার হাত ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামীণ জনপদের শতাধিক পরিবার।
কারখানায় কাজ করা নারী শ্রমিক রোকসানা আক্তার বলেন, ‘স্বামী ভাড়ায় ট্রলি চালান। দুই সন্তান রয়েছে। স্বামীর উপার্জনে সংসার চলতো না। দুই বছর ধরে এখানে কাজ করছি। যে টাকা উপার্জন করি তাতে সংসার ভালোভাবেই চলে’।
মনিরা বেগম বলেন, ‘ছয় ভাই-বোনের অভাবের সংসার। তাই পঞ্চম শ্রেণির পর আর লেখাপড়া করা হয়নি। পরে কনিকা আপার কাছে পরচুলা তৈরির প্রশিক্ষণ নেই। দেড় বছর ধরে কাজ করছি এখানে। এখন সংসারে টাকাও দিতে পারি’।
কনিকা বেগম বলেন, একসময় একাই এই কাজ করতাম। প্রশিক্ষণ দিয়ে এখন অনেক শ্রমিক তৈরি করেছি। স্বামী ঢাকায় এই পণ্য বাজারজাতের কাজ করছেন। কারখানায় শ্রমিকের কাজ করছেন এলাকার শতাধিক নারী।
তাদের মধ্যে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীও রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের পরিশ্রমে প্রতিদিন তৈরি হয় কমপক্ষে ৪০-৫০টি টুপি। আর এই পরচুলা বিক্রির টাকায় চলে এসব খেটে-খাওয়া শ্রমিকদের সংসার।
চলে অনেকের পড়াশোনার খরচ। ঘরে বসে মাসে আয় করেন আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। কনিকা যেন এখন পথের দিশারি হয়ে দাঁড়িয়েছেন অসহায় নারীদের জীবনে।
কর্মহীন, বিধবা ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের দেয়া শুরু করেন পরচুলা তৈরির প্রশিক্ষণ। এরপর আর থামেনি পথচলা। ঢাকার একটি পরচুলা তৈরির কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে সেখানে পরচুলা সরবরাহ করেন কনিকা।
এই পরচুলাগুলো চলে যাচ্ছে ভারত, দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কয়েকটি দেশে। মানুষের টাকমাথা, ফ্যাশন এবং অভিনয় শিল্পীদের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয় এই পরচুলা বলে জানান কনিকা বেগম।
ঠাকুরগাঁও জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রোকসান বানু হাবীব বলেন, এককালের দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামটি এখন আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে। কনিকা এখন সফল একজন নারী উদ্যোক্তা। তার মাধ্যমে অন্য নারীরা যেন স্বাবলম্বী হতে পারে সেজন্য জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদফতর কাজ করছে।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক কামরুজ্জামান সেলিম নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কনিকা বেগমকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বলেন, সরকার কনিকার মতো উদ্যোক্তাদের বিষয় গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছেন। কনিকা ঠাকুরগাঁয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখছেন।
তাকে সরকারি সকল সহায়তার দেয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলেও জানান তিনি।
তানভীর হাসান তানু/এসএমএম/এমএস