নারী ও শিশু

স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে উদ্বোধনী ট্রেনের চালক হতে চাই : সালমা

সালমা খাতুন। ২০০৪ সালের ৮ মার্চ দেশের প্রথম নারী ট্রেনচালক হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়েতে সহকারী লোকোমাস্টার বা সহকারী ট্রেনচালক হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে ১৮ জন নারী ট্রেনচালক রয়েছেন। সালমা খাতুনই দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ নারী ট্রেনচালক। তিনি ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট লোকোমাস্টার বা পূর্ণাঙ্গ ট্রেনচালক হন।

Advertisement

ট্রেনচালক হিসেবে দেশের নারীদের পথপদর্শক সালমা খাতুন রোববার (৭ মার্চ) রাজধানীর কমলাপুর থেকে গাজীপুরের কালিয়াকৈর পর্যন্ত ডেমো ট্রেনের চালকের দায়িত্বে ছিলেন। কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সালমা খাতুনের সঙ্গী হয় জাগো নিউজ। এ সময় নারী ট্রেনচালক হিসেবে প্রতিবন্ধকতা, ভালোলাগার কথা জানিয়েছেন তিনি। সালমা জানান, পরিবার কিংবা গ্রামের মানুষদের কাছ থেকে নয়, নারী ট্রেনচালক হওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম বাধা এসেছিল শিক্ষিত শ্রেণির কাছ থেকে।

ট্রেনচালক হিসেবে সময় যত বাড়ছে, তত চ্যালেঞ্জও বাড়ছে সালমার। একদিকে যেমন তার সংসার বড় হয়েছে, অন্যদিকে ট্রেনে দায়িত্ব বেড়েছে। তবুও সালমা স্বপ্ন দেখেন স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে প্রথম ট্রেনটি চালানোর। সালমা খাতুন এমন নানান বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রদীপ দাস এবং ক্যামেরায় ছিলেন মাহবুব আলম।

জাগো নিউজ : ট্রেনচালক হওয়ার চিন্তা কবে মাথায় আসলো?

Advertisement

সালমা খাতুন : ট্রেনচালক হবো এটা যে মাথায় এসেছে, তেমনটা না। যখন থেকে বুঝি তখন থেকে আমার মাথায় ছিল ব্যতিক্রমধর্মী একটি পেশায় কাজ করবো। তখন থেকেই আমার ট্রেনচালকের পেশায় আসা।

জাগো নিউজ : ট্রেনচালক হওয়ার সূচনা হলো কীভাবে?

সালমা খাতুন : আমি যখন এইচএসসি পাস করে মাত্র অনার্সে ভর্তি হয়েছি, তখন বাংলাদেশ রেলওয়েতে একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হয়। আমার ভাই ফোন করে বললেন, রেলওয়েতে একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হয়েছে, তুমি যেমন ব্যতিক্রমধর্মী পেশা খুঁজছ সেরকম একটা পেশা। আমি বললাম, সেটা কী ভাইয়া? ভাইয়া বললেন, সহকারী লোকোমাস্টার, মানে সহকারী ট্রেনচালক। আমি বললাম, বিজ্ঞপ্তিটি নিয়ে আসেন। ভাইয়া বিজ্ঞপ্তি নিয়ে আসলেন। পরে আবেদন করলাম। আবেদনের প্রায় এক বছর পরে লিখিত পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি, সব জেলা মিলে ১০ থেকে ১২ জনের মতো মেয়ে এসেছেন, বাকিরা সবাই ছেলে। লিখিত পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হলাম। মৌখিক পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি, আমি একাই মেয়ে। ছেলেরা সবাই আমাকে বলছিলেন যে, মৌখিক পরীক্ষা দিতে এসেছেন কিন্তু আপনি তো এই চাকরি করতে পারবেন না। কীভাবে করবেন? তখন আমি মৌখিক পরীক্ষার জন্য পড়ছিলাম। তারা কে কী বলছিল, তা না শুনে আমি পড়ছিলাম। বিকেল ৫টার দিকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য আমার ডাক আসে। ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভাইভা বোর্ডে যারা ছিলেন তারা জিজ্ঞাসা করলেন, সবাই তো ছেলে, আপনাকেই কেবল মেয়ে পেলাম। আপনি কি এই পেশায় ভেবেচিন্তে এসেছেন? আপনি কি এই কাজ করতে পারবেন? আমি বললাম, অবশ্যই করতে পারবো। মৌখিক পরীক্ষা শেষে বাড়ি চলে আসি।

৮-৯ মাস পর নিয়োগপত্র আসে বাংলাদেশ রেলওয়েতে যোগদান করার জন্য। যোগদান করতে আমি চট্টগ্রাম চলে গেলাম। তখন যারা যোগদান করতে এসেছিলেন তারা সবাই বলছিলেন, তুমি এই চাকরি করবা? যেখানে যোগদান করবো সেখানকার শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছিলেন, জান এই পেশা কী? আমি বললাম জানি। জেনে কেন যোগদান করছ? তারপর আমি ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, ঘটনা এরকম। সবাই তো কেমন কেমন করছে। আমার ভাই বললেন, তুমি যোগদান করো। পরেরটা পরে দেখা যাবে। পরে আমি যোগদান করে বাড়ি চলে আসলাম। তারপর এক মাস সময় দিল চূড়ান্তভাবে যোগদান করার জন্য। ২০০৪ সালের ৮ মার্চ আমি চাকরিতে যোগদান করি।

Advertisement

জাগো নিউজ : ট্রেনচালক হিসেবে যোগদান করার পর পরিবার ও প্রতিবেশীরা কী ধরনের আচরণ করেছিলেন?

সালমা খাতুন : শুরুর দিকে গ্রামের মানুষ জানতেন না যে, আমি ট্রেনচালক পেশায় যোগদান করেছি। আমার একটা চাকরি হয়েছে রেলওয়েতে, এটা সবাই জানতেন। যখন তারা জানতে পেরেছেন, তাদের গ্রামের একজন মেয়ে ট্রেনচালক হয়েছেন- এতে সবাই তখন খুশি হয়েছিলেন। গ্রামের শিক্ষক ও অন্যরা জানতেন আমি ভালো ছাত্রী। তারা বলতেন, এটা সালমা পারবে। এরকম একটা আত্মবিশ্বাস সবার মধ্যে ছিল।

জাগো নিউজ : ২০০৪ সালের ৮ মার্চ কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেছিলেন। তারপর দীর্ঘসময় পেরিয়েছে। এত সময় ট্রেনচালক হিসেবে পার করার পর নিজের অনুভূতি কী?

সালমা খাতুন : আমার এটা চ্যালেঞ্জিং পেশা। অনেকের ক্ষেত্রে এমন হয় যে, সময় বাড়ার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ কমে যায়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা নয়। দিন দিন আমার চ্যালেঞ্জ বেড়ে যাচ্ছে।

জাগো নিউজ : কীভাবে চ্যালেঞ্জ বাড়ছে?

সালমা খাতুন : রেলওয়েতে আমি সহকারী লোকোমাস্টার হিসেবে যোগদান করেছিলাম। তখন দায়িত্ব কম ছিল। তারপর সাব-লোকোমাস্টার হলাম। ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট আমি লোকোমাস্টার বা পূর্ণাঙ্গ ট্রেনচালক হই। এতে বিশাল দায়িত্ব বেড়ে গেছে। ট্রেনের এতগুলো মানুষের জীবন, সরকারি সম্পদ রক্ষা- এটা অনেক বড় দায়িত্ব। অন্যদিকে আমার আগে সংসার ছোট ছিল। বিয়ে হলো, আমার দুই মেয়ে হলো। এখন একজনের বয়স সাত বছর এবং আরেকজনের দুই বছর। বড় মেয়ের পড়াশোনা এবং ছোট মেয়ের দেখাশোনা করা, সংসারের অন্যান্য কাজকর্ম বেড়ে গেছে। সামগ্রিকভাবে আমার চ্যালেঞ্জটাও বেড়েছে।

জাগো নিউজ : পূর্ণাঙ্গ ট্রেনচালক হিসেবে কী কী দায়িত্ব পালন করতে হয়?

সালমা খাতুন : ট্রেন তো চালাবোই। ট্রেনে যদি যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়, সেটার সমাধান করতে হয়। তাই যান্ত্রিক ত্রুটির সব কাজ জানতে হয়।

জাগো নিউজ : দীর্ঘ দূরত্বের আন্তঃনগর ট্রেন চালান কি-না?

সালমা খাতুন : না। এটা নারী হিসেবেই সম্ভব হয় না। কারণ হচ্ছে আমার দুই বাচ্চা আছে। বেশি দূরে গেলে রাতে থাকতে হবে। যেমন- আজ সকালে একটা ট্রেন নিয়ে চট্টগ্রাম গেলাম, রাত থেকে আগামীকাল আরেকটা ট্রেন নিয়ে ঢাকায় আসতে হবে। সেটা নারী হওয়ার কারণেই সম্ভব হয় না। কারণ বাচ্চা আছে, তাদের রেখে রাতে থাকা কঠিন। আমি স্বেচ্ছায় দূরপাল্লার ট্রেনগুলো চালাই না। তবে আমি চাইলে আমাকে দেবে।

জাগো নিউজ : ট্রেন চালানোর ক্ষেত্রে আপনাকে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়?

সালমা খাতুন : অনেক কর্মক্ষেত্রে শতভাগ না দিলেও চলে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তা না। আমাদের ক্ষেত্রে মনোযোগ, দৃষ্টি, মেধা শতভাগ দিতে হবে। এর চেয়েও বেশি দিতে পারলে ভালো। মোটকথা ভুল করা যাবে না। অমনোযোগী হলে বিপদ হয়ে যেতে পারে। ট্রেন চালানোর ক্ষেত্রে সিগন্যাল গুরুত্বপূর্ণ। সিগন্যাল ভুল করা যাবে না। ট্রেন চলার সময় পাথর মারে। এটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার। আমাদের মনে এই ভীতি সবসময় কাজ করে। গতকালও (৬ মার্চ) জয়দেবপুরের দিকে ট্রেনে পাথর মেরেছে।

আরও ঝামেলা আছে। আমি ট্রেন চালাচ্ছি। ট্রেনে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে যাত্রীরা খুব ক্ষেপে যান। সবারই তো সময়ের গুরুত্ব আছে। কেউ হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছেন, কেউ হয়তো বিমান ধরবে মানুষের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে বা কোনো কারণে ট্রেন থেমে থাকলে যাত্রীরা আমার ওপর খুব ক্ষেপে যান। অনেকে এসে বকাঝকা করেন। এরকম বলেন যে, আপনি নারী সেজন্য চালাতে পারছেন না। ছেলেদেরটা তো ঠিকই যাচ্ছে, আপনারটা বসিয়ে রেখেছেন। গতকাল (৬ মার্চ) কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে আমার ট্রেন প্রবেশ করার কথা সন্ধ্যা ৭টার দিকে। সেই ট্রেন কমলাপুরে প্রবেশ করালাম রাত সাড়ে ১০টার দিকে। অনেকে আমার সামনে এসে কান ধরেছেন। তারা বলেছেন, জীবনেও আর এই ট্রেনে উঠবো না।

এত দেরি হওয়ার কারণ ছিল আমার ট্রেনকে বসিয়ে রেখে আন্তঃনগর ট্রেন যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। সিঙ্গেল লাইন হওয়ার কারণে এ সমস্যা। এখানে আমার কিছু করার ছিল না।

আরও আছে। যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে বলেন যে, আপনি তো মেয়ে মানুষ, ট্রেন চালাতে পারেন না। যে কারণে ট্রেন বসে আছে। এগুলো বলেন। আবার যান্ত্রিক ত্রুটি বড় হলে তারা বলেন যে, নারী হওয়ার কারণে সারতে পারি না। এসে গালিগালাজ করেন। বলেন যে, পারেন না আসছেন কেন? আমি বলি, আপনারা ধৈর্য ধরেন, আমাকে কাজ করতে দেন। ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক করে রওনা দিলে সবাই খুশি।

জাগো নিউজ : ট্রেনচালক হিসেবে ভালো লাগার জায়গা কোনটি?

সালমা খাতুন : আমার ভেতরে কিছু বিষয় কাজ করে। আমি ট্রেন চালালে অনেকে খুশিও হন। নারীরাও খুশি হন, পুরুষরাও খুশি হন। ৪০, ৪৫ বা তার বেশি বয়সী নারীরা যখন আমাকে ট্রেনচালক হিসেবে দেখেন, তারা এত খুশি হন! তারা বলেন যে, আপা ট্রেন চালাইতেছেন! আল্লাহ! এত কঠিন কাজ কীভাবে করেন! তারা অনেক খুশি হন। তারা আমাকে দোয়া করেন। তারা বলেন, আমরা তো কখনও কিছু করতে পারিনি, আমরা চাই আপনার মতো নারীরা যেন উঠে আসে। আপনি বেঁচে থাকেন, দোয়া করি। রাস্তা দিয়ে যে হেঁটে আসলাম, আমার পোশাক দেখে কয়েকজন নারী দোয়া করে দিলেন।

অনেক মেয়ে এসে বলেন, আপু আপনি তো আমাদের অনুপ্রেরণা। আমরা অনেক কাজ করতে সাহস পাই না, আজকে সাহস হচ্ছে। আবার ছেলেরাও আসে। তারা বলেন, আপু আমরা কী ট্রেন চালাতে পারবো? আমি বলি, হ্যাঁ পারবেন।

এত পরিশ্রম, তারপরও সবার ভালোবাসা, সেই কারণেই আমার এগিয়ে চলা। আমিও চাই, আমার কাজ যেন কারও মনে অনুপ্রেরণা জোগায় বা সামনের দিকে এগিয়ে আসে।

জাগো নিউজ : আপনার এখন স্বপ্ন কী?

সালমা খাতুন : বাংলাদেশের সবার স্বপ্নের পদ্মা সেতু, প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু, এই সেতুতে যে উদ্বোধনী ট্রেন চলবে, সেই ট্রেনের চালক হতে চাই।

পিডি/ইএ/এসএইচএস/জেআইএম